চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) বাজেটে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা খুবই কঠিন বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এর কারণ হিসেবে তারা রজস্ব আহরণের বড় ঘাটতির উদাহরণ টেনেছে। তারা বলছে, যে গতিতে রাজস্ব আহরণ করা হচ্ছে তাতে প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা অর্থবছর শেষে ঘাটতি থাকার শঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে আগামী বাজেট প্রণয়নে সরকারকে সাবধানী ও সংযমী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
শনিবার সকালে নিজস্ব কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি আগামী বাজেটকে কেন্দ্র করে তাদের সুপারিশনামা পেশ করে।
সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের কথা মাথায় রেখে টেকসই অর্থনীতি, রাজস্ব আহরণের জায়গা বৃদ্ধি এবং সরকারি ব্যয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা, এই তিন নীতিকে সামনে রেখে বাজেট প্রণয়নের কথা বলছে সংস্থাটি।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে বলেন, এমন একটা পরিস্থিতিতে বাজেট প্রণয়ন হতে যাচ্ছে, যখন আমরা দেখতে পারছি সমষ্টিগত অর্থনীতি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। রাজস্ব আহরণের নিম্নগতি, বাজেট প্রণয়নে শ্লথগতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকে তারল্য সংকট এবং একইসাথে রপ্তানি আয় এবং রেমিটেন্স আয়ও নিচের দিকে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ তাও নিম্নগামী। এর ফলে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি বেশ চাপে রয়েছে। কিছুদিন আগেও আমাদের অর্থনীতির যে স্থিতিশীলতা ছিল তা এখন আর নেই।
এর কারণ অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক দুটোই মন্তব্য করে তিনি বলেন, এসব মাথায় নিয়েই কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। বাজেটের মূল উদ্দেশ্যই হতে হবে,অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আমরা কভাবে ফেরত আনতে পারি এবং এই চ্যালেঞ্জগুলো আমরা কিভাবে নিরসন করতে পারি।
বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সরকারকে কাঠামোগত পরিবর্তন আনারও সুপারিশ করেন তিনি।
তবে নতুন সরকারের উপর খুব একটা আস্থা রাখতে রাজি নন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সরকার হয়তো আবার একটি গতানুগতিক বাজেট পেশ করবে এই আশঙ্কা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের কোনও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ভিত্তিক কার্যক্রম আমরা দেখতে পাইনি। এমনকি মন্ত্রীদের ভিতরে আমরা তেমন খুব একটা উৎসাহ দেখতে পাচ্ছি না। নতুন বেশ কয়েকজন মন্ত্রী মন্ত্রিসভায় এলেও দুই একজন বাদ দিয়ে আর কারও খুব একটা তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অর্থনীতি যেরকম চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যেরকম কাঠামোগত পরিবর্তন হওয়া দরকার ,তাতে সরকারের কোন নতুন উদ্যোগ আমরা দেখতে পারছি না।
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে গতানুগতিক বাজেট দেশের জন্য আরও বিপদের কারন হয়ে দাড়াতে পারে বলে মন্তব্য করেন এই গবেষক।
চলতি অর্থবছরে অর্থনীতির হালচাল
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ। সেখানে প্রথম ছয় মাসে অর্জন হয়েছে মাত্র ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ। সিপিডির গবেষণাপত্র অনুযায়ী, যদি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হয় তাহলে শেষ ছয় মাসে প্রবৃদ্ধি করতে হবে ৫৪ শতাংশ ।
এ বিষয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, এটি অর্জন করা অসম্ভব এবং খুবই কঠিন। এছাড়াও যে গতিতে রাজস্ব আহরণ করা হচ্ছে তাতে প্রায় ৮২ হাজার কোটি অর্থবছর শেষে ঘাটতি থাকার সুযোগ রয়েছে।
সংস্থাটি জানায়, অর্থনৈতিক চাপের কারণে সরকারের ব্যয় কমেছে কিন্তু তা সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি হয়েছে প্রথম ছয় মাসে ৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা । ঘাটতি কমাতে সরকারের ব্যাংকের উপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে তাতে তারল্য সংকট বেড়েছে ব্যাংকগুলোর।
সিপিডির গবেষণাপত্র অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম আট মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ঘরে রয়েছে। এবং এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির কারনে।
সংস্থাটি বলছে, ডলার সংকটের কারণে আমদানির উপর বিভিন্ন শর্ত প্রয়োগে বিপদে পড়েছে ছোট আমদানিকারকরা। এই সুযোগে বাজারে বড় আমদানিকারকরা একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে। এটিকে অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক বলছে সংস্থাটি।
রেমিট্যান্স প্রসঙ্গে ফাহমিদা খাতুন বলেন, আমাদের রেমিট্যান্স থেকে আসা অর্থ সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে না। যে পরিমান মানুষ বিদেশ যাচ্ছে সেই পরিমান রেমিট্যান্স আমরা পাচ্ছি না। এটা কেন সেই উত্তর খুজে বের করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে সরকারের ভূমিকা আশা করেন তিনি।
সরকার অর্থনৈতিক সংকটে চলমান অর্থবছরে বেশ কিছু সাময়িক উদ্যোগ নিয়েছে কিন্তু তা বেশিদিন কাজে আসবে না জানিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, সাময়িক উদ্যোগ দিয়ে কিছুদিন যাবে কিন্তু এতে অর্থনীতিতে খুব একটা পরিবর্তন হবে না। সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়ার বিকল্প নেই।
আগামী বাজেটের প্রস্তাবনা
আগামী বাজেটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ মন্তব্য করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রন করাই সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। খাদ্য উৎপাদন আমাদের বাড়াতে হবে। পিছিয়ে পড়া মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।
যেসব সরকারি প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত মাত্র ১০ শতাংশ হয়েছে,সেগুলোর অগ্রাধিকার কমিয়ে দিয়ে বিদেশী সহায়তায় যেসব প্রকল্প চলছে সেগুলোর দিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে।
সরকারের কাছে সংস্থটি আলাদা একটি কমিশন গঠনের দাবি জানায়। ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারের প্রকল্পগুলোর অর্থব্যয়ের হিসাব রাখার জন্য আলাদা একটি কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। কারন, শুধু কাচামালের দাম বৃদ্ধির কথা বললে হবে না,প্রকল্পগুলো ধরে দুর্নীতির কথা আমরা প্রতিনিয়তই শুনতে পাই।
অর্থ অপচয় বন্ধ করা জরুরি জানিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারের কেনা-কাটা নিয়মতান্ত্রিক হতে হবে। গাড়ি কেনা বা ঘুরতে যাওয়ার জন্য সরকারি অর্থ ব্যয় বন্ধ করতে হবে। প্রত্যেকটি অর্থ বাঁচাতে হবে,নাহলে আমাদের সমস্যাগুলো দূর হবে না।
ব্যাংক থেকে না নিয়ে রাজস্ব আহরণের মাধ্যমে বাজেটের অর্থ পূরণ করার জন্য পদক্ষেপ নিতে সরকারকে আহবান জানিয়েছে সংস্থাটি। ব্যাক্তিগত করের হার এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের করের হারের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছে তারা। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সর্বোচ্চ করের হার চলতি অর্থবছরের ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আগামী অর্থবছরে ৩০ শতাংশ করার সুপারিশ তাদের। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর ২৭.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার কথাও তারা বলছে। কোন কারনে যদি শর্ত পালনে ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাহলে আগামী অর্থবছরে তাদের করের হার বাড়িয়ে ৩২.৫ শতাংশ করার প্রস্তাব সংস্থাটির।
অবৈধ উপায়ে বিদেশে টাকা যাওয়া আটকাতে সরকারের কঠোর ভূমিকা আশা করে সংস্থাটি বলছে, সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরকে সম্বন্বিত করে উদ্যোগ নিয়ে আইন শক্তিশালী করতে হবে। তা নাহলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আশা কঠিন হবে।
অর্থপাচার রোধে এনবিআরকে শক্তিশালী ভূমিকা নেওয়া, অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ বন্ধ করা, করদাতাদের হয়রানি বন্ধ করা, ইএফডি যন্ত্র সহজলভ্য করা, ওষুধের ওপর ভ্যাট কমানো। এছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও আমদানি করা বই এসবে শুল্ক, ভ্যাট ও কর কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি।
সংস্থাটির মতে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৭৩ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ্য ছিল না। মূল্যস্ফীতির কারণে এ সংখ্যা এখন হয়তো আরও বেশি।
তবে সংস্থাটি বলছে মূল্যস্ফীতির জন্য আভ্যন্তরীন কারণই মুখ্য। লম্বা সময় ধরে বাজার অব্যবস্থাপনার জন্যই আজকে সাধারন মানুষকে ভোগ করতে হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন মূল্য যাচাই করে বিক্রয়মূল্য ঠিক করার জন্য সরকারকে আহবান জানিয়েছে সংস্থাটি।
প্রস্তাবনায় সিপিডি বলছে, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট এমন সময়ে উপস্থাপন করা হবে যখন দেশ নানাবিধ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সিপিডির মতে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই নীতিনির্ধারকদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে। বৈদেশিক মুদ্রার হারকে স্থিতিশীল করা মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর জন্য সুযোগ সুবিধা দিতে হবে।
সিপিডি স্বাস্থ্যখাতে এবং শিক্ষাখাতে বরাদ্ধ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। তারা বলছে ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে এই দুইখাতে বরাদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে। বাংলাদেশের মানুষকে নিজের খরচে চিকিৎসা ও শিক্ষা নিতে হয়। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।