কোভিড মহামারির লকডাউনের সময়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের শরীরে গবেষকরা এমন অবাক করা পরিবর্তন দেখেছেন, যা তাদের বাঁচাতে পারে রোগ ও অ্যালার্জি থেকে। এছাড়া অসুস্থতার চিকিৎসায় এসব শিশুর অ্যান্টিবায়োটিকও লাগে কম।
চিকিৎসাবিষয়ক জার্নাল ‘অ্যালার্জি’তে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
সেই গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ডেইলি মেইল জানিয়েছে, আয়ারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজ কর্কের একদল গবেষক দেখেছেন, কোভিড মহামারির লকডাউনের সময় জন্ম নেওয়া শিশুদের অন্ত্রে থাকা মাইক্রোবায়োম পরিবর্তন এসেছে।
মাইক্রোবায়োম হচ্ছে মানুষের অন্ত্রে থাকা ‘ভালো’ ও ‘খারাপ’ ব্যাকটেরিয়ার সমন্বয়ে গঠিত একটি বাস্তুতন্ত্র, যা খাবার হজম করতে সহায়তার পাশাপাশি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ধ্বংস করে দেয় এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, মহামারির সময়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের অন্ত্রে যে মাইক্রোবায়োম পাওয়া গেছে, তা তাদের জন্য আরও বেশি উপকারী।
গবেষকরা দেখেছেন, এই পরিবর্তনের কারণে মহামারি শুরুর আগে জন্ম নেওয়া শিশুদের তুলনায় ‘কভিড শিশুদের’ (মহামারির সময়ে জন্ম নেওয়া শিশু) অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হওয়ার (যেমন খাবারের অ্যালার্জি) হার প্রত্যাশিত হারের চেয়ে কম।
এই গবেষণার অংশ হিসেবে ২০২০ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত, অর্থাৎ মহামারির প্রথম তিন মাসে জন্ম নেওয়া ৩৫১ জন আইরিশ শিশুর মলের নমুনা বিশ্লেষণ করে মহামারির আগে জন্ম নেওয়া শিশুদের মলের নমুনার সঙ্গে তুলনা করা হয়। এক্ষেত্রে ৬, ১২ ও ২৪ মাস বয়সে শিশুদের মলের নমুনা সংগ্রহ করে অ্যালার্জি পরীক্ষা করা হয়।
গবেষণার জন্য শিশুদের শারীরিক অবস্থায় ভূমিকা রাখা বিভিন্ন বিষয় যেমন, তাদের খাবার, ঘরের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য অনলাইনে জরিপ করা হয়।
গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, কভিড শিশুরা তাদের মায়ের কাছ থেকে অনেক বেশি উপকারী ‘মাইক্রোব’ পেয়েছে, যা অ্যালার্জিজনিত রোগের বিরুদ্ধে তাদের জন্য সুরক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।
সাধারণত কারও অন্ত্রে থাকা মাইক্রোবায়োমের ভারসাম্য ব্যাহত হলে তার খাবারে অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, মহামারির সময়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুদের অ্যালার্জিতে আক্রান্তের হার কম। কোভিড শিশুদের প্রায় পাঁচ শতাংশ খাবারের অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হয়, যেখানে মহামারির আগে জন্ম নেওয়া শিশুদের ২২ দশমিক ৪ শতাংশকে এই ধরনের অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হতে দেখা গেছে।
গবেষকরা বলেন, কভিড শিশুরা মায়ের গর্ভে থাকার সময় মায়ের কাছ থেকে উপকারী মাইক্রোব পাওয়ার পাশাপাশি জন্মের পর পরিবেশ থেকেও বাড়তি মাইক্রোব পেয়েছে।
এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, লকডাউনের সময় জন্ম নেওয়া শিশুদের বিভিন্ন সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার হারও কম, কারণ অতিরিক্ত সতর্কতার মাঝে থাকায় তারা জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া সংস্পর্শে সেভাবে আসেনি।
এর অর্থ হচ্ছে, ব্যাকটেরিয়াজনিত অসুস্থতা দূর করতে তাদের কম অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হয়েছে, যা শুধু খারাপ ব্যাকটেরিয়ায় নয়, ভালো ব্যাকটেরিয়াও ধ্বংস করে দেয়। এতে তাদের মাইক্রোবায়োমও হয়েছে ভারসাম্যপূর্ণ।
এছাড়া লকডাউনের কারণে শিশুরা তুলনামূলকভাবে লম্বা সময় ধরে মায়ের বুকের দুধ খেতে পেরেছে, যা তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করতে ভূমিকার রেখেছে।
গবেষকরা দেখেছেন, কভিড শিশুদের মধ্যে মাত্র ১৭ শতাংশের এক বছর বয়সের মধ্যে শারীরিক অসুস্থতায় অ্যান্টিবায়োটিক লেগেছে। যেখানে মহামারির আগে জন্ম নেওয়া শিশুদের ৮০ শতাংশকেই ১২ মাস বয়সের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক নিতে হয়েছে।
গবেষক দলের সদস্য ইউনিভার্সিটি কলেজ কর্কের ইমিউনোলজির অধ্যাপক লিয়াম ও’ম্যাহনি তাদের গবেষণার ফলাফলকে ‘চমকপ্রদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
দলটির আরেক সদস্য চিলড্রেনস হেলথ আয়ারল্যান্ড টেম্পল স্ট্রিটের শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জোনাথন হোরিহেইন বলেন, “এই গবেষণা অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম বিষয়ে মানুষের জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকার প্রভাব সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে।”
গবেষকরা জানিয়েছেন, অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমে প্রাথমিক পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কেমন তা দেখার জন্য তারা গবেষণায় অংশ নেওয়া কভিড শিশুদের আবারও পরীক্ষা করতে চান, যখন তাদের বয়স পাঁচ বছর হবে।