Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫
Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫

ঢাকার বহুতল ভবনগুলোতে রেস্টুরেন্ট কেন ঝুঁকিপূর্ণ

গ্রিন কোজি
কয়েক ঘণ্টা আগেও এখানে ছিল আলো ঝলমলে রাত, এখন কেবল শূন্যতা। ছবি : হারুন অর রশীদ
[publishpress_authors_box]

ঢাকার সাত মসজিদ রোড, মালিবাগ, খিলক্ষেত, বনানী ১১ নম্বর রোড। এসব জায়গায় গেলে বহুতল ভবনজুড়ে রেস্টুরেন্টের সমাহার চোখে পড়বে না, এমনটা হওয়া কঠিন। তবে ভবনগুলো রেস্টুরেন্ট ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ‍্যে তৈরি হয়নি।

এভাবে বহুতল ভবনে রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তা বুঝিয়ে দিল বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ অগ্নিকাণ্ড। সেখানে বৃহস্পতিবার রাতে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সাততলা এই ভবনের অধিকাংশ তলাজুড়ে ছিল বিভিন্ন খাবারের দোকান।

এ প্রসঙ্গে স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশের মত জানতে চেয়েছিল সকাল সন্ধ‍্যা। জবাবে রেস্টুরেন্ট আর অফিস ভবনের নকশা যে এক হতে পারে না, সেটাই বললেন তিনি।

তিনি বলেন, “একটি ভবনের নকশা করা হয় তার ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে। কোনও ভবন অফিসের জন্য তৈরি করে রেস্টুরেন্টের জন্য ভাড়া দেওয়া হলে, সাধারণ মানুষ তো এতকিছু বোঝে না যে বিপদ হলে কী হতে পরে। তারা নামি-দামি রেস্টুরেন্ট দেখে সেখানে যায়।”

ধানমণ্ডি সাত মসজিদ রোডে স্থপতি পলাশের নকশা করা এক ভবনে গড়ে উঠেছে অনেক খাবারের দোকান। যা ঝুঁকিপূর্ণ বলে হুঁশিয়ার করে আসছেন তিনি।

রেস্টুরেন্টে চুলা ও সিলিন্ডারের ব্যবহার থাকায় বহুতল ভবনে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার জন্য স্পেস বা জায়গা ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্নিনিরাপত্তা যথাযথভাবে নিশ্চিত করার উপর জোর দিচ্ছেন এই স্থপতি।

আগুন লাগার আগে এই খাবারের দোকানগুলো ছিল গ্রিন কোজি কটেজ শপিং মলে।

বেইলি রোডের ওই ভবনের দ্বিতীয় তলাজুড়ে ছিল ব্যস্ত রেস্তোরাঁ কাচ্চি ভাই। তৃতীয় তলায় ছিল পোশাকের দোকান ইলিয়েন।

চতুর্থ তলায় ছিল আরেকটি রেস্তোরাঁ খানা’স। এর ওপরের তলাগুলোতে ছিল পিজ্জা ইন, জেস্টি, স্ট্রিট ওভেন ও অ্যামব্রোসিয়ার মতো খাবারের দোকান।

বাংলাদেশ রেস্তোঁরা মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান জানিয়েছেন, কোজি কটেজের রেস্টুরেন্টগুলি তাদের সমিতির সদস‍্য নয়।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সমিতির পক্ষ থেকে আমরা সব সময় সব ধরনের নিরাপত্তা মেনে ব্যবসা করা কথা বলে আসছি। কিন্তু অনেক রেস্টুরেন্ট মালিক এসব নিয়ম-কানুনের কোনো তোয়াক্কা করে না।’

সরকার পাইপলাইনে গ্যাস সংযোগ না দেওয়ায় রেস্টুরেন্টগুলোতে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার বাড়ার কথাও বলেন ইমরান।

রান্নাঘর, ধোঁয়া, আগুন

রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরে খোলা আগুন, গরম রান্নার সরঞ্জাম ও দাহ‍্য পদার্থ থাকে, যা অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়ায়। একই কারণে একটি বহুতল ভবনে রান্নাঘরে লাগা সামান্য আগুনও দ্রুত বেড়ে যেতে পারে। 

বহুতল ভবনে ধোঁয়া ও আগুন ভেন্টিলেশন সিস্টেম, সিঁড়ি ও লিফট শ্যাফটের মাধ্যমে অন‍্যান‍্য তলায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে যায় এবং ভবনের বিভিন্ন তলায় অবস্থান করা মানুষ ঝুঁকিতে পড়ে যায়।

ধোঁয়া থেকে শ্বাস রোধ ও দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হওয়ার ঝুঁকি হয়, ফলে মানুষের পক্ষে ভবন থেকে বেরিয়ে আসা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

উদ্ধারে সমস‍্যা

আগুন লাগলে বহুতল ভবনের উপরের তলা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া সবসময়ই একটি চ্যালেঞ্জ। 

বহুতল ভবনে সিঁড়ির সংখ্যা কম হতে পারে এবং অগ্নিকাণ্ডের সময় লিফট ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যেতে পারে। ফলে মানুষের বেরিয়ে আসার পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, বাড়তে পারে হতাহতের সংখ্যা।

বহুতল ভবনের মধ্যে রেস্টুরেন্ট চালু করার জন্য গ্যাস লাইন, বায়ুচলাচল ব্যবস্থা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে। এ ধরনের পরিবর্তন ভবনের কাঠামোগত ক্ষতি করতে পারে।

সিঁড়িতে গ‍্যাস সিলিন্ডার

ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বহুতল ভবনে একাধিক রেস্টুরেন্ট চলতে থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে স্থপতি খালিদ বলেন, “রেস্টুরেন্টগুলোতে গ্যাসের সিলিন্ডারের ব্যবহার হয়। এই সিলিন্ডার একেকটি বোমার সমান। তাছাড়া আমরা ভবনের লিফটের বিষয়েও তেমন সচেতন নই। আগুন লাগলে লোকজন কীভাবে বের হবে, এর সবকিছু সঠিকভাবে মানতে হবে।”

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন অগ্নিকাণ্ডস্থলে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন তারা। মাত্র একটি সিঁড়ি ও ভবনের একটি ছাড়া প্রায় প্রতিটি ফ্লোরে খাবারের দোকান থাকায় গ্যাস সিলিন্ডারগুলো রাখা ছিল অপরিকল্পিতভাবে।

বেইলি রোডের পাশেই শান্তিনগরে বসবাস করেন ব্যাংক কর্মকর্তা নাজমুল আলম। ওই ভবনের রেস্টুরেন্টে তিনিও মাঝেমধ্যে বাহারি খাবার খেতে যেতেন। গত বৃহস্পতিবারও তার ইচ্ছা ছিল সেখানে যাওয়ার। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

তবে রাত পৌনে ১০টার দিকে ওই ভবনে আগুন লাগার ঘটনা শোনার পর একরকম মুষড়ে পড়েন। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি কয়েকবার সেখানকার রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছে। ওই ভবনে লিফট ও সিঁড়ি দুটোই ছিল। তবে রেস্টুরেন্টের অতিথি বা ভোক্তারা লিফট বেশি ব্যবহার করতো।”

সিঁড়িগুলো ‍কিছুটা অব্যবহৃত থাকতো জানিয়ে নাজমুল বলেন, “সেখানে গ্যাসের সিলিন্ডার রাখা থাকতে দেখেছি আমিও।”

একটি সিঁড়ি থাকলেও সেখানে জরুরি নির্গমনের জন্য আলাদা কোনও সিঁড়ি ছিল না বলে ভবনের দোকান মালিক ও কর্মীরা জানিয়েছেন।

সিলিন্ডার গ‍্যাসের বিপদ

এলপিজি অত্যন্ত দাহ‍্য হওয়ায় একটি ছোট লিকও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি তৈরি করে। 

এছাড়া এলপিজি সিলিন্ডারে গ‍্যাস থাকে চাপের মধ‍্যে, ফলে লিক তৈরি হওয়া বা যথাযথভাবে ব‍্যবস্থাপনা করা না হলে বিস্ফোরণের ঝুঁকি তৈরি হয়।

বহুতল ভবনে গ্যাস লিক দ্রুত শনাক্ত করাও কঠিন হতে পারে, বিশেষ করে লিকটি যদি হয় ছোট আকারের। গ্যাস লিক হওয়ার আগে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস জমেও যেতে পারে, যার ফলে একটি ভয়াবহ বিস্ফোরণের আশঙ্কা বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত