যেখানে ১৩ একর জায়গায় ছিল বৌদ্ধ বিহার, সেখানে এখন বিহারের নাম-নিশানাও নেই। বিহারের ১৯টি বুদ্ধ মূর্তির মধ্যে ছোট্ট একটি ঘরে শুধু দুটি মূর্তির অংশ বিশেষ রয়েছে।
গত ১৪ বছরে এভাবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কক্সবাজারে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের বড় ক্যাং (বৌদ্ধ বিহার)। বেদখল হওয়া বিহারে এখন কোনও আচার-অনুষ্ঠানসহ হয় না।
দলিল-পত্র ঘেঁটে দেখা যায়, কয়েকশ বছর পুরনো এই বিহারে এক সময় ১৯টি বুদ্ধ মূর্তি ছিল। এখন একটি টিনের ঘরে দুটি মূর্তি থাকার পাশাপাশি বিহারের ২ একর পাহাড়ি জমি কেবল রয়েছে।
বেদখল ১১ একর জমিতে দখলদাররা ঘর-বাড়ি তুলেছে, খামারও রয়েছে। বিহারের কাজে এক সময় ব্যবহৃত পুকুরটিও এখন অন্যের দখলে, সেখানে চলছে মাছ চাষ।
বিহারের জমিতে ২০০৯ সালের পর তৎকালীন সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী (বর্তমানে প্রয়াত) একটি খামার ঘরের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হ্নীলা কলেজ নামের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে কলেজটি বন্ধ হয়ে গেলেও ওখানে এখনও নাফ এগ্রো ফার্ম নামের প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে। কলেজের স্থাপনার কয়েকটি ঘর এখনও রয়েছে। সেগুলোও খামারের কাজে ব্যবহার হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
নানা উদ্যোগ, নানা পদক্ষেপ ও প্রশাসনের তৎপরতায়ও বড় ক্যাং রক্ষা করা যায়নি। গত ১৪ বছর ধরে বিহার পরিচালনা কমিটি এবং বিহার রক্ষা কমিটির পক্ষে মিছিল, মানববন্ধন, বিবৃতি থেকে শুরু করে নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। ঢাকাসহ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা একাধিকবার পরিদর্শনে গেছেন ঘটনাস্থলে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
কীভাবে বিহারটি দখল হলো, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ২০১১ সালে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার একটি প্রতিবেদনে। ওই সময়কার ইউএনও আ ন ম নাজিম উদ্দিন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে সেই প্রতিবেদন দিয়েছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিহারটির পুরোহিত উপিঞ ওয়াংশ মহাথেরো ২০০১ সালে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে একটি চুক্তি করেন। সেই চুক্তিপত্রে বিহারের ২ একর জমিতে গাছ রোপণ করে লাভের অংশ ভাগাভাগি করার কথা ছিল।
একইভাবে ২০০৯ সালে বিহারের পুরোহিত উ কুশল্যা মহাথেরোর সঙ্গেও মোহাম্মদ আলী বিহারের অন্যান্য জমিতে গাছ রোপণের জন্য আরও একটি চুক্তি করেন।
এরপর ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট বিহারটিতে মুখোশধারী কিছু ব্যক্তি হানা দেন। তারা বিহারের পুরোহিতকে হুমকি দিলে তিনি পালিয়ে যান। ওই দিন বিহারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মালামালও লুট হয়।
ইউএনওর প্রতিবেদনে বলা হয়, পুরোহিত পালিয়ে যাওয়ার পর আর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী কেউ বিহারমুখো হয়নি।
মূলত সেদিনের পর থেকে বিহারটি দখল বা নিশ্চিহ্ন হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
২০১০ সালের ২৮ আগস্ট থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রশাসনের একাধিক দপ্তরের লিখিত অভিযোগের পরও আইনগত কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি; যদিও প্রতিবেদনটিতে ডাকাতিতে জড়িত ১৬ জনের নাম উল্লেখের পাশাপাশি দখলদারদের উচ্ছেদ করে বিহার কর্তৃপক্ষকে জায়গা বুঝিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল।
২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর টেকনাফের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবদুল্লাহ আল মামুন আরেকটি প্রতিবেদন ধরে ৩১ দখলদারের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ মামলা দায়ের করেছিলেন। সেই মামলায় দখলদারদের উচ্ছেদের আদেশও এসেছিল।
মামলায় ৩১ দখলদারের নাম উল্লেখ ছিল। তারা হলেন- টেকনাফের হ্নীলার ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী, ওসমান গনি, রহিমা খাতুন, আবদুস ছালাম, জহুরা খাতুন, হাসিনা খাতুন, নুরুল ইসলাম, আবদুল ওয়ারেছ, পেটান আলী, জলিল আহমদ, মো. কায়সার, আবুল কালাম, মকবুল হোসেন, বাদশা মিয়া, হাবিবুর রহমান, ওসমান সওদাগর, আবদুল্লাহ, কফিল আহমদ, মো. হাছন, ছৈয়দ হোছন, নবী হোছন, সোনা মিয়া, হাবিবুর রহমান, আবু ছিদ্দিক, ইসমাইল মিস্ত্রি, আবদুল গফুর, রশিদ আহমদ, মো. এলাহাত, মো. আলমগীর, খাইলুল বশর, বেলাল উদ্দিন।
সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর ছেলে ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলীকে দখলদারদের নিয়ন্ত্রক হিসাবে দেখাচ্ছেন বৌদ্ধবিহার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব, আদিবাসী ফোরাম কক্সবাজার জেলা কমিটির সহসভাপতি ক্যা জ অং।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বর্তমানে বিহারের আশে-পাশে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন যেতেও ভয় পায়। সর্বশেষ উচ্ছেদ মামলার আদেশ মতে জায়গাটি উদ্ধারের জন্য গত ৩ মার্চ জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত আবেদনও জানানো হয়েছে। কিন্তু উদ্যোগ এখনও নেওয়া হয়নি।”
দখলের অভিযোগের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ২০০১ সালে তার বাবার সঙ্গে বিহারের পুরোহিতের একটি চুক্তি হয়। যার শর্ত ছিল, তার বাবা গাছ লাগাবেন এবং লাভের অংশ সমানভাবে ভাগাভাগি হবে।
“বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোক না চাইলে আমরা দখল ছেড়ে দেব। যে কেউ এসেই বিহারের খালি জায়গায় বিহারের কাজ পরিচালনা করতে পারেন। বিহার তৈরিতে আমি বারবার সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দিচ্ছি। আমরা যে গাছ লাগিয়েছি, তাও বিহারকে দিয়ে দেব। অন্যান্য দখলদারদের উচ্ছেদেও প্রশাসনকে সহযোগিতা করব।”
ক্যা জ অং বলেন, দখলদারের সংখ্যা ৩১ েথকে ক্রমাগত বেড়েছে। গত ১৪ বছর ধরে সরকারের একাধিক তদন্ত কমিটি জমির ধরন ও পরিমাণ চিহ্নিত, সীমানা নির্ধারণ, সুনির্দিষ্ট দখলদারদের তালিকা করে তাদের উচ্ছেদ করার সুপারিশ করে। তদন্তের আলোকে উচ্ছেদ করে বিহারের ভূমিটি পরিচালনা কমিটির কাছে হস্তান্তরে জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা থাকলেও সংশ্লিষ্টদের কোনও পদক্ষেপ ছিল না। ফলে এখন প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে পুরো জায়গা।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিভীষণ কান্তি দাশ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, বিহারের জায়গাটি দখলমুক্ত করার আবেদন তিনি পেয়েছেন। তবে রেকর্ড না দেখে এই বিষয়ে মন্তব্য করা সম্ভবপর হচ্ছে না।