Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪

সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে বিতর্কের শেষ কোথায়

সংবিধান
বাংলাদেশের সংবিধান।
[publishpress_authors_box]

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিজয়ের পর সংবিধান সংশোধন, নাকি পুনর্লিখন- তা নিয়ে আলোচনার মধ্যেই সংবিধান সংস্কারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত কমিশন কাজ শুরু করেছে।

গত ৩ নভেম্বর কমিশনের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে সংবিধান সংস্কারের সাতটি উদ্দেশ্য ঘোষণা করা হয়। সেখানে প্রথম উদ্দেশ্যেই উঠে এসেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা।

তার আগে গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘রিসেট বাটন’ বক্তব্যটি আসে।

সেই বক্তব্য নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস প্রশ্নে নোবেলজয়ী একমাত্র বাংলাদেশি ব্যক্তি ড. ইউনূসের সমালোচনাও চলে সমানতালে। ‘ইউনূস হটাও’ হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং হয়ে উঠেছিল তখন এক্স এ।

পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে ‘রিসেট বাটন’ কথার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকে কম্পিউটারের হার্ডঅয়্যারের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়, একাত্তরের ইতিহাস মুছে দেওয়ার কথা ড. ইউনূস বলেননি।

সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশনও শুরুতেই পড়ে বিতর্কে। গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে ড. ইউনূস কমিশনের প্রধান হিসেবে আইনজীবী শাহদীন মালিকের নাম ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তিনি এই দায়িত্ব নিতে রাজি হননি। সপ্তাহখানেক পর প্রবাসী অধ্যাপক আলী রীয়াজকে দেওয়া হয় কমিশন প্রধানের দায়িত্ব।

এত আলোচনার মধ্যে কমিশনের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে সংবিধান সংস্কারের সাতটি উদ্দেশ্য তুলে ধরেন কমিশনে প্রধান আলী রীয়াজ।

কিন্তু সেই সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সদস্য এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমের বক্তব্যেও শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক।

আওয়ামী লীগ সরকার হটাতে এক দফা ঘোষণার দিনই সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারই বাস্তবায়ন করবে- তার এই বক্তব্যে প্রশ্ন উঠেছে, সংবিধান সংস্কারের এখতিয়ার বর্তমান সরকারের আছে কি না?

কমিশন কী বলছে?

সংবাদ সম্মেলনে আলী রীয়াজ তার কমিশনের প্রত্যেক সদস্যকে নিয়েই উপস্থিত ছিলেন। তিনি সংবিধান সংস্কারের উদ্দেশ্যগুলো তুলে ধরেন সাংবাদিকদের সামনে।

উদ্দেশ্যগুলো হলো- দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিশ্রুত উদ্দেশ্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এবং ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আলোকে বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা; ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো; রাজনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বস্তরে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতের ব্যবস্থা; ভবিষ্যতে যেকোনও ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার উত্থান রোধ; রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ- নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ এবং ক্ষমতার ভারসাম্য; রাষ্ট্র ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যাপ্ত ক্ষমতায়ন; রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক এবং আইন দ্বারা সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকর স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ হবে সংবিধান সংস্কারের উদ্দেশ্য।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সংযোজন-বিয়োজন-পুনর্লিখন, সব রকম ব্যবস্থা সামনে রেখেই সংস্কারের আলোচনা হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসবে না কমিশন। অবশ্য দলগুলোর কাছ থেকে লিখিত সুপারিশ নেবে।

তবে কমিশন আলোচনায় বসবে বিভিন্ন সংগঠন, বিশিষ্টজনদের সঙ্গে। এছাড়া সাধারণ নাগরিকরা লিখিত প্রস্তাব দিতে পারবে।

জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে আলী রিয়াজ। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

‘মুক্তিযুদ্ধেকে পাশ কাটানো অসম্ভব’

প্রধান উপদেষ্টার রিসেট বাটনের বক্তব্য নিয়ে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ হয়েছে বলে মনে করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক আবুল কাসেম ফজলুল হক।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া অসম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনেক বড়। আপনি ধরতে পারেন, এটি শুরু হয়ে গিয়েছিল ৪৮ সাল থেকেই। ভাষা আন্দোলনে আমরা রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা চেয়েছি। সেই থেকেই কিন্তু আমাদের নিজেদের রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রাম শুরু।

“ফলে এই ইতিহাস বাদ দিয়ে আপনি কোনোদিন দাঁড়াতে পারবেন না। ফলে, এই চিন্তা করাও অবান্তর যে কেউ এসে এমনিতেই পাল্টে দেবে আমাদের ইতিহাস।”

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ মনে করেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষার মধ্যে খুব একটা তফাৎ নেই।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একাত্তরে আমরা যখন যুদ্ধ করি, তখন আমরা একটি বৈষম্যহীন দেশ চেয়েছিলাম। এবারের অভ্যুত্থানেও তো তাই। ফলে, মানুষের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই।”

ফলে, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রথম উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা থাকাটা স্বাভাবিক বলেই মনে করেন আনু ‍মুহাম্মদ।

শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর সংসদ ভবনে উল্লসিত জনতা। ফাইল ছবি

সংস্কার করবে কে?

অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতি সংসদও বিলুপ্ত করলে সাংবিধানিক সংকটে পড়ে দেশ। তারপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলেও তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে।

এরমধ্যে এই সরকার সংবিধান সংস্কারের ম্যান্ডেট রয়েছে কি না, তা নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য এ এম মাহবুবউদ্দিন খোকনও এই প্রশ্ন তুলে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ছাত্ররা বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। আমাদের সকলের সমর্থন তাদের প্রতি ছিল। কিন্তু সংবিধান সংস্কার বা পুর্নলিখনের তো কোন কথা ছিল না। এটা কি এত সহজ? একটি অনির্বাচিত সরকার কীভাবে ঠিক করবে কোথায় কোথায় কী সংস্কার হতে পারে।”

সংবিধানে সংস্কার আনার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও তার মতে, এটা করতে হবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারকে। নইলে জাতীয় সরকারের মাধ্যমে।  

“সংস্কার তো করতেই হবে। ১৫ বছরের যেই কাঠামো, তা দিয়ে গণতন্ত্র আসবে না। ফলে, এই সরকার সর্বোচ্চ সুপারিশ ঠিক করতে পারে। আর এই সরকারের যদি তা পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে তো জাতীয় সরকারের বিকল্প নেই।”

নির্বাচিত সরকারব্যতীত সংবিধান পরিবর্তন কঠিন বলেও মনে করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদও। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার কমিশনের বসার প্রয়োজনও দেখছেন তিনি।

আনু মুহাম্মদ বলেন, “যেই ড্রাফট তৈরি হবে, তাতে সবার মতামত থাকতে হবে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর স্টেক সবচেয়ে বেশি। তাদের সাথে কমিশনেরই বসা উচিৎ। তারা যদি নাই জানে আপনি কোন আলোচনা রাখছেন, আর কোনটা রাখছেন না, তাহলে তো তা পূর্ণাঙ্গ হবে না।”

সংবিধান সংস্কারটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে করার পক্ষে মত দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়াও।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সংবিধানে কোনও পরিবর্তন করতে হলে নির্বাচিত সরকারের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি লাগবে। এখনকার অবস্থায় যেই সুপারিশ বা সংস্কার প্রস্তাব তৈরি হবে, একটি নির্বাচিত সংসদ আসার পর তার দুই-তৃতীয়াংশের সম্মতিতে এসব অনুমোদন হবে।

“এখন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার যদি তা করতে চায়, তাহলে তারা এই দুই-তৃতীয়াংশ লোকের সম্মতি কোথা থেকে পাবে?”

“বইয়ে কোথায় কী লেখা আছে, তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো লম্বা সময় ধরে আমরা যে প্র‍্যাকটিস করছি, তা। এসব প্র‍্যাকটিসকে আমাদের সংবিধান আইনের স্বীকৃতি দেয়। সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদেই এসবকে প্রপার সোর্স অব ল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর বাইরে আর কোনও প্রসেস নেই,” বলেন ব্যারিস্টার বড়ুয়া।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত