চট্টগ্রাম বন্দরে দিনে জাহাজ ভেড়ে ১০টি, এর মধ্যে কন্টেইনারবাহী জাহাজ আসে গড়ে চারটি। বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য নিয়ে আসে এসব জাহাজ। তা কখনও প্রচারে আসে না। কিন্তু হালে পাকিস্তান থেকে জাহাজ আসার খবর হয়ে ওঠছে সংবাদের শিরোনাম।
গত নভেম্বরে পাকিস্তান থেকে পণ্য নিয়ে সরাসরি একটি কন্টেইনার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ার পরই হৈ চৈ শুরু হয়েছিল। পাকিস্তান হাই কমিশন যেমন ফলাও করে সেই খবর প্রকাশ করেছিল। আবার সেই জাহাজের পণ্য নিয়ে নানা সন্দেহের কথা আসছিল ভারতের সংবাদমাধ্যমে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে ও সোশাল মিডিয়ায়ও বড় খবর হয়ে উঠেছিল সেই জাহাজ।
সেই আলোচনার রেশ না কাটতেই দ্বিতীয় বার সেই জাহাজে করে পাকিস্তানের করাচি থেকে এসেছে আমদানি পণ্য। এই জাহাজ থেকে চট্টগ্রামে নামবে ৮২৫ একক কন্টেইনার পণ্য। জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে ভিড়বে ২২ ডিসেম্বর। পণ্য নামিয়ে বন্দর ছাড়বে ২৪ ডিসেম্বর।
প্রশ্ন আসছে, এত এত জাহাজ আসছে, পাকিস্তান থেকে পণ্য এলেই কেন হৈ চৈ হচ্ছে। যেখানে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানিতে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। পাকিস্তানের ওপর কোনও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও নেই।
এনিয়ে চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম রাব্বানি রিগ্যান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কোনও ট্রেডবডি থেকে তো এই হৈ চৈ বা মাতামাতি হচ্ছে না। আসছে বাইরের কিছু মিডিয়া বা সংস্থা থেকে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সব দেশ থেকেই আমরা পণ্য আনতে পারি।”
আমদানি করা পণ্য বন্দরে ছাড় করানোর কাজটি হয়ে থাকে ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্টদের মাধ্যমে।
আমদানিকারকরাও পাকিস্তানি পণ্য আমদানি নিয়ে আলোচনার কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না।
ভোগ্যপণের আমদানিকারক এটিআর গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আমরা নির্দিষ্ট কোনও দেশ থেকে পণ্য আমদানিতে সীমাবদ্ধ থাকি না। যেখানে পণ্যের বুকিং দর কম, পণ্যের মান ভালো এবং সেই পণ্য বাংলাদেশে পৌঁছাতে কত খরচ হবে, সেই বিষয় মাথায় নিয়েই আমরা পণ্য আমদানি করি।
“আগে আমরা ভারত থেকে আনতাম। এখন পাকিস্তান থেকে যদি দাম কম পাই, তাহলে সেখান থেকে আনব। বিকল্প থাকলে আমাদের জন্যই ভালো। আমরা কম দামে পণ্য দেশে এনে ভোক্তাকে দিতে পারব।”
এখানে বিষয়টি যতটা না বাণিজ্যিক, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। ১৯৭১ সালে এই পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তি পেতে নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ গত দেড় দশকে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার সময় পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অতটা গাঢ় ছিল না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই দৃশ্য বদলে গেছে।
পাকিস্তানের পণ্য আসা যেভাবে সহজ হলো
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তার সঙ্গে দেখা করেন পাকিস্তানের হাই কমিশনার; ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার আগ্রহ দেখান তিনি। পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ির বিধান বাতিলের সুপারিশ করেন তিনি।
২০০৯ সাল থেকে পাকিস্তানি পণ্য আমদানির পর ছাড় নিতে গেলে শতভাগ কায়িক পরীক্ষার বিধান ছিল। এতে পণ্য খালাসে দেরি হতো বলে আমদানিকারকরা পাকিস্তানি পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত হতেন।
নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজস্ব বোর্ড ২৯ সেপ্টেম্বর আগের নিয়ম বাতিল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে। তাতে অন্য যেকোনো দেশের পণ্যের মতো ১০ শতাংশ পণ্যের কায়িক পরীক্ষা করেই ছাড় দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
এর পরই পাকিস্তান থেকে পণ্য নিয়ে প্রথম জাহাজ আসে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে। দুবাইভিত্তিক কনটেইনার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ‘ফিডার লাইনস ডিএমসিসি’ নতুন একটি সার্ভিস চালু করে। আগে দুবাই হয়ে আসত পণ্য, এখন সরাসরি করাচি থেকে আসছে।
পাকিস্তানি পণ্যের আমদানি সহজীকরণে এনবিআরের নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, মাদকদ্রব্যসহ নিষিদ্ধ পণ্যে কঠোরতা রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ও পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে সহজ পদ্ধতির পথে হাঁটছে রাজস্ব বোর্ড। পাকিস্তান থেকে আগত সব পণ্যের চালান ন্যাশনাল সিলেকটিভ ক্রাইটেরিয়া কর্তৃক শতভাগ কায়িক পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হচ্ছে। ফলে ‘রেড লেন’ থেকে অবমুক্তকরণে অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ডেপুটি কমিশনার পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অধিক সময় ব্যয় হচ্ছে। তাছাড়া কায়িক পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য কোনও ফলাফলও পাওয়া যাচ্ছে না। সেই কারণে পাকিস্তান থেকে আসা পণ্য ‘রেড লেন’ থেকে অবমুক্ত করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা গোলাম রাব্বানি রিগ্যান বলেন, “আগে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তে কড়াকড়ি ছিল। এখন সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি সহজীকরণ।”
পাকিস্তানি পণ্যের কায়িক পরীক্ষা হচ্ছে কি?
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতিদিন আমদানি হওয়া ১৯শ থেকে ২২শ পণ্যের চালান চট্টগ্রাম কাস্টমসে ছাড়পত্রের জন্য জমা পড়ে। এরমধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে মাত্র ১০ শতাংশ চালান কায়িক পরীক্ষা করেই ছাড় দেয় কাস্টমস। এটা প্রচলিত নিয়ম।
মূলত আমদানিকারক পণ্যের যে ঘোষণা কাগজে-কলমে দেন, সেই পণ্য কন্টেইনারে সঠিক পরিমাণ আছে কি না কিংবা মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য এনে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে কি না কিংবা এক পণ্যের ঘোষণা দিয়ে অন্য পণ্য বা নিষিদ্ধ পণ্য আমদানি হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতেই এই নিয়ম।
কিন্তু কোনও পণ্যের চালানের বিরুদ্ধে যদি বিশেষ অভিযােগ থাকে, তাহলে সেই কন্টেইনারে থাকা পণ্যের শতভাগই খুলে কায়িক পরীক্ষা করে কাস্টমস।
এভাবে দেখা গেছে, কাপড়ের কাঁচামালের আড়ালে সিগারেটের চালান ধরা পড়ে। আবার আপেল আমদানির আড়ালে কন্টেইনারভর্তি মদের চালান ধরা পড়ে।
কিন্তু কাস্টমস কেবল অভিযোগ পেলেই এই নিয়ম প্রয়োগ করে। ফলে অভিযোগ না থাকা বিশাল পণ্য চালানে আসলে কী থাকছে, সেটি শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই।
এতদিন পাকিস্তান থেকে আসা পণ্যের সবটাই খুলে শতভাগ কায়িক পরীক্ষার বিধান ছিল; এখন তা উঠে গেছে।
নভেম্বরে আসা প্রথম জাহাজে বিভিন্ন আমদানিকারকের ৩৭০ একক কনটেইনার পণ্য ছিল। এর মধ্যে পাকিস্তান থেকে আসে ২৯৭ একক কনটেইনার, বাকিগুলো সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। আমদানিকারকের ঘোষণা অনুযায়ী সেই চালানে সোডিয়াম কার্বনেট বা সোডা অ্যাশ, খনিজ পদার্থ ডলোমাইট, চুনাপাথর, ম্যাগনেশিয়াম কার্বনেট, পোশাক শিল্পের কাঁচামাল কাপড়, রঙ, পেঁয়াজ ও আলু ছিল।
কিন্তু কাস্টমসের পরীক্ষায় সেই চালানে ঘোষিত পণ্যের বিপরীতে অন্য পণ্য ছিল কি না, শতভাগ কায়িক পরীক্ষা না হওয়ায় কাস্টমস কর্মকর্তারা তা নিশ্চিত নন।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের মুখপাত্র এবং উপ কমিশনার সাইদুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রথম চালান ৩৭০ কন্টেইনার ছিল। সব কন্টেইনার চাইলে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা যায়। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে সেটি সম্ভব না।
“কারণ সেই চালানে অনেক ধরনের পণ্য ছিল। সব কন্টেইনার শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করতে গেলে পণ্য ডেলিভারি অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমরা সচরাচর যেভাবে পণ্য ছাড় দিই, সেভাবেই দিয়েছি।”
পাকিস্তানের পণ্য নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনও অভিযোগ না থাকলে ফেইসবুকে নানা আলোচনা দেখে বন্দরে গিয়ে পরীক্ষা করে তার সত্যতা পাননি বলে জানান সাইদুল।
সেই চালানে কোনও অনিয়ম বা মিথ্যা ঘোষণার পণ্য ছিল কি না- প্রশ্ন করা হলে এই কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, “সেটা আসলে একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব না। কারণ কাস্টমসে একেক গ্রুপ থেকে একেক ধরনের পণ্য ছাড় পেয়েছে। তবে এটি বলতে পারি, বড় কোনও অনিয়ম ছিল না বলেই চালানগুলো ছাড় পেয়েছে।”
কয়েকজন কাস্টমস কর্মকর্তারা বলেন, বন্দরে নামানো চালানের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ জমা হলেই সেই পণ্যের শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু প্রথমবার আসা চালানে শতভাগ কায়িক পরীক্ষার ঝুঁকি তারা নিতে চাননি। ফলে অন্য পণ্যের মতোই অনুমতি নিয়েই চালানটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকেই ছাড় পায়।
তবে বন্দর ব্যবহারকারী এক ব্যবসায়ী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমদানিকারক যে ঘোষণা কাস্টমসে জমা দেয়, তার সাথে অনেক সময় পণ্যের মিল থাকে না। সেটি ধরা পড়ে যখন চালানের কায়িক পরীক্ষা করা হয়। যেসব চালান নমুনা পরীক্ষায় আসে না, সেগুলো ঠিকই ছাড় পেয়ে যায়। অবৈধ নিষিদ্ধ পণ্য সেই সুযোগে বন্দর থেকে বের হয়ে যায়। তাই বিশেষ করে রাসায়নিক আমদানিতে স্বচ্চতা নিশ্চিত করা উচিৎ।
চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা গোলাম রাব্বানি রিগ্যানও মনে করেন, যেহেতু প্রতি ৩৫-৪০ দিন পর পাকিস্তান থেকে জাহাজ আসছে। তাই স্বচ্ছতার স্বার্থে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ।
“যেহেতু আলোচনা উঠেছে, তাই র্যান্ডম স্যাম্পলিংয়ের (দ্বৈবচয়ন) ভিত্তিতে সেই চালানগুলো পরীক্ষা করা উচিৎ। দু-একটা জাহাজ এভাবে কায়িক পরীক্ষা করলে যদি কোনও অনিয়ম না মেলে, তাহলে পরবর্তীকালে সেটি স্বাভাবিক করে দেওয়া উচিৎ। এতে করে যারা অভিযোগ বা আলোচনায় মেতেছেন তারা ‘অফ’ হয়ে যাবেন। এখন যদি সেটি না করা হয়, তাহলে প্রতিবারই দেখা যাবে, চালান আসার আগে মাতামাতি উঠবে।”