Beta
বুধবার, ১৮ জুন, ২০২৫
Beta
বুধবার, ১৮ জুন, ২০২৫

ভারতের পেঁয়াজ আসা নিয়ে ধোঁয়াশা, বাজার চড়াই

চোরাপথে আসা ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের আড়তগুলোতে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
চোরাপথে আসা ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের আড়তগুলোতে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

ভারত থেকে পেঁয়াজ আসছে—এমন খবরে গত ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি দাম ১০ টাকা কমেছিল। কিন্তু আমদানির স্পষ্ট কোনও নির্দেশনা না আসায় পরদিনই আবারও আগের দামে পণ্যটি বিক্রি করতে দেখা যায়। সেদিন দেশি মেহেরপুরি পেঁয়াজ ৭৫ টাকা এবং অবৈধভাবে আসা ভারতীয় পেঁয়াজ ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। বৃহস্পতিবারও একই দাম দেখা গেছে দেশের বৃহত্তম এই পাইকারি বাজারে।  

বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে সীমিত পরিসরে আবারও পেঁয়াজ রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। রপ্তানি বন্ধের প্রায় আড়াই মাসের মাথায় গত ১৮ ফেব্রুয়ারি এমন সিদ্ধান্ত আসে।

এরপর ২০ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছিলেন, বাংলাদেশকে পেঁয়াজ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন অফিসিয়ালি কাগজ পেলে দ্রুত ভারত থেকে বাংলাদেশে পেঁয়াজ নিয়ে আসা হবে।

অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা ও দাম নিয়ন্ত্রণে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর মোদি সরকার পেঁয়াজ টনপ্রতি রপ্তানিতে দাম ৮০০ ডলার বেঁধে দেয়। গত বছর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই আদেশ বলবৎ থাকবে বলা হয়।

তবে তার আগেই গত ৮ ডিসেম্বর ভারত আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয়। এতে পরের দিন বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজ খুচরায় প্রায় দ্বিগুণ দামে ২২০ টাকায় ওঠে।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সভাপতিত্বে এক বৈঠকে সীমিত পরিসরে ফের ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানির সিদ্ধান্ত হয়। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ভারতী পাওয়ার টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানান, পেঁয়াজ রপ্তানির বিস্তারিত আগামী দুই দিনের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হবে। তবে রপ্তানি শুরুতে সীমিত থাকবে।

রমজানের আগে কূটনৈতিক চ্যানেলে তদবির করে সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আনার নিশ্চয়তা নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

তবে ২০ ফেব্রুয়ারি ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত বহাল রাখার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেছে বলে বার্তা সংস্থা পিটিআইর বরাত দিয়ে জানিয়েছে দ্য হিন্দু। সেই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।

বাংলাদেশসহ ছয়টি দেশকে সীমিত পরিসরে পেঁয়াজ দেওয়ার মোদি সরকারের সিদ্ধান্ত বিজ্ঞপ্তি আকারে না আসায় দেশের বাজারে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।

ভারতীয় পেঁয়াজ কোন প্রক্রিয়ায় আসবে, আনা হলে সেই পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বিক্রি হবে, নাকি সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে বিক্রি হবে? এসব প্রশ্ন সামনে এসেছে। আর বেসরকারি আমদানিকারকরা সেগুলো আনতে পারবেন কি না—তাও পরিস্কার নয়। এ পরিস্থিতিতে খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক, আড়তদাররা ভারতের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছেন।

চট্টগ্রামের এই ব্যবসায়ীরা চান- ভারত থেকে যে প্রক্রিয়ায়ই পেঁয়াজ আমদানি হোক না কেন, তা যেন পাইকারি বাজারে আসে। তাহলেই কেবল রমজানের আগে বাজারে অস্থিরতা কাটবে বলে মনে করছেন তারা।

খাতুনগঞ্জ আড়তদার সোনালী ট্রেডার্সের কর্ণধার আবসার উদ্দিন সকাল সন্ধ্যাকে বলছেন, “এর আগে পেঁয়াজের চরম সঙ্কটের সময় আমরা দেখেছি বড় শিল্পগ্রুপের মাধ্যমে আনা হয়েছিল। আবার সরকারিভাবে টিসিবির মাধ্যমেও আনা হয়েছিল। টিসিবির মাধ্যমে আনলে সেগুলো ট্রাকের মাধ্যমে খোলা বাজারে বিক্রি হবে। ফলে সবাই সেই পেঁয়াজ কেনার সুযোগ পান না। এটি বাজারে তাৎক্ষণিক বা বড় কোনও প্রভাবও ফেলে না।”

তিনি বলেন, “ভারত যেহেতু ৩১ মার্চ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাই বিকল্প হিসেবে অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আনবে না আমদানিকারকরা। কারণ ভারতের পেঁয়াজ এত কমদামে আসে, যে অন্য দেশের পেঁয়াজ এসে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। অতীতে এভাবে অনেকবার পুঁজি হারিয়েছিলাম আমরা। ফলে সেই ঝুঁকি নিতে রাজি নই।”

খাতুনগঞ্জে আবার চড়ল দাম

ভারত থেকে পেঁয়াজ আসার খবরে ২০ ফেব্রুয়ারি খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি দাম ১০ টাকা কমেছিল। আড়তে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৬০-৬৫ টাকা। অবৈধভাবে আসা ভারতীয় পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল ১০০ টাকা কেজি।

কিন্তু আমদানির স্পষ্ট কোনও নির্দেশনা না আসায় ২১ ফেব্রুয়ারি আবারও আগের দামে পেঁয়াজ বিক্রি হয়। দেশি মেহেরপুরি পেঁয়াজ ৭৫ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। বৃহস্পতিবার ছিল একই দাম।  

খাতুনগঞ্জের হামিদ উল্লাহ মার্কেটেই প্রধানত পাইকারি পেঁয়াজ বিক্রি হয়। বৃহত্তর চট্টগ্রামের খুচরা ব্যবসায়ীরা এই মার্কেট থেকেই পেঁয়াজ কিনে নিজের মুদির দোকানে বা ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে বিক্রি করেন।

হামিদ উল্লাহ মার্কেট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ভারত থেকে পেঁয়াজ আসছে-এমন খবরে দাম কেজিতে ১০ টাকা কমেছিল। কিন্তু গত দুদিন ধরে আবারও আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে।

“দামে এই অস্থিরতার কারণে বাজারে ক্রেতা নেই বললেই চলে। দাম স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত খুচরা দোকানিরা কিনতে চাইছেন না।”

নতুন করে আমদানির প্রস্তুতি

ভারত গত ৮ ডিসেম্বর পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশের বাজারে রাতারাতি চড়ে যায় পেঁয়াজের দাম। তখন বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আনার হিড়িক দেখা যায়। এজন্য কৃষি বিভাগের উদ্ভিদ সংগনিরোধ দপ্তর থেকে অনুমতি নেওয়া শুরু করেন আমদানিকারকরা। কিন্তু এরমধ্যে দেশি পেঁয়াজ বাজারে চলে আসায় এবং অবৈধভাবে ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা শুরু হওয়ায় অনুমতি নিয়েও আর আমদানির ঝুঁকি নেননি আমদানিকারকরা।

উদ্ভিদ সংগনিরোধ দপ্তরের কেন্দ্রীয় তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সলের ৫ জুন থেকে ২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২১ লাখ ৪৭ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি বা আইপি নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বিপরীতে পেঁয়াজ এসেছে মাত্র ৭ লাখ ১৬ হাজার টন। অর্থাৎ অনুমতির এক তৃতীয়াংশ পেঁয়াজ এনেছেন তারা। গত দুদিন ধরে আগের মতো পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি নেওয়া শুরু হয়েছে।

উদ্ভিদ সংগনিরোধ দপ্তরের এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ব্যবসায়ীরা সবসময় ব্যবসাটাই বোঝেন। ভারতসহ অন্তত ১০ দেশ থেকে আমদানির আইপি নিলেও গত একমাস ধরেই আমদানি করেননি। এখন ভারত থেকে আসার সুযোগ হচ্ছে জেনে তড়িঘড়ি করে প্রস্তুতি নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আজকে (বৃহস্পতিবার) অনুমতির জন্য এসেছেন অনেকেই। আবার অনেকেই আগে নেওয়া আইপির মেয়াদ বাড়িয়ে নিচ্ছেন।”

বাংলাদেশ অ্যাগ্রোফুড ইম্পোটার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি রেজাউল করিম আজাদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা এতটাই ভুক্তভোগী যে ভারত থেকে পেঁয়াজ আসবে শুনলেই অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির প্রক্রিয়াই শুরু করি না। মিশর, তুরস্ক, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড থেকে অনেকেই অনুমতি নিয়ে রেখেছেন ঠিকই, পরে আমদানি আর করেননি। রমজানে পেঁয়াজের একটা ভালো চাহিদা থাকে ঠিকই, কিন্তু ভারতের পেঁয়াজ আসলে অন্য দেশ প্রতিযোগিতায় পেরে উঠে না।”

মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আনার সুযোগ নেই

রমজান বা অন্য সময় বাজারে সংকট সৃষ্টি হলে সাধারণত তা সামাল দেওয়া হয় মিয়ানমারের পেঁয়াজ দিয়ে। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে আসে পেঁয়াজ। কিন্তু দেশটিতে জান্তা সরকার ও বিভিন্ন জাতীগোষ্ঠীর বিদ্রোহী জোটের সংঘাতের কারণে আমদানিতে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে।  

টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানিকারক জারিফ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনজুর মোরশেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মিয়ানমারে সংঘাতের কারণে পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ নেই। অনেকে অবশ্য সিঙ্গাপুর বা কলম্বো বন্দর হয়ে কন্টেইনারে চট্টগ্রাম বন্দরে আনছেন আদা, রসুন।

“কিন্তু এখন পেঁয়াজের দাম সেই দেশে অনেক বেশি পড়ছে। তাই মিয়ানমারের বদলে অনেকেই তুরস্ক, মিশর থেকে আনাকে সাশ্রয়ী মনে করছেন। কিন্তু সব কিছু নির্ভর করছে ভারত থেকে পেঁয়াজ কীভাবে ও কত পরিমাণ আসছে তার ওপর।”

রমজানে কেমন থাকতে পারে বাজার

ব্যবসায়ীরা বলছেন, রমজানের আগে কূটনৈতিক চ্যানেলে তদবির করে সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আনার যে নিশ্চয়তা নিয়েছে, সেটি অবশ্যই রমজানে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এখন ইতিবাচক প্রভাবকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে নজর দিতে হবে সরকারের তদারকি সংস্থাগুলোকে।

আমদানি পেঁয়াজ যৌক্তিক দামে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো জরুরি উল্লেখ করে আড়তদার কফিল উদ্দিন বলেন, “মার্চ মাসেই বাজারে আসবে হালি পেঁয়াজ। একইসাথে যদি ভারত থেকে পেঁয়াজ আসে, তাহলে বাজারে সরবরাহ বাড়বেই কোনও সন্দেহ নেই। ফলে ভালোয় ভালোয় রমজান পার করা যাবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত