‘নিরাপত্তা’ ইস্যুতে ‘নিত্যপুরাণ’ নাটক মঞ্চায়নের মাঝপথে বন্ধ করে দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক।
নাটকপাড়ায় এই নিয়ে ক্ষোভ ও আন্দোলনের মুখে বুধবার আবারও মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। তবে এর পরপরই নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন সদ্য পূর্ণ সচিব মর্যাদা পাওয়া সৈয়দ জামিল আহমেদ।
এবার মাঝপথে নাটক বন্ধের প্রতিবাদে সোচ্চার নাট্যজন মামুনুর রশীদকে শিল্পকলায় সাময়িক সময়ের জন্য অভিনয় করতে নিষেধ করেছেন জামিল আহমেদ।
সকাল সন্ধ্যাকে খবরটির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন মামুনুর রশীদ। তিনি জানান, দুই-তিন দিন আগে ফোন করে তাকে এই অনুরোধ জানান সৈয়দ জামিল আহমেদ।
গুঞ্জন উঠেছিল ফেরদৌসী মজুমদারকেও একই কথা বলেছেন জামিল আহমেদ। তবে সকাল সন্ধ্যাকে তথ্যটি ভুল বলে জানিয়েছেন তার জীবনসঙ্গী নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। তিনি বলেন, “না, ফেরদৌসী এমন কোন ফোন পাননি। যে তথ্যটি ছড়াচ্ছে তা ঠিক নয়।”
নিজের প্রতিক্রিয়ায় মামুনুর রশীদ বলেন, “শিল্পকলার ডিজি সাহেব ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন, আমি যাতে শিল্পকলায় অভিনয় না করি। নিত্যপুরাণ বন্ধের প্রতিবাদ সভায় আমার ওপর হামলা হয়েছে। এর পরদিন আমাদের (আরণ্যক নাট্যদলের) একটি নাটকের শো ছিল। আমরা তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। তিনি আমাকে ফোন করে শিল্পকলায় ‘রাঢ়াঙ’-নাটকটির শো করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তাতে আমাকে অভিনয় করতে নিষেধ করেছেন।”
গণমাধ্যমে একই কথা বলেছেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক।
“আমি মামুনুর রশীদকে নিজে ফোন করে তাদের রাঢ়াঙ নাটকের শো করতে বলেছিলাম। এই নাটকটি করা দরকার। এই নাটকে উনি ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। তাঁকে অনুরোধ করেছি, সেই চরিত্র যদি অন্য কাউকে দিয়ে করানো যায়। কারণ, আপনি যেহেতু আন্দোলনের সময় রাজাকার নিয়ে কিছু বলেছিলেন, এটা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ, কষ্ট আছে। আপনি গেলে মানুষের সেই কষ্টটা বাড়বে। সেই জন্য আপনি ছাড়া যদি নাটকটির প্রদর্শনী সম্ভব হয়, এটা আপনি দেখেন।”
যদিও মামুনুর রশীদ বলছেন, আন্দোলনের পরও তিনি মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। এমনকি খোদ শিল্পকলাতেই অভিনয় করেছেন তিনি।
“আমি কিন্তু সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমিতে ‘ময়ূর সিংহাসন’ নাটকে অভিনয় করেছি; মহিলা সমিতির মঞ্চেও অভিনয় করেছি, তাতেও কোনো সমস্যা হয়নি। শিল্পকলা একাডেমির অসুবিধার জায়গাটা কোথায়?” সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন।
ক্ষোভ জানিয়ে মামুনুর রশীদ বলেন, “আমি কি অভিনয় করতে পারব না! আমার কোনো অপরাধ নেই, অথচ আমাকে অভিনয় করতে দেবে না। রাজাকার স্লোগান নিয়ে ২৪ জন বিশিষ্টজন বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেখানে আমার নাম ছিল। ওই বিবৃতিতে কী অপরাধ আছে?
“এখন তো বলা হচ্ছে, আপনারা কথা বলেন। সেই কথাই বলতে পারব না? এমন একটা সময় চলে এসেছে এই বাংলাদেশে, একটি মহল তো চাচ্ছেই শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতি বন্ধ হয়ে যাক। আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি, ‘রাঢ়াঙ’ আমরা করব না, ‘কম্পানি’ ও করব না। চলুক যত দিন এই ব্যবস্থা চলে।”
এদিকে মামুনুর রশীদকে অভিনয়ের এই বিরতি প্রস্তাব এ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকে।
চলচ্চিত্র পরিচালক আবু সাইয়ীদ ফেইসবুকে লিখেছেন, “জামিল আহমেদ বলেছেন, উনি মানে মামুনুর রশীদ ছোট্ট একটা রোল করেন। (দুবার বলেছেন) জামিল আহমেদ ঠিকই বলেছেন, মামুনুর রশীদের ছোট্ট একটা রোল করার দরকার কি? শুধু মামুনুর রশীদ কেন, নাটকে ছোট্ট রোল রাখারই দরকার কি?”
‘নিত্যপুরাণ’ নাটকের রচয়িতা ও নির্দেশক মাসুম রেজা লিখেছেন, “গত ২ নভেম্বর দেশ নাটকের ক্ষেত্রে যা ঘটেছিলো তা শিল্পকলার ডিজি তাঁর দুই একজন সহকর্মীকে নিয়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলেছিলেন; ছোট যুদ্ধে হেরেছি কিন্তু বড় যুদ্ধে হারবো না। বড় যুদ্ধটা কার সাথে? ছোট যুদ্ধটা তিনি কাদের সাথে হারলেন? তার কী কোনো খোঁজ খবর নিয়েছেন।
“আমার বিশ্বাস ছিলো তিনি সমস্ত বিষয়ে তদন্ত করে সকল থিয়েটার কর্মীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। শিল্পকলায় আমাদের অবাধ বিচরণ ও কাজের পরিসর সুপ্রশস্ত করবেন। কিন্তু তা না হয়ে শিল্পকলা মঞ্চে মামুন ভাইকে অভিনয় থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা আসলো। আমার মনে হয়, যতদিন আপনি সকল থিয়েটার কর্মীর নিরাপত্তা বিধান এবং নির্ভয়ে কাজ করার নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না ততদিন আপনি শিল্পকলায় থিয়েটার বন্ধ রাখুন..”
তবে বুধবার ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকের শোতে কোন বাড়তি নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়নি বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন তিনি।
নৃত্যশিল্পী পূজা সেনগুপ্ত মামুনুর রশীদ ইস্যুতে এ সংক্রান্ত খবর শেয়ার করে লিখেছেন, “এই রকম একটা কথা বলার আগে শিল্পকলার ডিজি পদত্যাগ করতে পারতেন।”
আইনজীবী ও লেখক ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেন, “শিল্পকলা একাডেমির কোন ক্ষমতা নাই কোন বিশেষ একজন বা একাধিক শিল্পীকে একাডেমিতে নিষিদ্ধ করা। অনুমান করি সেইজন্যে ডিজি সাব আনুষ্ঠানিক কোন আদেশ না দিয়ে মুখে মুখে নিষেধাজ্ঞাটা দিয়েছেন।
“কিন্তু বিষয়টা কেবল ডিজি সাবের ক্ষমতা থাকা না থাকা বা মামুনুর রশীদ ও ফেরদৌসি মজুমদারের অভিনয় করা বা না করার চেয়ে অনেক বড় ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ডিজি সাহেব যেটা করেছেন সেটা হচ্ছে খুবই খারাপ ধরণের বৈষম্য- ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি ডিসক্রিমিনেশন, এবং মানুষের লিবার্টি তথা ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশনে হস্তক্ষেপ করা এবং মানুষের যেসব মৌলিক অধিকার আমাদের দেশে স্বীকৃত, সেইসবের অনেকগুলি খর্ব করা।”
তিনি আরও বলেন, “শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন এমন মানুষ শিল্পকলা একাডেমীর মতো প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়াটাই বেমানানা। শিল্পকলার ডিজি হবেন শিল্পীর স্বাধীনতার পক্ষের লোক। আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে যে শিল্পীর স্বাধীনতার জন্যে তিনি শিল্পীর পাশে থাকবেন, আর তিনি কিনা উল্টো কিসব করছেন! এইটা ঠিক না। শিল্পীদের স্বাধীনতা যদি না থাকে তাইলে দেশকে স্বাধীন দেশ বলা যায় না।”
এ ইস্যুতে থিয়েটারকর্মী নজরুল সৈয়দের একটি দীর্ঘ পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। নাট্যাঙ্গনের অনেকেই তার লেখাটি শেয়ার করে প্রতিবাদে সামিল হচ্ছেন। তিনি লিখেছেন, “আশি আর নব্বই দশকে মুক্ত নাটক নিয়ে সারাদেশ আর স্বৈরাচার, জোতদার, ভূমিদস্যু, মহাজনদের কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন যে মানুষটা, তিনি মামুনুর রশীদ। মামুনুর রশীদের এই ‘মুক্ত নাটক’ চর্চাকে সৈয়দ জামিল আহমেদ নিজে উল্লেখ করেছেন বাংলা মঞ্চ নাটকের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর অন্যতম হিসেবে। সেই সৈয়দ জামিল আহমেদ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হয়ে মামুনুর রশীদকে নাটকে অভিনয় করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করছেন!”
প্রসঙ্গত, জুলাই গণ-আন্দোলনের পর দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষিতে গেল ৯ সেপ্টেম্বর শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন শিক্ষক ও নাট্যনির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদ। গত ২১ নভেম্বর ২০২৪ রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবুল হায়াত মো: রফিক স্বাক্ষরিত এ প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে প্রথমবারের মতো সরকারের সচিব পদমর্যাদায় নিয়োগ পান তিনি।