বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গে নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়ে ব্যবসায়ীদের জন্য পরিস্থিতি আগের থেকে জটিল হয়েছে– এমনটাই উঠে এসেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) উদ্যোক্তা জরিপে।
বুধবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে সিপিডি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশ ব্যবসা পরিস্থিতি-২০২৩’ শীর্ষক জরিপের ফল তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জরিপের ফল তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “আমাদের ব্যবসায়ীরা আগে যে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতেন, আজকে সেটার সাথে নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হচ্ছে। পূর্বে আমাদের ব্যবসায়ীরা দুর্নীতি, অবকাঠামো, অর্থিক খাতে সহায়তা, আমলাতন্ত্র, নিয়ে যতটা কথা বলতেন… এখন নতুন করে যা দেখা যাচ্ছে– বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা বা রিজার্ভ পরিস্থিতির মত নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাদের কথা বলতে হচ্ছে।”
তবে ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা বেড়েছে জানিয়ে তিনি মোয়াজ্জেম বলেন, “তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠী এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে তাদের ব্যবসা করে যেতে পারছে। তবে সেই গোষ্ঠীর পরিমাণ মোট ব্যবসায়ীদের তুলনায় খুবই ক্ষুদ্র।”
তিনি বলেন, “আমরা যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবসা পরিস্থিতি চাই, এটা সেই ব্যবসা পরিস্থিতির জন্য কাম্য না। এখনই যদি সংশ্লিষ্ট সবাই এই চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কাজ না করে তাহলে ব্যবসায়ীদের ভেতরে বৈষম্য আরও বাড়বে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরও নাজুক করে তুলবে।”
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জরিপের জন্য গত বছরের মে থেকে জুলাই পর্যন্ত ঢাকা, গাজীপুর ও সাভার এলাকার ৭১ জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলা হয়। এর মধ্যে ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ২৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ, মধ্যম মানের ব্যবসায়ী ৩৫ দশমিক ২১ ও বড় ব্যবসায়ী ৩৫ দশমিক ২১ শতাংশ। ব্যবসা খাতের মধ্যে কৃষি সংক্রান্ত ২ দশমিক ৮২ শতাংশ, শিল্প ও তৈরিকারক ২২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। উৎপাদনকারী নয় এমন ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ও সেবাখাতের ৬৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
প্রধান সমস্যা দুর্নীতি
সিপিডির জরিপের তথ্য অনুসারে, শতভাগ বড় ব্যবসায়ীর জন্য প্রধান সমস্যা দুর্নীতি, মাঝারি ৬১ শতাংশ ব্যবসায়ী দুর্নীতিকে সমস্যা মনে করছেন এবং ৫৬ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দুর্নীতিকে সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন। আবার ছোট ছোট সরকারি সেবার ক্ষেত্রে ৮৫ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমস্যায় পড়ছেন, যেখানে বড় ব্যবসায়ীদের সমস্যা এসব ক্ষেত্রে কিছুটা কম। যেকোনো চুক্তি বা লাইসেন্সের জন্য ৫৮ শতাংশ ব্যবসায়ী, কর পরিশোধ করতে ৫৭ শতাংশ ব্যবসায়ী, আমদানি-রপ্তানি করতে ৫৫ শতাংশ ব্যবসায়ীকে বিভিন্ন সময় ঘুষ দিতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন।
রিজার্ভ সংকট
গত বছর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে অস্থিতিশীলতা বড় ব্যবসায়ীদের বেশি প্রভাবিত করেছে বলে জরিপে উঠে এসেছে। জরিপে অংশ নেওয়িা ৬২ শতাংশ বড় ব্যবসায়ী জানান, বিষয়টি তাদের ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল, যেখানে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ৩৮ শতাংশ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়ার কথা জানান। ডলার সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক লেনদেন করতে ৫০ শতাংশ, কাঁচামালের খরচ দিতে ৫৭ শতাংশ, এলসি খুলতে ৫২ শতাংশ ও নতুন বিনিয়োগ করতে ৫৫ শতাংশ ব্যবসায়ী জটিলতার সম্মুখীন হন বলে জানিয়েছেন।
ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না
জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ীদের ৩০ শতাংশ বলেন, ২০২৩ সালে তাদের উৎপাদন বা বিক্রয় কমেছে। ৪২ শতাংশ ব্যবসায়ী ব্যবসায় কোনও পরিবর্তন দেখছেন না, স্থিতাবস্থায় আছেন। মাত্র ৬ শতাংশ ব্যবসায়ী ইতিবাচক পরিবর্তন দেখছেন। ৩৫ শতাংশ ক্ষুদ্র, ২৪ শতাংশ বড় ব্যবসায়ী ব্যবসা ভালো পরিস্থিতিতে নেই বলে জানিয়েছেন।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “প্রবৃদ্ধি বা লাভের মুখ সবাই দেখছেন না, এটা স্পষ্ট। যেভাবে প্রবৃদ্ধির গল্প আমরা শুনি তার সাথে বাস্তব পরিস্থিতির পার্থক্য রয়েছে। ৬১ শতাংশ ব্যবসায়ীই মনে করেন, ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে কিছু বড় গ্রুপ।”
প্রতিবেশীদের থেকে ব্যবসায় পিছিয়ে
সিপিডির জরিপ অনুসারে, উদ্ভাবন এবং সহনশীলতা বিচারে ভারত ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশের ব্যবসা। টেকসই ব্যবসার দিকে তাকালে দক্ষিণ এশিয়ার সব প্রতিবেশী দেশ থেকেই পিছিয়ে বাংলাদেশ। ব্যবসায় জনগণের অন্তর্ভুক্তিকতায় বাংলাদেশ শুধু পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে।
আগামী দুই বছরের চ্যালেঞ্জ জ্বালানি সঙ্কট
জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ীদের ৬৬ শতাংশের মতে, সামনের দুই বছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জ্বালানি সঙ্কট। জরিপে অংশ নেওয়া ৩৮ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, আইএমএফের শর্ত অনুসারে জ্বালানি ভর্তুকি তুলে নিলে তা ব্যবসায় ঋণাত্মক প্রভাব ফেলাবে। অন্যদিকে ৪৭ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে সরকার যে টাকা খরচ করে তা থেকে যদি সরে আসে, তাহলে জ্বালানি ভর্তুকির চাপ কমবে।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “আমরা লম্বা সময় ধরে নবায়নকৃত জ্বালানি ব্যবহার করতে বলছি। কিন্তু সরকার আমাদের কথা শুনছে না। বারবার ফসিল ফুয়েলের দিকে মনোযোগী হয়ে আমরা একটি ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি।”
অর্থনৈতিক ঝুঁকি
জরিপে অংশ নেওয়া ৫১ শতাংশ ব্যবসায়ী মুল্যস্ফীতিকে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মনে করছেন। ৩৫ শতাংশ ব্যবসায়ী অর্থনৈতিক মন্দা, ২৯ শতাংশ আয় বৈষম্যকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “গত পাঁচ বছরে অবকাঠামোতে আমরা কিছুটা উন্নতি করেছি। কিন্তু যে পরিমাণ বিনিয়োগ আমরা করেছি তা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। যে পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে সে পরিমাণ অর্থ আমাদের কাছে ফেরত আসেনি। এর ফলে আমাদের দেশের মানুষ ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে। ২৬ শতাংশ ব্যবসায়ী ঋণের বোঝাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছে।”
ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি
ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ীদের মত, বিরোধ কমাতে না পারলে তা ব্যবসার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। ৫০ শতাংশ ব্যবসায়ী স্যাংশন বা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা নিয়ে চিন্তিত। রাষ্ট্রের ভগ্নদশা কিংবা ব্যর্থতা নিয়ে ৩৫ শতাংশ ব্যবসায়ী উদ্বিগ্ন।
সিপিডির প্রস্তাব
সব স্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা বলছে সিপিডি। এর জন্য সরকারি অফিসকে তার ১০০ দিনের, এক বছরের, তিন বছরের এবং পাঁচ বছরের কর্মসূচি ঘোষণা করতে হবে। এসব তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকতে হবে এবং কিছু সময় পর পর অগ্রগতি বিবেচনা করতে হবে। সকল কর্মসূচির ওপর মনিটরিং বৃদ্ধি করতে হবে।
সরকারকে অবিলম্বে ন্যায়পাল নিযুক্ত করার প্রস্তাব দিয়ে সিপিডি বলছে, একজন ন্যায়পাল নিযুক্ত করা যেতে পারে বা প্রতিটি সরকারি দপ্তরের জন্য আলাদা আলাদা ন্যায়পাল থাকতে পারে।
সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ করতে ভারতের আধার কার্ডের মত কার্ডের মাধ্যমে সমন্বিত লেনদেন ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাবনাও দিয়েছে সিপিডি।
যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রকল্পের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের প্রকল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত করার এবং তাদের মতামতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার দরকার বলেও মনে করে সিপিডি।