Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

জলবায়ু সম্মেলনে এবার চ্যালেঞ্জ কী

আজারবাইজানের বাকুতে সোমবার জাতিসংঘের বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলনে অ্যাকটিভিস্টরা জলবায়ু ন্যায়বিচার এবং গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। ছবি: এপি।
আজারবাইজানের বাকুতে সোমবার জাতিসংঘের বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলনে অ্যাকটিভিস্টরা জলবায়ু ন্যায়বিচার এবং গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। ছবি: এপি।
[publishpress_authors_box]

আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে চলছে জাতিসংঘের বার্ষিক জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন। বিশ্বের হাজার হাজার প্রতিনিধি জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলার বিষয়ে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে আলোচনার জন্য দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলের দেশটিতে একত্রিত হয়েছেন।

কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ফের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ায় এবারের জলবায়ু সম্মেলন ঘিরে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কারণ তিনি দ্বিতীয়বারের মতো ঐতিহাসিক প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

কার্বন নিঃসরন শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া কার্বন নিঃসরন কমানোর প্রতিশ্রুতিতেও তিনি কাটছাঁট করতে পারেন।

বিশ্বজুড়ে সবুজ জ্বালানি এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন কর্মসূচি বাস্তবায়নে কীভাবে অর্থায়ন করা যায়- সে বিষয়েও দেশগুলো একমত হতে ব্যর্থ হয়েছে।

কপ-২৯ কোথায়, কখন হচ্ছে

১১ থেকে ২২ নভেম্বর আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কপ-২৯ অনুষ্ঠিত হবে।

আজারবাইজানের অর্থনীতি প্রধানত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। এমন একটি দেশে এবারের জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজন করায় গ্রেটা থুনবার্গসহ জলবায়ু কর্মীদের সমালোচনার মুখে পড়েছে জাতিসংঘ। গ্রেটা সাম্প্রতিক এক বক্তৃতায় এবারের জলবায়ু সম্মেলনকে ‘গ্রিনওয়াশ সম্মেলন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

কপ (COP) মানে কী

কপ (COP) হলো কনফারেন্স অব দ্যা পার্টিস টু দ্যা কনভেনশন এর সংক্ষিপ্ত রুপ, যা জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনকে (UNFCCC)— ১৯৯২ সালে গৃহীত একটি বহুপাক্ষিক চুক্তিকে বোঝায়।

জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (UNFCCC) ১৯৯৪ সালে কার্যকর হয়। এটি কিয়োটো প্রোটোকল (১৯৯৭) এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তির (২০১৫) মতো যুগান্তকারী চুক্তির ভিত্তি। এর লক্ষ্য ২১০০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্পযুগের গড় তাপমাত্রার উপরে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা।

১৯৯৫ সালে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে প্রথম কপ শীর্ষ সম্মেলন হয়।

কারা অংশগ্রহণ করবে

এবছর ৩২ হাজারেরও বেশি মানুষ কপ-২৯ এ যোগ দেওয়ার জন্য নিবন্ধিত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৮টি দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিরাও অন্তর্ভুক্ত, যারা কনভেনশনটি অনুমোদন করেছেন।

২০২১ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর এবারই তালেবানরা প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দেবেন।

কূটনীতিক, সাংবাদিক, জলবায়ু বিজ্ঞানী, এনজিও, অ্যাক্টিভিস্ট এবং আদিবাসী নেতারাও এতে যোগ দেবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন আন্তর্জাতিক জলবায়ু নীতি বিষয়ে প্রেসিডেন্টের জেষ্ঠ্য উপদেষ্টা জন পোডেস্তার নেতৃত্বে ২০টিরও বেশি বিভাগ, সংস্থা ও সংস্থার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধি দল পাঠাবে।

বাইডেন প্রশাসনের প্রতিনিধি দল আলোচনায় অংশ নিলেও কোনও স্পষ্ট আর্থিক প্রতিশ্রুতি দিতে পারবে না। কারণ ট্রাম্প জানুয়ারি থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিতে চলেছেন।

আজারবাইজানের বাকুতে জাতিসংঘের ২৯তম জলবায়ু সম্মেলন স্থলের প্রবেশ পথ।

এজেন্ডায় কী আছে

কপ-২৯কে ‘ফাইনান্স সিওপি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ এটি গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে সহায়তার জন্য তহবিল বাড়াতে চায়।

জাতিসংঘ সমর্থিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধ করতে হলে চীন ছাড়া উদীয়মান দেশগুলোর জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ২ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন।

কিন্তু বিলটি কে উত্থাপন করবে- তা নিয়ে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে।

যুক্তরাজ্য ও মিশরের এক বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, ধনী দেশ, বিনিয়োগকারী এবং বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলো থেকে অন্তত ১ ট্রিলিয়ন ডলার আসা উচিত। বাকি প্রায় ১.৪ ট্রিলিয়ন অভন্তরীণভাবে ব্যক্তিগত এবং সরকারি উৎস থেকে আসতে হবে।

২০০৯ সালে ধনী দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়নে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, যা তারা দুই বছর দেরিতে অর্জন করেছে।

বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো এখন প্রতি বছর কমপক্ষে ১ ট্রিলিয়ন ডলার করে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।

দাতারা বিশ্বের বৃহত্তম বার্ষিক গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনকারী চীন এবং প্রধান জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো যেসব দেশ এখনও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গণ্য তাদেরও তহবিলে অবদান রাখার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।

সব অংশগ্রহণকারী দেশ থেকে জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানের (এনডিসি) বিষয়ে চুক্তির বিষয়টি এবারের আলোচ্যসূচিতে শীর্ষে থাকবে।

এনডিসি হলো একটি দেশের জাতীয় জলবায়ু কর্মপরিকল্পনা, যা প্যারিস চুক্তিতে নির্ধারিত লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করে।

এনডিসিগুলো অবশ্যই প্রতি পাঁচ বছরে হালনাগাদ করতে হয়। ২০২৫ সালের প্রথম দিকে পরবর্তী রাউন্ডকে সামনে রেখে এ বছরের সম্মেলনে প্রতিটি সদস্যের লক্ষ্য চূড়ান্ত করার উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

১১ নভেম্বর, ২০২৪-এ বাকুতে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু ন্যায়বিচার এবং গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য একজন অ্যাকটিভিস্ট বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

গত সম্মেলনের পর অগ্রগতি কী

গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত কপ-২৮ এ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়ে একটি বৈশ্বিক সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল।

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল। কারণ এতে প্রথমবারের মতো খোলাখুলিভাবে দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়ে।

তবে চুক্তিটি বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা জানা যায়নি।

২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরন শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষমতা তিনগুণ এবং বৈশ্বিক জ্বালানি সাশ্রয় দক্ষতা দ্বিগুণ বাড়ানোর জন্য ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এপ্রিলে ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) কপ-২৮ এ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পরিমাপের জন্য একটি ট্র্যাকার স্থাপন করেছে।

কপ-২৮ এর কেন্দ্রীয় অঙ্গীকার এই বছরের আলোচ্যসূচিতে নেই কেন- এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও কারণের কথা বলা হয়নি।

তবে জীবাশ্ম জ্বালানি কমানোর ওপর ফোকাস করা কঠিন হতে পারে। কারণ আজারবাইজানের অর্থনীতির প্রায় অর্ধেক তেল এবং গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। আর দেশটির রপ্তানি আয়ের ৯০ শতাংশও আসে তেল-গ্যাস থেকে।

একটি পরামর্শক গ্রুপ গোপনে আজারবাইজানের ডেপুটি জ্বালানি মন্ত্রী এবং কপ-২৯ এর সিইও এলনুর সোলতানভের কথোপকথন রেকর্ড করেছে। সেখানে তাদেরকে সম্মেলনের আগে নতুন জীবাশ্ম জ্বালানি চুক্তির বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিতে দেখা যায়।

এতে এবারের জলবায়ু সম্মেলনকে ঘিরে সম্ভাব্য স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

বিশ্বের ১৭ শতাংশ মানুষের বাসস্থান হওয়া সত্ত্বেও আফ্রিকা বিশ্বের মাত্র ৩.৪ শতাংশ কার্বন নিঃসরন করে।

ট্রাম্পের নির্বাচন কীভাবে সম্মেলনের এজেন্ডাকে প্রভাবিত করবে

ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় এ বছরের শীর্ষ সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে সরাসরি কোনও পরিবর্তন আসবে না। তবে জানুয়ারিতে তার দায়িত্ব গ্রহণের পর এবারের সম্মেলনে গৃহীত যেকোনও চুক্তি বাস্তবায়ন প্রভাবিত হতে পারে।

ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে (২০২৭-২০২১) প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়েছিলেন। তার উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২১ সালে ফের প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

চীনের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনকারী হলো যুক্তরাষ্ট্র। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যদি আবারও প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে কপ-২৯ এ নির্ধারণ করা লক্ষ্যগুলো অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে।

গত বছর যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদিন গড়ে ১২.৯ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করেছে, যা ২০১৯ সালের বৈশ্বিক রেকর্ড ভঙ্গ করে।

ট্রাম্প প্রতিষ্ঠিত জলবায়ু বিজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জলবায়ু সঙ্কটকে ভুয়া এবং ব্যয়বহুল প্রতারণা বলেও উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি এও বলেছে, চরম আবহাওয়ার ঘটনা বাড়িয়ে তোলার জন্য জলবায়ুর উষ্ণায়ন দায়ী নয়। ট্রাম্প যত বেশি সম্ভব জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বাড়ানোর ঘোষণাও দিয়েছেন।

২০২৪ সালে জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে বিশ্বকে প্রভাবিত করে

ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস জানিয়েছে, বিজ্ঞানীরা ‘কার্যত নিশ্চিত’ যে ২০২৪ সাল ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ বছর। বছরটিতে চরম আবহাওয়ার ঘটনা ঘটেছে প্রচুর।

এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানীরা সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে হারিকেন হেলেনের তাণ্ডবের উল্লেখ করেছেন, যাতে ২৩০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। ২০০৫ সালে হারিকেন ক্যাটরিনার পর এটি যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানা সবচেয়ে মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়।

তথ্যসূত্র : আল জাজিরা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত