সৈকতের পর্যটন নগরী কক্সবাজার এখন বৃষ্টি হলেই হয়ে ওঠে দুর্ভোগের জনপদ। যেখানে আগে কখনও দেখা যায়নি জলাবদ্ধতা, এখন তা তো হচ্ছেই, পাহাড় ধসের ঘটনাও বেড়েছে। ফলে বৃষ্টি হলেই উৎকণ্ঠা বাড়ে শহরবাসীর।
গত বৃহস্পতিবার ভোর থেকে ২৪ ঘণ্টায় ৩০৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে কক্সবাজার জেলাজুড়েই দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। শহরের প্রধান সড়ক, উপসড়ক তলিয়ে বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রিকশা গ্যারেজে ঢুকে পড়ে পানি।
শনিবারও বিভিন্ন সড়কে পানি ছিল। পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, বিমানবন্দরের পশ্চিম-উত্তরে এই ওয়ার্ডটি ঘিরে সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, বাসিন্যাপাড়া, ফদনারডেইল, নাজিরারটেকসহ কয়েকটি গ্রাম তলিয়ে আছে। শুধু এক নম্বর ওয়ার্ডের কয়েকটি এলাকার ৬ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
পৌরসভার ৬, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়তলী, বৈদ্যঘোনা, ঘোনারপাড়া, বাদশাঘোনা, খাজা মঞ্জিল, লাইটহাউস, কলাতলী, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, লারপাড়াসহ কয়েকটি এলাকায় অন্তত ২০টি উপসড়কে পানির নিচে।
শহরের প্রধান সড়কের বাজারঘাটা, এবিসি রোড, এন্ডারসন সড়ক, টেকপাড়া, বার্মিজ মার্কেট এলাকা, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, গোলদিঘিরপাড়, তারাবনিয়াছড়া, বড়বাজার, সিভিল সার্জন কার্যালয়, কক্সবাজার সরকারি কলেজ, রুমালিয়ারছড়া, কলাতলী হোটেল মোটেল জোন, সৈকতের লাবণী ও সুগন্ধা পয়েন্ট সড়ক ও তার আশে পাশের এলাকার বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল শুক্রবার।
কলাতলী সড়ক থেকে সমুদ্রসৈকতে নামার সুগন্ধা সড়কটিও ডুবে আছে। সড়কে হাতে গোনা কয়েকটি মিনিবাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করলেও অলিগলিতে ঢুকতে পারছে না।
জলাবদ্ধতা কেন
সাগর পাড়ের শহর কক্সবাজারে এমন জলাবদ্ধতা আগে না দেখার কথা বলেন কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন।
তিনি বলেন, “শহরের প্রধান সড়ক উঁচু করা হয়েছে। অথচ হোটেল-মোটেল জোনে হাঁটু পরিমাণ পানি। এটা কেউ কল্পনাই করেনি।”
জলাবদ্ধতার জন্য সৈকতের পাশের নালাগুলো আবর্জনায় ভরতি হয়ে যাওয়াকে কারণ দেখান কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মো. মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী।
তিনি বলেন, “সৈকতের পাশের নালা আবর্জনায় ভর্তি থাকায় পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল ও বৃষ্টির পানি সাগরে নেমে যেতে না পেরে সড়কে উপচে পড়ছে।”
জলাবদ্ধতার জন্য অপরিকল্পিত উন্নয়নকেও দায়ী করে মেয়র বলেন, “অতীতে কিছু কিছু উন্নয়নকাজ হয়েছে, তা পরিকল্পিতভাবে হয়নি।”
চলতি মৌসুমে এর আগেও ভারি বর্ষণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছিল। তারপর বুধবার নালা পরিষ্কারের কাজ শুরু করেছিল পৌর কর্তৃপক্ষ।
মেয়র বলেন, কিন্তু ভারি বর্ষণ শুরু হওয়ায় তা আর এগিয়ে নেওয়া সম্ভবপর হয়নি। তবে বৃষ্টি থামলে নালা পরিষ্কার করা হবে।
নালাগুলো অপরিকল্পিত হওয়ার কারণে জলাবদ্ধতা এখন প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি করেন হেলাল উদ্দিন।
তিনি বলেন, মোটেল শৈবালের সামনে বড় নালাটা ভরাট করে ফেলা হয়েছে।
কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম বলেন, “শহরের ড্রেনগুলো একেবারে সঙ্কুচিত। কোথাও ১০ মিটার, কোথাও ৭ মিটার আবার কোথাও ৫ মিটার।
“আবার এসব ড্রেনে ফেলা হয় পলিথিন থেকে শুরু করে সকল ময়লা-আবর্জনা। একইভাবে কউক (কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) কর্তৃক প্রধান সড়কের ড্রেন নির্মাণ কালের অনেক নির্মাণ সামগ্রীও রেখে দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে পানি সরতে পারছে না।”
দুর্ভোগে মানুষ, কী করছে কর্তৃপক্ষ
শনিবার বৃষ্টি না থাকায় ধীরে ধীরে পানি নামতে শুরু করলেও জনদুর্ভোগের অবসান হয়নি। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, সহায়তা না করে ছবি তুলে দায় সারছেন অনেক জনপ্রতিনিধি।
শনিবার দুপুরে পূর্ব-মধ্যম কুতুবদিয়াপাড়ার বাসিন্দা ছলিমা খাতুন পানি নামতে দেখে মাটি দিয়ে বসতঘর উঁচু করছিলেন। তখনও কোনও খাওয়া-দাওয়া হয়নি তার। ওই এলাকায় কামাল হোসেন নামে আরেকজনও ঘর ঠিক করছিলেন।
রহিমা বেগম নামে একজন বলেন, “রান্নার চুলা পানিতে ভেসে গেছে। গত দুই দিন রান্না হয়নি। কিছু শুকনো খাবার কিনে এনে দিনযাপন করছি।”
ইজিবাইক চালক মো. হুমায়ুন দুশ্চিন্তায় ছিলেন তার গাড়িটি নিয়ে। কারণ পানিতে ডুবে তার গাড়ির মোটর নষ্ট হয়ে পড়েছে। “আয়ের একমাত্র পথ বন্ধ, কী করব কিছুই ভাবতে পারছি না,” বলেন তিনি।
ওই এলাকার মো. আনিছ কুতুবী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছি। অনেকের ঘরের রান্নার চুলাও ভেসে গেছে বা নষ্ট হয়ে গেছে। কাউন্সিলররা দেখতে এসেছিল। সেলফি-ছবি তুলে চলে গেছে। কোনও সহায়তা করছে না।”
রাবেয়া বেগম নামে এক নারী বলেন, “আমরা দুর্ভোগে আছি, কিন্তু কাউন্সিলর কোনও খবর নিল না। শুধু কাউন্সিলরের স্ত্রী এসে পরিস্থিতি দেখে গেছে। আমাদের কষ্টে দেখি সবাই ছবি তুলতে আসে, কিন্তু সহযোগিতা করতে নয়।”
কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা রহমান সকাল সন্ধ্যাকে জানান, বৃষ্টির কারণে ঝিলংজা, খুরুশকুল, ভারুয়াখালী, পিএমখালীতে বন্যার পানি প্রবেশ করে আশেপাশের এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ঝিলংজা ঘুরে এসেছেন তিনি। স্থানীয় চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের নিয়ে বন্যার্তদের সহযোগিতা করছেন।
বিভিন্ন উপজেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে কক্সবাজার জেলা ৭১ ইউনিয়ন ও ৪ পৌরসভার মধ্যে ৩৫ ইউনিয়নে বন্যা হয়েছে। যেখানে গ্রামের সংখ্যা ২ শতাধিক। যেখানে প্রায় ৩৫ হাজার পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
কক্সবাজার জেলা ত্রাণ ও পূনর্বাসন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, বন্যায় তাৎক্ষণিকভাবে সহায়তার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৮০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডে পাহাড় ধসে নিহত ৩ জনের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।
সামনে জলাবদ্ধতা যেন না হয়, সেজন্য কারণগুলো চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান মেয়র মাহাবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, নালা, খাল দখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রবিবার থেকে অভিযানে নামবে পৌরসভা।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের চাল, টিন ও নগদ অর্থ দেওয়া হবে।
শনিবার পৌরসভার কাউন্সিলর ও কর্মকর্তাদের নিয়ে সভা করেন মেয়র। সেখানে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের সমন্বয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। ভবিষ্যতে সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয়হীন কোনও উন্নয়নকাজ করতে দেওয়া হবে না।
ভরাট হয়ে যাওয়া নালা-নর্দমা উদ্ধারে অভিযান রবিববার থেকে শুরু হবে জানিয়ে তিনি বলেন, দখলদারেরা যতই প্রভাবশালী হোক না, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
পাহাড় ধসও বাড়ছে
গত তিন সপ্তাহে কক্সবাজারে পৃথক পাহাড় ধসের ঘটনায় ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক দিনে ১০ জনের মৃত্যু হয়।
গত বৃহস্পতিবার পাহাড় ধসে মারা গেছে তিনজন। এছাড়াও সেদিন কক্সবাজারের ১৫টি স্থানে পাহাড় ধস ঘটে।এর মধ্যে কলাতলী, আদর্শগ্রাম, লারপাড়া, দরিয়ানগর, হিমছড়ি এলাকায় পাহাড় ধসলেও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. শফীকুল ইসলাম এবিষয়ে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বনভুমি উজার, জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিতভাবে সড়ক নির্মাণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে গড়ে তোলার কারণে কক্সবাজার জেলার মাটির গঠন বিন্যাসের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। তার ওপর যোগ হয়েছে নির্বিচার পাহাড় কাটা।
“এসব কারণে পাহাড়গুলো শুকনো ও ঝরঝরে হয়ে উঠছে। যার কারণে বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টির চাপে পাহাড়ের ওপরের অংশের শক্ত মাটির স্তর বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে ফাটল তৈরি হচ্ছে। ফলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে ওজনে বৃদ্ধি পাওয়া মাটি ভারসাম্য রাখতে না পেরে পাহাড় বিরাট খণ্ড ও অংশ বিশেষ আকারে ধসে পড়ে।”
ভূমি ধস ঠেকাতে পাহাড় কাটা বন্ধে অভিযান চালানোর কথা বলেছেন মেয়র মাহবুবুর রহমান।