সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে কক্সবাজারের সৈকতে তৈরি করা হয়েছে দানব আকৃতির একটি বিশাল ভাস্কর্য। সামুদ্রিক প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে তৈরি ভাস্কর্যটি গড়ে তোলা হয়েছে সৈকতের সুগন্ধা ও সীগাল পয়েন্টে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নির্মিত এই ভাস্কর্যটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘প্লাস্টিক দানব’ হিসেবে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে প্রতিদিনই লাখো পর্যটকের সমাগম হয়। তারা সৈকতের বালিয়াড়ি ও সাগরের পানিতে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলেন। এতে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ, যা হুমকি তৈরি করছে সামুদ্রিক প্রাণ ও মানবজীবনের জন্য।
মূলত প্রাণ-প্রকৃতির ওপর প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহ ক্ষতির বিষয়টি ফুটিয়ে তুলতেই দানবাকৃতির ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়েছে। সমুদ্র উপকূল থেকে সংগ্রহ করা প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে একদল স্বেচ্ছাসেবী এই ভাস্কর্য তৈরি করেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বুধবার সকালে ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, “প্লাস্টিক বর্জ্য দানবের মতোই সমুদ্র ও জনজীবন ধ্বংস করছে। ক্রমাগত বাড়তে থাকা এই ভয়াবহতা দ্রুত রুখে দিতে হবে। সেই সচেতনতা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই দানবীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনীর এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে মানুষ প্লাস্টিক ব্যবহারে আরও সতর্ক হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহম্মদ নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, “এই উদ্যোগে স্থানীয় জনগণ এবং পর্যটকরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। তারা সমুদ্র সৈকতে প্লাস্টিক না ফেলে এক্সচেঞ্জ স্টোরে জমা করছেন, যা প্লাস্টিক দূষণ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।”
প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের নীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন সারাদেশ থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে ৫০০ মেট্রিক টন পরিত্যক্ত প্লাস্টিক রিসাইকেল বা পুনঃউৎপাদন করে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের পরিচালনা কমিটির সদস্য জামাল উদ্দিন।
তিনি বলেন, “এতে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সরকারি খরচ যেমন কমবে, তেমনি মানুষও জানতে পারবে কীভাবে রিসাইকেল করার মাধ্যমে বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর করা যায়।”
৪ মাস ব্যাপী প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ কার্যক্রমে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে সহযোগিতা করবে বিদ্যানন্দ। ভাস্কর্য তৈরির পাশাপাশি এ সময়ে নেওয়া হবে আরও কিছু উদ্যোগ।
জামাল উদ্দিন বলেন, সৈকতের সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে প্লাস্টিক এক্সচেঞ্জ সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে প্লাস্টিক বর্জ্য জমা দিয়ে স্থানীয়রা নিত্যপণ্য এবং পর্যটকরা পাচ্ছেন নানা উপহার সামগ্রী।
প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে ভাস্কর্যটি নির্মাণে গত ৭ নভেম্বর থেকে কাজ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ৮ জন শিল্পী এবং ২০ জন স্বেচ্ছাসেবক। মঙ্গলবার রাতে তারা ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ শেষ করেন। এতে সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছে পপ-ফাইভ এডভারটাইজিং লিমিটেড।
ভাস্কর্য নির্মাণ শিল্পীদের দলনেতা আবীর কর্মকার বলেন, এতে প্লাস্টিক বর্জ্যের পাশাপাশি কাঠ, পেরেক ও আঠাসহ আরও কয়েকটি উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে।”
শিল্পীদের দাবি, সমুদ্র থেকে সংগৃহীত প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে তৈরি বিশ্বের বৃহত্তম রোবট দানবের ভাস্কর্য। এর উচ্চতা ৬২ ফুট, যা বানাতে প্রায় ১০ মেট্রিক টন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়েছে। বিশাল আকৃতির ভাস্কর্যটির পাশে রয়েছে ১৫ ফুট উচ্চতার ছোট আকৃতির আরও দুটি ভাস্কর্য।
প্রায় এক মাস ধরে কক্সবাজার, ইনানী ও টেকনাফের সেন্ট মার্টিন সমুদ্র সৈকত থেকে ভাস্কর্যটির জন্য প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয় বলে জানান বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক মুহাম্মদ মুবারক।
তিনি বলেন, পুরো পর্যটন মৌসুমজুড়ে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এ ভাস্কর্য। একে কেন্দ্র করে এখানে প্লাস্টিক দূষণবিরোধী সচেতনতামূলক পথনাটক ও সংগীতানুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হবে।
গত ৭ নভেম্বর থেকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের জন্য ‘প্লাস্টিক এক্সচেঞ্জ স্টোর’ ও স্থানীয়দের জন্য ‘প্লাস্টিক এক্সচেঞ্জ মার্কেট’ চালু করা হয়। এই স্টোরে প্লাস্টিক বর্জ্য জমা দিয়ে পর্যটকরা পাচ্ছেন বই, কলম, ক্যাপ ও ব্যাগসহ বিভিন্ন উপহার। আর স্থানীয়রা নিতে পারছেন চাল, ডাল, তেল, চিনি ও লবণসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। এই কর্মসূচি থেকেই মূলত ১০ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়।
বুধবার প্লাস্টিক বর্জ্যে নির্মিত দানবটির উদ্বোধন দেখতে ভিড় করেন সৈকতে ঘুরতে আসা পর্যটকরা।
এই দানব দেখে মানুষ প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন হবে বলে মনে করেন ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে আসা পর্যটক শরীফুল ইসলাম। তার ধারণা এতে মানুষ তারা প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারেও সতর্ক হবে।
বিদ্যানন্দের মতো অন্যান্য সংগঠন এবং সংস্থাগুলোকে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে এগিয়ে আসার আহবান জানান এই পর্যটক।
এর আগে ২০২২ সালে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সমুদ্র সৈকতে প্রথমবার একটি প্লাস্টিক দানব ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। সেবার দানবের উচ্চতা ছিল ৪২ ফুট।