কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার পূর্বে নাফ নদীর ওপারেই মিয়ানমার। এই উপজেলার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। সাগর আর নদীবেষ্টিত টেকনাফে কিছু দূর পরপর এক একটি ঘাট।
অভিযোগ উঠেছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় সরকার পরিবর্তনের সুযোগে এসব ঘাটের প্রতিটি এখন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের জন্য ব্যবহার হচ্ছে। কয়েকশ দালালের সহযোগিতায় গড়ে ওঠা চক্রটি বিজিবি-কোস্ট গার্ডের সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসছে জেলের বেশে। জনপ্রতি নেওয়া হচ্ছে ৫ লাখ কিয়াত (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৮,৪০০ টাকা)।
মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনার ক্ষেত্রে এই সীমান্ত পথটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত। স্থানীয়রা বলছেন, এতদিন যারা ইয়াবা পাচারে জড়িত ছিল, তারাই এখন রোহিঙ্গা পাচার করছে।
প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ চলছে বছর খানেক ধরে। কক্সবাজারের ওপারে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী বাহিনীর সংঘাতের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে।
সংঘাত থেকে বাঁচতে মুসলমান জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা আবার বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে ছুটছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এক মাসে কমপক্ষে ২০ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকেছে, এমন ধারণা পাওয়া যায় স্থানীয়দের কাছ থেকে।
১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভার বহন করে আসা বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন নতুন করে আর কোনও রোহিঙ্গাকে আসতে না দেওয়ার কথা বলেছেন। সীমান্তে বিজিবিও টহল জোরদার করেছে। কিন্তু রোহিঙ্গা আসা থামছে না।
টেকনাফের বিভিন্ন স্থান দিয়ে গত এক মাসে নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে সকাল সন্ধ্যা। তাতে জানা গেল, মূলত টেকনাফ ও উখিয়ার একটি চক্রের সঙ্গে মিয়ানমারের ওপারে যোগাযোগ রয়েছে। তার মাধ্যমেই আনা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের।
নতুন ঢোকা রোহিঙ্গাদের একটি অংশ আশ্রয় নিয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগে েথকে থাকা স্বজনদের বাড়িতে। সেখানে তাদের সঙ্গে কথা হয়। আরেকটি অংশের সঙ্গে কথা হয় টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া বাসায়।
মঙ্গলবার সকালে টেকনাফের আলীখালিতে অবস্থিত ২৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৫ নম্বর ব্লকে গিয়ে দেখা মেলে মোহাম্মদ হানিফ নামে এক রোহিঙ্গার। নিজেকে মিয়ানমারের মংডুর নলবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা বলে পরিচয় দেন তিনি। গত ৮ আগস্ট পরিবারের ৮ সদস্যকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন এ স্বজনের বাড়িতে।
তিনি বলেন, “মিয়ানমারের দুই পক্ষের সংঘাতে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছে। ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত, বোমা ও গুলিতে জীবন রক্ষায় রোহিঙ্গারা কেবল পালাচ্ছে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে দালালরা; যাদের মিয়ানমার ও কক্সবাজারে নিয়মিত যাতায়াত আছে।
“দালাল চক্রের সদস্যরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলাপ করে টাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর টেকনাফ থেকে নৌকা বা ট্রলারে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসছে।”
হানিফ জানান, তার পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকের জন্য বাংলাদেশি ২৮ হাজার টাকা দেওয়া হয়। তারপর তারা তাদের একটি নৌকায় তুলে বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে হাবির ছড়া ঘাটে নামিয়ে দেয়। সেখানে নেমে আরেকটি চক্রকে জনপ্রতি ৩ হাজার টাকা দিলে তারা কয়েকবার গাড়ি বদলে তাদের ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়।
দালালদের কারও নাম বলতে পারেননি হানিফ। মিয়ানমারে যে যুবকের মাধ্যমে এই দালাল চক্রের দেখা পেয়েছেন, তার নাম হেলাল উদ্দিন।
হেলাল বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকলেও প্রায়ই মিয়ানমার-টেকনাফ আসা-যাওয়া করেন বলে জানান হানিফ। এই যাতায়াতের কারণ হিসাবে তিনি বলেন ইয়াবা কারবারের কথা।
ক্যাম্পে পাওয়া নতুন রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার গল্প ছিল প্রায় একই। ওই দালালদের টাকা দিয়ে টেকনাফের বিভিন্ন ভাড়া বাড়িতে থাকার সুযোগ পাচ্ছে এই রোহিঙ্গারা।
এসব দালাল কারা- এ প্রশ্নে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ সেলিম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শত শত দালাল। রাত হলেই এসব দালালের আনাগোনা বাড়ে সাগর উপকূল বা নাফ নদীর কিনারে। বিজিবির অবস্থান, অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল নজরদারি করে সঙ্কেত দিলেই নির্ধারিত ঘাটে ভেড়ানো হয় নৌকা।
“মিয়ানমারের সঙ্গে ইয়াবা কারবারে জড়িত ব্যক্তি, সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারকারী দালালরা এখন এসব করছে। নৌকা আনা-নেওয়ার কাজ ঘরে বসেই নিয়ন্ত্রণ করে দালালদের প্রধান বা গডফাদার। মাঠের নজরদারি, জেলে সেজে আনায় জড়িতরা পাচ্ছে কমিশন।”
টেকনাফের বাসিন্দারা বলছে, মূলত জেলে সেজে মাছ ধারার ইঞ্জিনচালিত নৌকায় আনা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন মাধ্যমে ৩০টি পয়েন্টের কথা বলা হলেও এ সংখ্যা অন্তত ৫৫টি বলে ধারণা সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের।
এসব পয়েন্টের মধ্যে আছে টেকনাফের সাগর উপকূল শাপলাপুর, শীলখালি, চৌকিদার পাড়া, মারিশবনিয়া, হলবনিয়া, জাহাজপুরা, কচ্ছপিয়া,বাঘগোনা, নোয়াখালী পাড়া, রাজারছড়া, হাবিরছড়া, মিঠাপানির ছড়া, লম্বরি, লেঙ্গুরবিল, তুলাতুলি, মহেশখালীয়া পাড়া, মুন্ডারডেইল ঘাট, খুরেরমূখ, জিরোপয়েন্ট, শাহপরীরদ্বীপ পশ্চিম পাড়া, ডাঙ্গর পাড়া, নাফনদীর মিস্ত্রি পাড়া, গোলা পাড়া, শাহপরীরদ্বীপ জালিয়া পাড়া, নয়াপাড়া-ঝিনা পাড়া, টেকনাফ সদরের নাজির পাড়া, মৌলভী পাড়া, ট্রানজিট, বরইতলী, কেরুনতলী, হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া ১৪নং ব্রীজ, দমদমিয়া কেয়ারী ঘাট, দমদমিয়া হাজীর খাল,ন্যাচার পার্ক, দমদমিয়া ওমরখাল, জাদিমুড়া, জাইল্যা ঘাট, মুচনি ঘাট, হ্নীলা চৌধুরীপাড়া, হ্নীলা জালিয়া পাড়া, উয়াব্রাং, মৌলভীবাজার, হোয়াইক্যং খারাংখালী, নয়াবাজার, মিনাবাজার, ঝিমংখালী, কাঞ্জরপাড়া, উনছিপ্রাং, লম্বাবিল, বালুখালী, কেরুনতলী ও উলুবনিয়া ঘাট।
টেকনাফের ৮ জন জনপ্রতিনিধিসহ ২৫ জনের সঙ্গে কথা বলে দালালদের শনাক্ত করার চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি। তাদের কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি।
‘শত শত দালাল, কাদের নাম বলব,” পাল্টা প্রশ্ন করেন তাদের একজন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দালাল চক্রের কয়েকজন সদস্য জানিয়েছেন, কোন ঘাটে নৌকা আসছে, এটা বড় বিষয় না। সব ঘাটেই মিলেমিশে এই কাজটি করা হচ্ছে।
আগে থেকেই ইয়াবা বা মানবপাচারে জড়িত এসব চক্র। তবে ঘাটভিত্তিক নিয়ন্ত্রক ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির। যেখানে জড়িত জনপ্রতিনিধিসহ প্রভাবশালীরাও। এদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া গেছে, তারাও ঘুরেফিরে মানব ও ইয়াবা পাচার মামলার আসামি।
টেকনাফের সাগর উপকূলের ঘাটগুলো বদি আলম, হেলাল উদ্দিন, রহিম বাদশা, মো. বলি, নুর মোহাম্মদ, মোহাম্মদ সালমান, শামসুল আলম, মো. জাবেদ, ইমান হোসেন ইউচুপ, মো. ইউনুছ, মো. সিরাজ, আজিজ উল্লাহ, জাফর আলম, মো. জিয়াবুল, মো. শফিক, মুহাম্মদ মান্নান, করিম উল্লাহ, নজির আহমেদ, মো. শফিক, মো. ফারুক, মো. জয়নাল, নুর হোসেন, মো. সাদ্দাম নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে জানা গেছে।
নাফ নদী এলাকার ঘাট নিয়ন্ত্রণকারী হিসাবে যাদের নাম এসেছে, তাদের মধ্যে আছেন মো. মিজান, মো. নজির, শফিউল্লাহ, আককাজ ও নুর হাকিম।
ঘাট দিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ভাড়া বাড়ি বা ক্যাম্পে পৌঁছানোর কাজে জড়িত চক্রে তিন যুবকের নাম শোনা যাচ্ছে। তারা হলেন- জালাল হোসেন, খোরশেদ আলম ও ইয়াসিন।
টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেন, “এটা সত্য যে আমার এলাকাসহ বিভিন্ন গ্রামে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা অবস্থান করছে। অনেকে ভাড়া বাসায় থাকছে। দালালরা তাদের সহযোগিতা করছে।
“এসব বিষয়ে আমি আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে একাধিকবার অবহিত করেছি। এরপরও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমরা স্থানীয় বাসিন্দারা অনিরাপদ আছি। কেননা ওপার থেকে অনেক অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী পালিয়ে আসার খবর পেয়েছি। এখনই ব্যবস্থা না নিলে সামনে আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।”
সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধে তৎপরতা বাড়ানোর কথা বিজিবি বলে এলেও অরক্ষিত সীমান্তে তা ঠেকানো যে কঠিন, সেই কথাও বলছেন এই বাহিনীর কর্মকর্তারা।
বিজিবির একটি সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে জড়িত দালালদের শনাক্ত করতে কাজ শুরু করেছে তারা। ৫৭ জনকে চিহ্নিতও করা হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকজনকে আটকও করা হচ্ছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আদনান চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “টেকনাফ শহরসহ রোহিঙ্গারা বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। বিষয়টি নিয়ে অতি দ্রুত যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে। পাশাপাশি সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের জনবল বাড়াতে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি।”
নির্যাতন থেকে বাঁচতে রাখাইন থেকে পালিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ইতিহাস অর্ধ শতকের। তবে ২০১৭ সালে এক বারেই আসে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা।
সব মিলিয়ে এখন ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে। এদের বেশির ভাগ রয়েছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে। কয়েক হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে নোয়াখালীর ভাসানচরে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবসানে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের চুক্তি হলেও তা তো আলোর মুখ দেখেইনি, বরং মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের কারণে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়েছে।