গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়েছে। তবে ৩৬ দিনের আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের পরিচালন কার্যক্রমে। এতে দেশের প্রধান এই বন্দরে ব্যাপক আকারে জাহাজজট সৃষ্টি হয়েছে, যার ধাক্কা লেগেছে আমদানি-রপ্তানি খাতে।
জেটিতে ভেড়া জাহাজ থেকে পণ্য নামছে ঠিকই কিন্তু সেই পণ্য বন্দর থেকে বের হতে না পারা এবং রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণের জন্য ডিপো থেকে বন্দরে প্রবেশ স্বাভাবিক না হওয়ায় এই জট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে একটি পণ্যভর্তি কন্টেইনার জাহাজ সাগরের বহির্নোঙরে পৌঁছে আট দিন অপেক্ষার পর বন্দর জেটিতে ভিড়তে পারছে; যা গত ১৪ বছরের রেকর্ড।
স্বাভাবিক সময়ে একটি কন্টেইনার জাহাজ বহির্নোঙরে পৌঁছে সর্বোচ্চ তিনদিন অপেক্ষার পর জেটিতে ভিড়তে পারতো। আর এটিকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিতেন চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারীরা।
দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা, মৃত্যু, কারফিউ জারি, ইন্টারনেট বন্ধ থাকা ও পণ্য পরিবহনে আতঙ্ক না কাটায় আমদানি-রপ্তানির এই প্রধান দুয়ার চট্টগ্রাম বন্দরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই ধকল সামলে উঠার চেষ্টা করছে চট্টগ্রাম বন্দর, চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এখনও সেটি স্বাভাবিক হয়নি।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই সোমবার চট্টগ্রাম বন্দরে যোগ দিয়েছেন নতুন চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান।
পণ্যবোঝাই জাহাজ বাড়তি সময় বহির্নোঙরে বসে থাকায় পণ্য পরিবহনের সরবরাহ চ্যানেল ভেঙে পড়েছে। রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণে বাড়তি সময় লাগছে, আর এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন রপ্তানি পণ্যের ব্যবসায়ীরা। আমদানি পণ্য বন্দর থেকে নামিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিতে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। এতে বন্দরের ভিতর কন্টেইনার জট সৃষ্টি হয়েছে।
স্বাভাবিক সময়ে বন্দরে যেখানে ৩০ থেকে ৩২ হাজার একক কন্টেইনার থাকতো। সোমবার পর্যন্ত সেখানে কন্টেইনার জমে হয়েছে সাড়ে ৪৩ হাজার একক।
বন্দরের সর্বশেষ প্রকাশিত ১২ আগস্টের তালিকা অনুযায়ী, ২২টি কন্টেইনার জাহাজ বহির্নোঙরে পণ্য নিয়ে রেডি আছে, কিন্তু জেটি খালি না থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ঢুকতে পারছে না। এসব জাহাজের মধ্যে মাত্র চারটি জাহাজ জেটিতে প্রবেশের অনুমতি পেয়েছে; সোমবার সেই জাহাজ জেটিতে ভেড়ার আগে তাদের চার থেকে আট দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
চারটি জাহাজের মধ্যে ‘এসআইটিসি চাংমিন’ বহির্নোঙরে এসেছে ৪ আগস্ট, ভিড়েছে ১২ আগস্ট। ‘এসওএল প্রমিজ’ ৫ আগস্ট এসে জেটিতে ভিড়েছে ১২ আগস্ট। ‘এমএসসি পোলো-২’ ৮ আগস্ট এসে ১২ আগস্ট জেটিতে ভিড়েছে। আর ‘এইচ আর তুরাগ’ জাহাজ ৮ আগস্ট বহির্নোঙরে পৌঁছে ১২ আগস্ট জেটিতে ভিড়তে পেরেছে।
এর বাইরে বাকি যে ১৭টি কন্টেইনার জাহাজ বহির্নোঙরে আছে তাদের মধ্যে ৬ আগস্টের দুটি জাহাজ আছে। অর্থাৎ ‘ইনক্রেস’ এবং ‘ইয়ং ইউয়ি-১১’ নামের সেই জাহাজ দুটি ইতোমধ্যেই ছয়দিন পার করেছে, কিন্তু জেটিতে ভিড়তে পারেনি।
স্বাভাবিক সময়ে একটি কন্টেইনার জাহাজ বহির্নোঙরে পৌঁছে সেখান থেকে অনুমতি নিয়ে জেটিতে ভিড়তে সময় লাগতো আড়াই থেকে তিনদিন। এই সময়কে স্ট্যান্ডার্ড বলে ধরে নিত বন্দর ব্যবহারকারীরা। কিন্তু বাস্তবে এর চেয়ে কম সময়ে জাহাজ ভিড়ছিল এই বন্দরে।
বেশ কবছর ধরেই এই অবস্থা চলে আসছিল। স্বস্তিতে ছিলেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। আবার সেই সময়ে জাহাজের তুলনায় জেটি খালি থাকায় অনেক কন্টেইনার জাহাজই দিনে দিনেই অর্থাৎ অন এরাইভাল জেটিতে ভিড়তে পেরেছিল।
এক মাস আগে ২০২৪ সালের জুলাই মাসের চিত্রের সঙ্গে তুলনা করলে পরিস্থিতি পরিস্কার হবে।
গত ১১ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্যবাহী কন্টেইনার জাহাজ অপেক্ষায় ছিল ৮টি। এরমধ্যে দুটি জাহাজ ‘এসআইটিসি চাংমিন’ এবং ‘এসওএস রেজিলিয়েনস’ ৮ জুলাই বহির্নোঙরে পৌঁছে এবং তিনদিন পর ১১ জুলাই জেটিতে ভিড়েছিল। বাকি একটি জাহাজ ‘এইচ আর ফারহা’ ১০ জুলাই বহির্নোঙরে পৌঁছে একদিন পরই ১১ জুলাই জেটিতে ভেড়ে। বাকি ৫টি জাহাজের সবই জেটিতে ভিড়েছে তিনদিন পর। অর্থাৎ তিনদিনের বেশি বহির্নোঙরে থাকতে হয়নি একটি কন্টেইনার জাহাজকে।
তবে জুলাই মাসের শেষ থেকে আগস্টের এই সময় পর্যন্ত আন্দোলন, অস্থিরতা, সহিংসতার কারণে অচলাবস্থায় পড়তে হয় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে। সেই ধকল এখনও সামাল দিতে হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, এইচ আর গ্রুপের কন্টেইনার জাহাজগুলো জেটিতে ভিড়তে সময় নেয় খুব কম। সেগুলো বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ হওয়ায় ফ্ল্যাগ প্রটেকশন আইনে সেগুলো জেটিতে ভিড়তে অগ্রাধিকার পায়। অর্থাৎ অন্য জাহাজের মতো তাদের বাড়তি সময় অপেক্ষায় থাকতে হয় না। দিনে দিনেই কিংবা একদিনের মধ্যেই সেই জাহাজগুলো জেটিতে ভিড়তে পারে।
তিন দিনের বদলে আট দিন সময় লাগায় বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন রপ্তানি খাতের ব্যবসায়ীরা। তাদের পণ্য জাহাজীকরণের শিডিউল ভেঙে পড়েছে। বিদেশি ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করতে না পেরে অনেকেই উড়োজাহাজে পণ্য পাঠাচ্ছেন। এতে অনেক বেশি পরিবহন খরচ গুনতে হচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম চট্টগ্রামের প্রেসিডেন্ট এস এম আবু তৈয়ব সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অস্থিরতা-সহিংসতার ধকল কাটিয়ে আমরা কারখানা সচল করে ঠিকই উৎপাদনে গেছি। পণ্য উৎপাদন করে জাহাজীকরণ করতে না পারায় নিজেদের গুদাম কার্টন ভর্তি হয়েছে। অবস্থা এমন যে এখন কারখানার ফ্লোরে ফ্লোরে বারান্দায় পর্যন্ত রাখতে হচ্ছে রপ্তানি পণ্য। এভাবে তো বেশিদিন সামাল দেওয়া যাবে না।
“এমনিতেই এসব সহিংসতায় বিদেশে ভুল বার্তা গেছে, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এসবের জবাব দিতে দিতে আমরা হয়রান। এখন রপ্তানি পণ্যটাই যদি অনটাইমে পাঠাতে না পারি তাহলে বিদেশি ক্রেতা ধরে রাখা কঠিন হবে। নতুন বন্দর চেয়ারম্যান যোগ দিয়েছেন শুনেছি। আমরা চাইবো এক সপ্তাহের মধ্যেই এই পরিস্থিতির একটা সমাধান বিশেষ পদক্ষেপ নিয়ে উনি করবেন। তা না হলে আমরা এর ধকল সইতে পারবো না।”
শিল্প কারখানা থেকে পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানির জন্য প্রথমে পাঠানো হয় বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে। সেখানে কাস্টমসের প্রক্রিয়া শেষ করে অনুমোদনের পর কন্টেইনারভর্তি পণ্য বন্দরে নিয়ে গিয়ে জাহাজীকরণ করা হয়। কিন্তু সেই সরবরাহ প্রক্রিয়ায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
সড়কপথে পণ্য পরিবহনে আতঙ্কের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রপ্তানি পণ্য সেই ডিপোগুলোতে আসেনি। আর ডিপো থেকে পণ্য জাহাজীকরণের জন্য বন্দরে যায়নি। আর ডিপো থেকে আমদানি পণ্য কারখানায় যায়নি। এই অবস্থায় ডিপোতে আমদানি-রপ্তানি এবং খালি কন্টেইনার জমে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম সুজন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মূলত পণ্য পরিবহনে আতঙ্কের কারণ আমদানি পণ্য যেমন ডেলিভারি কমে গিয়েছিল, তেমনি রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণ হয়নি। এখন সেই আতঙ্ক কেটেছে, আস্থা ফিরেছে। কিন্তু রাতারাতি তো আর পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
“কারণ, পণ্য পরিবহনে যে গাড়ি আছে সেগুলো তো নির্দিষ্ট। ফলে এখানে সড়কপথে পণ্য পরিবহনে যদি বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া যায় এবং বন্দর থেকে দ্রুত আমদানি পণ্য ছাড়ের পদক্ষেপ নেওয়া যায় তাহলে পরিস্থিতির উন্নতির চিত্র দ্রুত চোখে পড়বে। আমরা তার অপেক্ষায় আছি।”
চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাবে, এই বন্দরে মোট ৫৩ হাজার একক কন্টেইনার রাখা যায়। বিপরীতে ১১ আগস্ট পর্যন্ত কন্টেইনার জমেছিল সাড়ে ৪৩ হাজার একক। আর বন্দর থেকে কন্টেইনার ডেলিভারি পরিস্থিতি আগের চেয়ে বেড়েছে, কিন্তু এখনও স্বাভাবিক হয়নি। স্বাভাবিক সময়ে চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার একক কন্টেইনার ডেলিভারি হলে ১১ আগস্ট একদিনে হয়েছে ৩,২৬৫ একক।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, “সব স্বাভাবিক হতে শুরু করায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনও বেড়েছে। আশা করছি, এই সপ্তাহের মধ্যেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। রাজস্ব বোর্ডে আবেদন করা হয়েছে, বন্দরের ভিতর ট্রেনপথে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা বিপুল কন্টেইনার দ্রুত সড়কপথে ডেলিভারির অনুমোদন দেওয়ার জন্য। সেটি অনুমতি পেলে কন্টেইনারজটের উন্নতি লক্ষণীয় হবে।
“আর নতুন বন্দর চেয়ারম্যান স্যার যোগ দিয়েছেন, তিনি বন্দর ব্যবহারকারীদের সাথে বসে দ্রুত করণীয় ঠিক করবেন।”