ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে দেশছাড়া শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচার নিয়ে একটি আদেশ এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে।
সেই আদেশে তার বিদ্বেষমূলক এবং তদন্ত বাধাগ্রস্ত করে, এমন বক্তব্য সংবাদমাধ্যম কিংবা সোশাল মিডিয়ায় প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
তার এমন যে সব বক্তব্য সংবাদমাধ্যমসহ সোশাল মিডিয়ায় রয়েছে, তাও সরিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে বলে আইনজীবী জানিয়েছেন।
প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম সাংবাদিকদের বলেন, “শেখ হাসিনার কোনও বক্তব্য, যা বিদ্বেষমূলক এবং তদন্ত কাজে বাধা হতে পারে, তা প্রকাশে নিষেধাজ্ঞার আদেশ হয়েছে।
“এ ধরনের যেসব বক্তব্য যে মাধ্যমেই রয়েছে, তা রিমুভ করতেও সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশনাও দিয়েছেন আদালত।”
গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সেখান থেকে তার নানা বক্তব্য-বিবৃতি দলের ফেইসবুক পাতায় দেওয়া হচ্ছে, যা সংবাদমাধ্যমেও আসছে।
যে আন্দোলনে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন, সেই আন্দোলন দমনে জুলাই-আগস্টে তার সরকার যে দমন-পীড়ন চালিয়েছিল, তখন সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন। দেশ দশক বাদে অভ্যুত্থানে তার ক্ষমতাচ্যুতির পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে এই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে।
পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রশিকিউশন দল শেখ হাসিনার বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করে।
বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজার নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে সেই আবেদনে শুনানি নিয়ে আদেশ দেয়।
আদালতে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম, প্রসিকিউটর বি এম সুলতান মাহমুদ ও আবদুল্লাহ আল নোমান।
এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করতে ট্রাইব্যুনাল নির্দেশ দিয়েছে বলে জানান প্রসিকিউটর তামিম। এই আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সচিব, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সচিব ও বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে।
এছাড়া আদালতের লিখিত আদেশটি সোস্যাল মিডিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ট্রাইব্যুনাল থেকে পৌঁছে দেওয়া হবে বলে জানান প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে যুক্তরাজ্যে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সব ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারে হাই কোর্ট নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। গত আগস্টে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সেই নিষেধাজ্ঞা আদালতই তুলে নেয়।
বিদেশে থেকে শেখ হাসিনার বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া নিয়ে সম্প্রতি ড. ইউনূস বলেছিলেন, “তার (শেখ হাসিনা) ভারতে থাকাটা এই মুহূর্তে কোনও সমস্যা নয়। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলাটা সমস্যার।
“তিনি বাংলাদেশের বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলছেন এবং তা রাজনৈতিক বিষয়ে। তিনি ক্রমাগতভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছেন, সেটাই সমস্যার।”
কোন বক্তব্য বিদ্বেষমূলক?
রাজনৈতিক নেতা হিসাবে শেখ হাসিনার কোন বক্তব্য বিদ্বেষমূলক এবং কোনটি সাধারণ ধরা হবে, প্রসিকিউটরদের কাছে তা জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা।
জবাবে প্রসিকিউটর তামিম বলেন, “আমরা ট্রাইব্যুনালকে বলেছি যে, মরক্কোর রাবাত শহরে জাতিসংঘের অধীনে একটি কনভেনশন হয়েছিল। সেখানে এ বিষয়ে ছয়টি পয়েন্টের (প্রিন্সিপল) কথা বলা হয়েছিল যে, কোন স্পিচকে হেট স্পিচ বলা হবে এবং কোন স্পিচ সাধারণ স্পিচ বলা হবে। এই ছয়টি পয়েন্টের প্রত্যেকটি কাভার করে উনার (শেখ হাসিনা) যেসব বক্তব্য সম্প্রতি দিয়েছেন, সোশাল মিডিয়াতে রয়েছে।
“এর বাইরে উনার সাধারণ বক্তব্য প্রচার করতে কোনও বাধা নেই।”
বিদ্বেষমূলক বক্তব্য শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বে একটি দণ্ডনীয় অপরাধ উল্লেখ করে এই আইনজীবী বলেন, “এ ধরনের হেট স্পিচ প্রকাশ বন্ধ করার জন্য এবং ইতোপূর্বে যেসব হেট স্পিচ সোশাল মিডিয়া এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে রয়েছে, সেগুলো রিমুভ করার জন্য আবেদন করেছিলান, আবেদনটি ট্রাইব্যুনাল শুনে মঞ্জুর করেছেন।”
শেখ হাসিনার সাধারণ বক্তব্য প্রকাশে কোনও বাধা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা স্পেসিফিক্যালি বলেছি, শুধু বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, এবং এমন বক্তব্য যা ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কাজকে বাধাগ্রস্ত করে, এই দুই ধরনের বক্তব্যের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সাধারণ বক্তব্য দেওয়ার অধিকার সবারই আছে।”
প্রসিকিউশনের আবেদনের বিষয়ে প্রসিকিউটর তামিম বলেন, “এই ট্রাইব্যুনালে তদন্ত সংস্থা এবং প্রসিকিউশনের যেসব মামলা তদন্তাধীন আছে, সেই তদন্ত চলাকালীন কোনও আসামি এমন কোনও ‘হেট স্পিচ’ (বিদ্বেষমূলক) বা অন্য তেমন কোনও স্পিচ দিতে পারবেন না, যাতে করে এ মামলার তদন্তে বাধাগ্রস্ত হয়, সাক্ষী বা অথবা ভুক্তভোগীরা ভীতিগ্রস্ত হয়।”
সম্প্রতি শেখ হাসিনার কিছু বক্তব্য ও ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে উল্লেখ করে তিনি ট্রাইব্যুনালকে বলেন, “উনি (শেখ হাসিনা) যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে আমরা দেখছি বলছেন- ২২৭টি মামলা করা হয়েছে। ২২১ জনকে মার্ডার করার স্বীকৃতি ও লাইসেন্স পেয়েছি!’ বলেছেন- তোমাদের বাড়িঘর পোড়াচ্ছে, তাদের কি বাড়িঘর নেই?”
এ ধরনের বক্তব্য মামলার ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের ওপর এক ধরনের হুমকি বলে মনে করেন এই প্রসিকিউটর।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “যেসব সাক্ষীরা আমাদের কাছে বক্তব্য দিয়েছেন, তাদেরকে কিন্তু ট্রাইব্যুনালে এসে বিচারকের সামনে সাক্ষি দিতে হয়। এ ধরনের বক্তব্য যদি পাবলিশড হয়, তাহলে আমরা ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী আনতে পারব না, তারা ভীতি হবে। তদন্তকারী কর্মকর্তারাও সাক্ষীদের বাড়ি গিয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ করতে বাধাগ্রস্ত হবেন।”
জুলাই-আগস্ট গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত ১৭ অক্টোবর দুই মামলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।
পরে ১৮ নভেম্বর একই মামলায় আওয়ামী লীগের সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। তারা হলেন– সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, ফারুক খান, দীপু মনি, শাজাহান খান, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার ও জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলম।
এছাড়া এ মামলায় গত বুধবার আওয়ামী লীগের দুই নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আমির হোসন আমু ও কামরুল ইসলামকেও গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।