Beta
বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪

সংবিধানে যেনতেনভাবে হাত দেওয়া যায় না : কামাল হোসেন

সুপ্রিম কোর্ট বার মিলনায়তনে ‘সংবিধান দিবস’ উপলক্ষে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি আয়োজিত আলোচনা সভা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
সুপ্রিম কোর্ট বার মিলনায়তনে ‘সংবিধান দিবস’ উপলক্ষে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি আয়োজিত আলোচনা সভা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আলোচনা যখন সংবিধান সংস্কার হবে, না কি নতুন করে লেখা হবে, তা নিয়ে, তখন শাসনতন্ত্রে হাত দেওয়ার আগে সতর্কবার্তা এল বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে।

স্বাধীনতার পর যার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংবিধান লেখা হয়েছিল, সেই ড. কামাল হোসেন বললেন, যেনতেনভাবে যেন সংবিধানে হাত দেওয়া না হয়।

সোমবার যে আলোচনা সভায় প্রবীণ এই আইনজীবী এই সতর্কবার্তা দিলেন, সেই সভায় আইনজীবী শাহদীন মালিকও ছিলেন, যার হাতে এবার সংবিধান সংস্কারের ভার দিয়ে চেয়েছিল বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, কিন্তু তিনি তা এড়িয়ে যান। তিনিও সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।

এই আলোচনায় অংশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, বিএনপি নেতা এ এম মাহবুবউদ্দিন খোকন তো ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সংবিধান সংস্কারের এখতিয়ার নিয়েই প্রশ্ন তোলেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংবিধান সংস্কার নিয়ে আলোচনার মধ্যে সোমবার সংবিধান দিবসে গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির আলোচনায় তাদের এমন মতামত আসে।

স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের পর তা গৃহীত হয়েছিল। রাষ্ট্র পরিচালনার বিধিমালা প্রণয়নের দিনটি সংবিধান দিবস হিসাবে পালিত হয়।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়ে যে কমিটি করে দিয়েছিলেন, সেই কমিটির প্রধান ছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতা ও মন্ত্রী ড. কামাল।

তার দুই দশক পর আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এখন গণফোরামে নেতৃত্ব দেওয়া ড. কামাল সভায় বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মত গড়ে উঠলেই কেবল সংবিধানে হাত দেওয়া যেতে পারে।

“এটাকেই সংবিধানের পবিত্রতা বলি। এটাকে মৌলিক আইন কেন বলি? কারণ সব আইনের ঊর্ধ্বে এর একটা মর্যাদা আছে। যেনতেনভাবে এটাতে হাত দেওয়া যায় না। এমনিক, সংসদও মৌলিক বিষয়ে হাত দিতে পারে না।”

সংবিধান হেফাজতে জনগণের দায়িত্বের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “সকলে মিলে যদি বলে সুপ্রিম কোর্টের রায় হয়েছে, এ রায় ঠিক হয়নি, তখন সেই রায় পুনর্বিবেচনা করার বিধান রয়েছে। একটা ঐক্যমত গড়ে তুলতে হবে, যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংসদের কাছে দাবি রাখতে পারি। মূল জিনিস হল, সংবিধান সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে।”

তবে প্রয়োজনে যে সংবিধানে পরিবর্তনও আসতে পারে, সে বিষয়টি তুলে ড. কামাল বলেন, “জনগণ মনে করলে সংবিধানে সংশোধনী আনা যেতে পারে। সংবিধানে ১৬টি সংশোধনী হয়েছে। যখন দেখেছে, সংবিধানে কোনও ঘাটতি আছে, যে বিধান আছে, তা মানুষের স্বার্থে কাজে লাগছে না, সেটা বদলানো হয়েছে।

“সংবিধান মানুষের করা আইন, এটাতে কোনও ভুল হলে বা সময়ের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শোধরানো যেতে পারে। তবে এটা করতে হবে মানুষদের নিয়ে। কোনও ব্যক্তি, রাষ্ট্রপতিও যদি মনে করেন; কলমের খোঁচা দিয়ে সংবিধান বদলাতে পারবেন না।”

যাদের নেতৃত্বে আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়েছে, সেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা চাইছেন, সংবিধান নতুন করে লিখতে হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান সংস্কারে যে কমিটি করেছে, আলী রীয়াজ নেতৃত্বাধীন সেই কমিটির সদস্যরা সম্প্রতি ড. কামালের মতামত নিয়েও এসেছেন।

সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনে নতুন প্রজন্মকে সহযোগিতা করতে নিজের অনাপত্তির কথাও জানান বর্ষীয়ান রাজনীতিক ড. কামাল।

তিনি বলেন, “একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়সঙ্গত, এবং সাম্যভিক্তিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। লিঙ্গ, ধর্ম, জাতিসত্তা, রাজনৈতিক বা অন্য যে কোনও পরিচয়ের কারণে বৈষম্য হতে দেওয়া যাবে না। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সকল সাংবিধানিক সংস্কার করতে হবে।”

সংবিধান নিয়ে নানামুখী কথাবার্তার প্রতিক্রিয়ায় আইনজীবী শাহদীন মালিক সোমবারের সভায় বলেন, “এখন না বুঝেই অনেকে অনেক কথা বলছে। অনেকে বলছেন, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট লাগবে। দুনিয়াতে খুঁজে বের করা যাবে না, এককক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট হয়েছে।”

সংবিধান সংস্কারের ‘জোয়ারের পানি বইছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এ জোয়ারের পানিতে পা দিলে পা ফসকে কখন পড়ে যাব, টের পাব না। তাই সংবিধান সংস্কার সম্পর্কে কিছু বলাটা অনুচিৎ হবে।”

আইনজীবী শাহদীন মালিককে প্রধান করে সংবিধান সংস্কার কমিটির ঘোষণা আসার পর তিনি শারীরিক অসামর্থ্যেল কারণে সেই দায়িত্ব নিতে অপারগতা জানালে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রীয়াজকে।

শাহদীন মালিক ৫২ বছরেও বাংলাদেশে সরকার ব্যবস্থা নিয়ে থিতু হতে না পারা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, “সংবিধান সংস্কারের যে কথা উঠছে, এখন আমার দৃষ্টিতে দেখছি, ১২ ধরনের সরকার ট্রাই করেছি, কোনও লাভ হয়নি, এখন ১৩ ধরনের সরকার ফর্মের ট্রাই করব। এভাবে সরকার ফর্ম করার বিষয়ে দুনিয়াতে আমরা বোধহয় রেকর্ড করব।

“দেশ চালাতে গেলে, রাষ্ট্র চালাতে গেলে সব রাষ্ট্রেরই সমস্যা হয়। কিন্তু সমস্যার পর এই যে এতবার সরকার ফর্ম হলো, এটা হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনায় চিন্তাভাবনার অপরিপক্কতার বহিঃপ্রকাশ।”

সমস্যায় পড়লেই সরকারের গঠনের প্রক্রিয়া পরিবর্তনের দিকটি দেখিয়ে শাহদীন মালিক বলেন, “এটা দুনিয়াতে কেউ করে না। প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি হয়, একদলীয় ব্যবস্থা হয়, বহুদলীয় ব্যবস্থা হয়, একনায়কতন্ত্র হয়, তত্ত্বাবধায়ক হয়, অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক হয়, এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।”

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন, বর্তমান সংবিধান ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছে, তাই ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঠেকাতে এই সংবিধান পুনর্লিখন জরুরি।

সেই প্রসঙ্গ ধরে দেশের সর্ববৃহৎ দুই দলের একটি বিএনপির নেতা মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, “ছাত্ররা, তাদের ম্যান্ডেট ছিল যে, চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ। অ্যাম আই রাইট? দিস ইজ দ্য ডিমান্ড, দিস ইজ দ্য ম্যান্ডেট। সেটা তো বাদ করে দিল। কোটি কোটি মানুষ এটা সমর্থন দিয়েছে।

“ছাত্ররা সেই সময় বলেনি যে তারা রাষ্ট্র সংস্কার করবে। এটা তাদের ম্যান্ডেট ছিল না। এটা পার্লামেন্টের কাজ।”

বর্তমান সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, “ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে যদি সংবিধান সংশোধন হয়, সেই সংশোধন টেকে না।”

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভায় ইতিহাসের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে জনগণের ইচ্ছা প্রাধান্য না পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল, তথাকথিত ষোলটি সংশোধনীর মাধ্যমে তা আর অবিকল নেই। বেশিরভাগ সংশোধনী হয়েছে শাসকের ইচ্ছায়, জনগণের ইচ্ছায় নয়।”

সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধান যুগোপযোগী করার পক্ষে মত দিয়ে তিনি দুই-একটি পরিবর্তনের সুপারিশও করেন।

“সংবিধানের নামে ভুল আছে, সেটা সংশোধন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুই বারের বেশি নয়, তা যুক্ত করতে হবে।”

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সরাসরি ভোটে করার সুপারিশ জানিয়ে সৈয়দ আনোয়ার বলেন, “বর্তমানে দেখেছি, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত