বৃষ্টি কিছুটা কমায় কক্সবাজার শহর থেকে পানি নেমে গেলেও বেড়েছে প্লাবিত এলাকার সংখ্যা। এখনও জেলা সদরসহ ৬ উপজেলার অন্তত ২ শতাধিক গ্রাম পানিবন্দি থাকার তথ্য মিলেছে।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ৮টি ফিশিং ট্রলারসহ অন্তত ৭০ জেলে নিখোঁজের তথ্য জানিয়েছেন মালিকরা।
ট্রলার ডুবির ঘটনায় শনিবার কক্সবাজারে উখিয়ার ইনানী সৈকতে ভেসে আসা ৫ জেলের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বৃষ্টি কমলেও পানিবন্দি অনেক এলাকা
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ আব্দুল হান্নান জানিয়েছেন, শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২১০ মিলিমিটার। বৃষ্টি কিছুটা কমলেও ভারি বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৫০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা কক্সবাজারের ইতিহাসের সর্বোচ্চ বৃষ্টি। এর আগে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ৪৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছিল।
বৃষ্টি কমায় কক্সবাজার শহরের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কলাতলীর হোটেল মোটেল এলাকার সব সড়ক, সৈকত সংলগ্ন এলাকা, মাকের্ট এলাকা থেকে পানি নেমে গেছে।
শহরের প্রধান সড়কের বাজারঘাটা, বড়বাজার, মাছবাজার, এন্ডারসন সড়ক, টেকপাড়া, পেশকারপাড়া, বার্মিজ মার্কেট এলাকা, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, গোলদিঘিরপাড়, তারাবনিয়াছড়া, রুমালিয়ারছড়া, বাাঁচা মিয়ার ঘোনা, পাহাড়তলী এলাকা থেকেও পানি নেমে গেছে।
তবে শহরের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, নুনিয়াছড়াসহ ৮টি নিম্নাঞ্চল এখনও পানিবন্দি রয়েছে।
কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, নুনিয়াছড়া এলাকাটি নিম্নাঞ্চল। সমুদ্র কূলের এসব এলাকার ১০ হাজার ঘরবাড়ি এখনও পানিবন্দি।
কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, বৃষ্টি কমে যাওয়ায় হোটেল মোটেল জোন এখন পানি নেমে গেছে। তবে বৃষ্টি হলেই এখন আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যেই জলাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে। নালা উন্নত করা না হলে এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
উখিয়া উপজেলা ৪০টির বেশি গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি থাকার তথ্য জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। উখিয়ার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হলদিয়াপালং ও জালিয়া পালং ইউনিয়ন।
এই দুই ইউনিয়নের ৩০টি গ্রামের ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ দুই দিন ধরে পানিবন্দি রয়েছে। ঘরে পানি ঢুকে পড়ায় রান্না হচ্ছে না অধিকাংশ ঘরে।
জালিয়া পালং ইউনিয়নের লম্বরীপাড়া, ঘাটঘর পাড়া পাইন্যাশিয়া, সোনাইছড়ি, সোনারপাড়া ডেইপাড়া মনখালি, হলদিয়া পালং ইউনিয়নের চৌধুরী পাড়া, মনির মার্কেট, রুমখা পালং, বড়বিল, পাতাবাড়ি, নলবুনিয়া, খেওয়া ছড়ি, বৌ বাজার, কুলাল পাড়া, পাগলির বিল, রাজা পালং ইউনিয়নের কুতুপালং, মাছকারিয়া, লম্বাশিয়া তুতুরবিল, পিনজির কুল, রত্না পালং ইউনিয়নের সাদৃ কাটা, পশ্চিম রত্না, খোন্দকার পাড়া, গয়াল মারা ও পালংখালী ইউনিয়নে থাইংখালী, রহমতের বিল, বালুখালী তৈল খোলা, আঞ্জুমান পাড়া ফারিবিলসহ অন্তত ৪০টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।
উখিয়া উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী বলেন, বন্যায় উপজেলার ৫ ইউনিয়নে অনেক এলাকার মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। জালিয়া পালং ও হলদিয়াপালং ইউনিয়নের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
হলদিয়াপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, দুই মাসের ব্যবধানে ৪ দফা বন্যায় তার ইউনিয়নের ২০টির বেশি গ্রামের মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার তানভির হোসেন বলেন, বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের জন্য জেলা থেকে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমেও সহযোগিতার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বৃষ্টিতে চকরিয়া-পেকুয়ার বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। মাতামুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।
চকরিয়া উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বরইতলী, বিএমচর, কোনাখালী ও বদরখালী ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অন্তত ২০ হাজার লোক পানিবন্দি রয়েছে। এছাড়া ধান ক্ষেত ও বিভিন্ন সবজির ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে।
মানকিপুর-সুরাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক বলেন, মানিকপুর এলাকায় বৃষ্টিতে নিচু এলাকার অন্তত দুই শতাধিক ঘরবাড়ি বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দাদের সরে যেতে বলা হয়েছে।
বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ছালেকুজ্জামন বলেন, “আমার ইউনিয়নের পহরচাঁদা, গোবিন্দপুর ও ডেইঙ্গাকাটা এলাকায় অধিকাংশ ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তাদের নিরাপত্তা ও শুষ্ক খাবার বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
পেকুয়ার ৭ ইউনিয়নের মধ্যে পেকুয়া সদর ইউনিয়নের মেহেরনামা, রাজাখালী, উজানটিয়া ও মগনামা ইউনিয়নের ১০টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের এলাকার খোঁজ-খবর রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে ও নদীর তীর এলাকায় অবস্থানরত লোকজনকে নিরাপদে সরে যেতে উপজেলার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় উপজেলা প্রশাসন সহায়তা করতে সবসময় প্রস্তুত।
পেকুয়ার শিলখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কামাল হোসেন বলেন, তিন দিনের টানা বৃষ্টির কারণে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কিছু বসতঘর ও দোকান-পাটে পানি ঢুকেছে।
৫ জেলের মরদেহ উদ্ধার
বঙ্গোপসাগরে ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে ট্রলার ডুবির ঘটনায় কক্সবাজারে উখিয়ার ইনানী সৈকতে ভেসে আসা পাঁচ জেলের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইনানী সমুদ্র সৈকতে দুই জেলের মরদেহ ভেসে আসে বলে জানান ইনানী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক রেজাউল করিম।
তাদের মধ্যে আব্দুল করিম নামের এক জেলের পরিচয় পাওয়া গেলেও অপরজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
তিনি জানান, আব্দুল করিম (৩৫) চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। তিনি বাঁশখালীর বাসিন্দা আবুল বশরের মালিকানাধীন এফবি আব্দুল ছামাদ সাহা নামের ট্রলারের জেলে ছিলেন।
এর আগে শনিবার সকালে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী পয়েন্ট, সমিতি পাড়া পয়েন্ট এবং রামু উপজেলার পেঁচারদ্বীপ পয়েন্টে ভেসে আসা ৩ জেলের মরদেহ উদ্ধার হয়।
সকালে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কবলে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ৮টি ফিশিং ট্রলার নিখোঁজ থাকার তথ্য জানান কক্সবাজার জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরে নিখোঁজ থাকা এসব ট্রলার ডুবে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কিছু জেলে সাঁতার কেটে উপকূলে ফিরেছে। উদ্ধার হয়েছে ৩ জনের মরদেহও। ফলে এসব ট্রলারের আরও অন্তত ৭০ জেলে নিখোঁজ রয়েছে।
এর মধ্যে শনিবার সকালে কক্সবাজার সৈকতের নাজিরারটেক, পেঁচারদ্বীপ ও কলাতলী উপকূলে ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা।
এর মধ্যে দুই জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এরা হলেন, বাঁশখালী উপজেলার শেখেরকিল এলাকার নুরুল আমিন (৪০) ও লোহাগাড়া উপজেলার চরমবা এলাকার মোহাম্মদ জালাল (৩৭)।
অপর একজনের পরিচয় পাওয়া না গেলে মরদেহ ৩টি কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে রয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. আশেকুর রহমান।