ভুল নীতিসহ নানা কারণে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় ও ভর্তুকি বাড়ছে বলে মনে করছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে দাম না বাড়িয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ (কেন্দ্র ভাড়া) সমন্বয়ের ওপরও গুরুত্বারোপ করেছে বেসরকারি নীতি-গবেষণা সংস্থাটি।
ঢাকার ধানমণ্ডিতে ‘সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি : ভর্তুকি সমন্বয়ের অন্য বিকল্প আছে কী?’ শীর্ষক এ সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রক্রিয়াগত ত্রুটি, এ খাতে ভুল নীতিসহ নানা কারণে বিদ্যুতের অস্বাভাবিক উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি ভর্তুকি বাড়ছে। যার দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করছে সরকার। এর ফলে মূল্যস্ফীতির চাপে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়ে গেছে।
অথচ মূল্যবৃদ্ধি না করে অনেক বিকল্প ছিল। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি কোনোভাবেই সমন্বয় নয়, বরং এটি ভোক্তার ওপর সরাসরি বাড়তি দাম চাপানো। বরং দাম বৃদ্ধি না করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ সমন্বয় করা দরকার।
সিপিডি বলছে, দ্রব্যমূল্যের উচ্চগতির কারণে মানুষ কষ্টে আছে। এ পরিস্থিতির মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করা হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি না করে লোকসান কমানো যেত, সেটা সরকার করেনি।
সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির বক্তব্য উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ শর্ত মেনে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয় চালু করা হয়েছে। আইএমএফের আরেকটি শর্ত ছিল বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ভর্তুকি সমন্বয় করা। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ভর্তুকি সমন্বয় করা হবে আগামী তিন বছরে ধাপে ধাপে।
আইএমএফের শর্ত পূরণে বিদ্যুতের দাম গত বছর তিন দফায় ৫ শতাংশ করে দাম বাড়ানো হয়েছে। গত মাসে এক দফায় বাড়ানো হয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। কিন্তু এভাবে পুরোটা ভোক্তার ওপর না চাপিয়ে খরচ কমাতে পারে সরকার।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) যখন দাম বাড়াতো তখন ভোক্তার এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সুযোগ ছিল। এতে সরকারি সংস্থার আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হতো। সরকার ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আইন সংশোধন করে দাম সমন্বয়ের ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেয়, এতে নির্বাহী আদেশে দাম বৃদ্ধি করায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত হচ্ছে না। এটি আবার বিইআরসির হাতে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ওপর সিপিডি গত বছরের নভেম্বরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রভাব নিয়ে জরিপ করে। এতে দেখা গেছে, আবাসিক খাতে গড়ে খরচ বাড়বে সাড়ে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। এতে তাদের বিদ্যুৎ বিল বাড়বে গড়ে ১০৬ থেকে ১১৮ টাকা।
তবে কৃষির সেচে খরচ বাড়বে ১১ শতাংশের বেশি। এতে করে কৃষি পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ চালিত কারখানার উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। সেখানেও ভোক্তার খরচ বাড়বে।
সিপিডি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জকে (কেন্দ্র ভাড়া) বড় সমস্যা মনে করছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া সরকারের মাথা ব্যথার বড় কারণ হয়েছে। শুধু কেন্দ্র ভাড়া নয়, উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনাও খরচ বাড়ার কারণ। এর পাশাপাশি এ খাতে প্রতিযোগিতার অভাব। ইচ্ছামতো সমঝোতা করে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করা হয়েছে।
প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কম হতো বলেও সিপিডি মনে করে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ভর্তুকি সমন্বয়ের জন্য সরকারের হাতে চারটি বিকল্প রয়েছে। এগুলো হলো- সময়মতো বিভিন্ন জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা, বেসরকারি খাতে নতুন বিদ্যুৎ কিনতে নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট শর্তে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করা, নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো এবং প্রয়োজনে খুবই সামান্য পরিমাণে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করা।
এগুলো বাস্তবায়ন করলে পাঁচ বছরের মধ্যে এ খাতে আর ভূর্তকির প্রয়োজন পড়বে না বলেও বলা হয় সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে।