দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে এসে চোখ রাঙাতে শুরু করেছে নভেল করোনাভাইরাস। কেবল বাংলাদেশেই নয় বিশ্বব্যাপী বাড়তে শুরু করেছে সংক্রমণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে সতর্ক বার্তা প্রকাশ করেছে। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরী পরামর্শক কমিটিও স্বাস্থ্যবিধি মানতে আহ্বান জানিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতেও নির্বাচন সংক্রান্ত কোনও জনসমাগম বা কর্মসূচিতে স্বাস্থ্যবিধি মানতে নির্দেশনা দেয়নি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনও উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।
এর আগে ২০২০ সালের অক্টোবরে ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচন ঘিরে স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত যেসব তৎপরতা চোখে পড়েছিল, এবার তার কিছুই দেখা যায়নি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনিতেই দেশ সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। নির্বাচনের সময়ে স্বাস্থ্যবিধির বালাই না থাকায় সংক্রমন আরও বাড়বে। কমিশনের অবশ্যই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল।
দেশে নতুন করে কোভিড সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে গত বছরের শেষদিকে। শুরুতে দৈনিক শনাক্তের হার এক শতাংশের নিচে থাকলেও এখন সেটা সাড়ে চার শতাংশ ছাড়িয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে সংক্রমণের হার বেড়েছে ৫২ শতাংশ, সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যু হারও। এই উর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে কোভিডের অতিসংক্রমণশীল ধরন ওমিক্রণের উপধরন জেএন.১ এর কথা বলা হচ্ছে।
নতুন বছরের প্রথমদিন দেশে শনাক্তের হার দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। সবশেষ ৫ জানুয়ারির যে হিসাব পাওয়া গেছে সেখানে শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।
সংক্রমণের হার বাড়তে থাকায় ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। গত ২ জানুয়ারি বৈঠকে বসে সবশেষ পরিস্থিতি, জেএন.১ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক পরামর্শ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। বৈঠক থেকে মাস্কসহ স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত বেশকিছু পরামর্শ দেওয়া হয়।
এসব পরামর্শ যখন দেওয়া হয়, তখন দেশে বইছে ভোটের হাওয়া। প্রচার-মিছিল-সমাবেশে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন দ্বাদশ ভোটের প্রার্থী-সমর্থকরা। কিন্তু কোথাও স্বাস্থ্যবিধি বা মাস্ক বিষয়ক সচেতনতা দেখা যায়নি। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও ছিল না কোনো নির্দেশনা।
কারিগরি পরামর্শক কমিটির দেওয়া সুপারিশ মেনে ইসি কোনও নির্দেশনা দেয়নি বলে জানান এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, গত কয়েকদিন ধরেই তো মিছিল-মিটিং হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে এসব হবেই, রোধ করা যাবে না। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল সুপারিশ আমলে নিয়ে গণসচেতনতার উদ্যোগ নেওয়া।
“তবে এখনও সময় আছে, তারা কেন্দ্রগুলোয় স্বাস্থ্যবিধি মানার মতো ব্যবস্থা নিতে পারে এবং সেটাকে কঠোরভাবে মনিটরিং করতে পারে।”
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “এখনও দেশে এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত কেউ শনাক্ত হয়নি। তবে সেটা আসতে সময় লাগবে না। এমন পরিস্থিতিতে সময়ে বয়স্ক, গর্ভবতী, শিশু এবং কো-মরবিড (যারা আগে থেকেই অন্য রোগে আক্রান্ত) মানুষদের জন্য বিশেষ সতর্কতা নেওয়া উচিত।”
ভোট কেন্দ্রগুলোর প্রবেশপথে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সতর্ক থাকা ভীষণ প্রয়োজন উল্লেখ করে এই চিকিৎসক বলেন, “সেখানে দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে যখন ভোট গণনা হয়, তখন সেখানেও ভীড় হয়। এসব জায়গায় নজর দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।”
সেইসঙ্গে কেন্দ্রে ঢোকার মুখে আগের মতো হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখতেও পরামর্শ দেন তিনি।
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “আমি অনুরোধ করবো, নির্বাচন কমিশন যেন স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে উদ্যোগী হয়। নয়তো আমরা অনুমানের চাইতেও বিপদে পড়তে যাচ্ছি।”
স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে ইসি কোনও পদক্ষেপ না নেওয়ায় কিছুটা উষ্মাই প্রকাশ করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিন্ময় দাস।
তিনি বলেন, “কোভিড বাড়ছে, জাতীয় কমিটি কিছু সুপারিশও দিয়েছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও নির্বাচন কমিশনের।”
বিশেষ করে কমিশন যদি সচেতনতা বাড়ানো এবং সংক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচার করত, স্বাস্থ্যবিধি মানতে আহ্বান জানাত-তাহলে সেটা দেশের জন্যই ভালো হতো বলে মনে করেন তিনি। বলেন, “নয়তো সামনে বিপদ হতে পারে।”
সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে এখনও জেএন.১ উপধরনে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়নি। কিন্তু পাশের দেশ ভারতেই এই উপধরনে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে যেকোনো সময় এই ধরন শনাক্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন এই ধরনকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ এর তালিকায় স্থান দিয়েছে।
জাতীয় কারিগরী পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা শঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, দেশে এখনও জেএন.১ আক্রান্ত রোগী না পাওয়া গেলেও যে কোনও সময় পাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে এটা আসবে না, এমন কথা ভেবে বসে থাকলে চলবে না।
জাতীয় পরামর্শক কমিটি দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে বৈশ্বিক রিপোর্ট পর্যালোচনা ও দেশে সার্ভিলেন্স জোরদার করার জন্য আইইডিসিআরের প্রতি পরামর্শ দিয়েছে। ভবিষ্যতে সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে কোভিড পরীক্ষা ও আইসিইউসহ দ্রুত চিকিৎসার সব প্রস্তুতি রাখাসহ বেশকিছু সুপারিশও করেছে।