Beta
সোমবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
সোমবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫

মধ্যপ্রাচ্যে বাড়ছে ত্রিমুখী সংঘাতের শঙ্কা

ফিলিস্তিনের গাজার রাস্তায় ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক বহর। ফাইল ছবি/এএফপি
ফিলিস্তিনের গাজার রাস্তায় ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক বহর। ফাইল ছবি/এএফপি
[publishpress_authors_box]

বিশ্ব রাজনীতির ভরকেন্দ্র মধ্যপ্রাচ্য। অঞ্চলটিতে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। এ সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা বহুপক্ষের। এ বিষয়ে কিছুদিন ধরে সতর্ক করছিল যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও লেবানন। তারা বলছে, একাধিক পক্ষ মধ্যপ্রাচ্যকে নতুন করে অস্থিতিশীল করতে চাইছে।

গাজায় ইসরায়েলের চলমান হামলায় এমনিতেই উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে লেবাননে শীর্ষ হামাস নেতাকে হত্যা ও ইরানে জোড়া বোমা হামলার ঘটনা। এই দুই ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। এমনই বলা হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে।

সেখানে বলা হয়, গত ৭ অক্টোবর হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র কৌশলী অবস্থান নেয়। এই যুদ্ধ যাতে আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ না নেয়, সেই চেষ্টা ছিল বাইডেন প্রশাসনের। এ নিয়ে তারা একাধিক পক্ষের সঙ্গে বৈঠকও করেছে। এমনকি খোদ বাইডেনও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে হুঁশিয়ার করেছিলেন।

মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে?

ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কারমানে গত বুধবার দেশটির সাবেক জেনারেল কাসেম সুলেইমানির চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান হয়। সেখানে জোড়া বোমা হামলায় কমপক্ষে ৯৫ জন নিহত হয়।

কারা এই হামলা চালিয়েছে, তা এখনও জানা যায়নি। ইরান অবশ্য এই হামলার দায় দিয়েছে ইসরায়েলকে। আর তেল আবিব এখনও হামলা নিয়ে কোনও মন্তব্য বা বিবৃতি দেয়নি। লেবানন অবশ্য ইরানের মতোই ইসরায়েলকে দায়ী করেছে।

ঘোলাটে এই পরিস্থিতির মধ্যেই একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, ইরানে বোমা বিস্ফোরণের কয়েক ঘণ্টা আগেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুতিদের সম্পর্কে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। বলা হয়, প্রতিদিনই লোহিত সাগরের বিভিন্ন অংশে বাণিজ্যিক জাহাজ লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে হুতি।

এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র হুতিদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও সামরিক পদক্ষেপ নেয়নি। এর কারণ তারা চায় না ইয়েমেনের যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেস্তে যাক, সেটা যতই ভঙ্গুর হোক না কেন। তবে বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা কিন্তু এখন হুতিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে চাইছেন।

সম্প্রতি হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা এক বিবৃতি প্রকাশ করেন। সেখানে বলা হয়, “আমাদের স্পষ্ট বার্তা : আমরা অবিলম্বে এই অবৈধ আক্রমণ বন্ধ করার এবং বেআইনিভাবে আটক জাহাজ ও ক্রুদের মুক্তির আহ্বান জানাচ্ছি।” এই বিবৃতি এমন এক সময় দেওয়া হলো, যখন লোহিত সাগরে নিজেদের জাহাজ চলাচল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বের শীর্ষ শিপিং কোম্পানি মায়েরস্ক।

ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ জলপথের বাণিজ্যিক প্রবাহ এবং বিশ্ব অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেললে, এর দায় হুতিদের নিতে হবে।” এতে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, বাহারাইন, বেলজিয়াম, কানাডা, জার্মানি, ডেনমার্ক, ইতালি, জাপান, সিঙ্গাপুর ও নেদারল্যান্ডস সরকারের স্বাক্ষর ছিল।

গত সপ্তাহে লোহিত সাগরে মায়েরস্কের একটি জাহাজে হুতিরা হামলা করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীও পাল্টা আক্রমণ করে হুতিদের জলযান লক্ষ্য করে। এতে কয়েকজন হুতি যোদ্ধা ও তাদের তিনটি জলযান ধ্বংস হয়।

এর একদিন পরেই ইরানের নৌবাহিনী গত সোমবার সমুদ্রে নিজেদের নৌবহর মোতায়েনের ঘোষণা দেয়। একই দিনে আবার দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসাইন আমির আবদুল্লাহিয়ান হামাসকে সমর্থন দেওয়ায় তেহরানে সফররত এক হুতি কর্মকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

একদিকে হোয়াইট হাউস তার বিবৃতিতে হুতিদের নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে। অন্যদিকে ইরান হুতিদের প্রতি সমর্থন পুনরায় ব্যক্ত করে। ফলে গোটা পরিস্থিতি একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ বাস্তবতার দিকে মোড় নিচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে।

ইরান জবাব দেবে কি

ইরানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা সাগরে যুদ্ধ জাহাজের বহর পাঠিয়েছেন হুতিদের সমর্থনের উদ্দেশ্যে। তবে এখনই যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধের কোনও পরিকল্পনা ইরানের নেই বলেও তিনি জানান।

মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার গত বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা শুরু থেকেই দুশ্চিন্তায় আছি, এই দ্বন্দ্ব আরও দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।”

ইরানে গত বুধবার দেশটির সাবেক জেনারেল কাসেম সুলেইমানির চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান চলাকালে জোড়া বোমা হামলায় কমপক্ষে ৯৫ জন নিহত হয়। ছবি : এএফপি

লেবাননে বেশ শক্তিশালী সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ। অথচ এই সংগঠনটির নিয়ন্ত্রণে থাকা বৈরুতের দক্ষিণে গত মঙ্গলবার এক বিস্ফোরণে নিহত হন হামাসের শীর্ষ নেতা সালেহ আল অরুরি।

আর বুধবার ইরানের সাবেক জেনারেল কাসেম সুলেইমানির চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জড়ো হওয়া মানুষদের ওপর বোমা হামলা চালানো হয়। এই ঘটনায় গোটা পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে গেছে। ওই হামলার জন্য ইরান ইসরায়েলকে দায়ী করেছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকা হামলায় ইসরায়েলের যুক্ত থাকা নিয়ে সংশয় জানিয়েছে।

যু্ক্তরাষ্ট্রের তিনজন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ইরানে হামলার পেছনে সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেট থাকতে পারে বলে জানান। তারা গোয়েন্দা তথ্যে ভিত্তিতে একথা বলেন।

তবে কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশনসের জ্যেষ্ঠ ফেলো রায় তাকিয়াহ বলেছেন, “এটা সম্ভব যে, ইসরায়েলের ছত্রছায়ায় থাকা দলগুলোর একটি ওই হামলা চালাতে পারে।”

এমন উত্তেজনার মধ্যেই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বুধবার এক বিবৃতি দেন। সেখানে তিনি ইরানের শত্রুদের পাল্টা জবাব দেওয়ার ঘোষণা দেন। তবে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে ইরান সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তি জানান, খামেনি ইরানের সেনাবাহিনীকে ধৈর্য্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

হামাস নেতাকে কে বা কারা হত্যা করেছে তা এখনও পরিস্কার নয়। কিন্তু এই ঘটনার একদিন পরই ইরানে হামলার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেড়েছে।

আঞ্চলিক যুদ্ধ এড়াতে মধ্যপ্রাচ্যে ব্লিনকেন

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অঞ্চলিক সংঘাত এড়াতে কয়েকদিনের মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে সফরে যাবেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। এই সফরের দিকে তাকিয়ে আছেন পর্যবেক্ষকরা।

ন্যাটোর সাবেক কমান্ডার অ্যাডমিরাল জেমস স্ট্যাভরিডিসের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা বেড়েছে। আগে যেখানে শঙ্কা ১৫ শতাংশ ছিল, তা এখন ৩০ শতাংশ হয়েছে।

তবে বাইডেন প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হিজবুল্লাহ ও ইরান যেহেতু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ চালাচ্ছে, ফলে এই যুদ্ধ বিস্তৃত হওয়ার শঙ্কা কম।

মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট পল সালেম মনে করেন, গাজার বিভীষিকার পরও হিজবুল্লাহ নিরাপদ দূরত্বে থাকার নীতিতে চলছে।

বাইডেন ও তার সহযোগিরা গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যে দুটি রণতরী ও অনেক যুদ্ধবিমান পাঠায়। লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত রুখতে ইরানকে চাপে রাখা। কিন্তু এই কৌশল ভেস্তে গেছে। ফলে জেরাল্ড আর ফোর্ডের নেতৃত্বাধীন একটি নৌবহর ওই অঞ্চল থেকে সরিয়ে নিচ্ছে পেন্টাগন।

সংকটে যুক্তরাষ্ট্র

গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়ারা ইরাক ও সিরিয়ায় অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। গত সোমবারের হামলাসহ মোট ১১৮ বার হামলা চালানো হয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন সেনা আহত হয়েছেন। এসব হামলা রুখতে পেন্টাগনও বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে।

বাইডেন প্রশাসন সম্প্রতি কিছু গোয়েন্দা তথ্য প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়, সুয়েজ খালে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালাতে হুতিদের সহায়তা করছে ইরানের আধাসামরিক বাহিনী।

সাগরে হুতিদের প্রতিহত করতে ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র একটি বহুজাতিক নেভাল টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে। এর লক্ষ্য লোহিত ও এডেন সাগরে চলাচলরত জাহাজের নিরাপত্তা দেওয়া।

পেন্টাগনের কর্মকর্তারা ইয়েমেনের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ঘাঁটিতে হামলার পরিকল্পনাও করেছে। তবে এমন হামলা হলে ইসরায়েল ও তার মিত্রদের একাধিক ফ্রন্টে আটকাতে ইরানের কৌশল সুবিধা পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শীর্ষ নেতা আরুরি মৃত্যু হামাসের জন্য একটি বড় ধাক্কা। সংগঠনটির মিত্ররা এখন কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানায়, তাই দেখার বিষয়। পাশাপাশি ইরানে বোমা হামলার প্রতিক্রিয়ায় তেহরান যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার নীতিতেই অটল থাকবে কি না- তাই এখন দেখা বিষয়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত