২০০৪ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলেই সৃষ্টি হয়েছিল এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। মূলত দেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমন এবং আইনশৃঙ্খলার মানোন্নয়নের লক্ষ্যেই ওই বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের প্যারেডে কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পথ চলা শুরু হয় পুলিশের বিশেষায়িত এই ইউনিটটির।
প্রতিষ্ঠার ২০ বছর পর সেই বিএনপিই এখন র্যাব বিলুপ্তির দাবি তুলেছে। খুন, গুমসহ অতীতের বিভিন্ন অভিযোগে দেশে-বিদেশে সুনাম ক্ষুণ্ণ হওয়ায় ইউনিটটির বিলুপ্তি চায় দলটি।
বিএনপির এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব বলছে, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই কাজ করবে তারা।
বুধবার সকালে ঢাকার কাওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক মতবিনিময়ের আয়োজন করেছিল র্যাব। ‘সমসাময়িক বিষয় এবং সাম্প্রতিক আভিযানিক কার্যক্রম’ সম্পর্কে ধারণা দিতেই এই আয়োজন।
সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে র্যাবের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি একেএম শহিদুর রহমান বলেন, “দেশের জনগণ ও রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণে র্যাবের ব্যাপারে রাষ্ট্র যে সিদ্ধান্ত নেয়, আমরা সে অনুযায়ী কাজ করব।”
গত মঙ্গলবার গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব বিলুপ্তির দাবি জানায় বিএনপি।
বিএনপি গঠিত পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “এটা মেডিকেল বিদ্যাতেও আছে যখন একেবারে গ্যাংরিন (দেহে পচনশীল ক্ষত) হয়ে নষ্ট হয়ে যায়, তখন কেটে ফেলা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না।
“সেজন্য আমরা মনে করেছি, র্যাব বাহিনী আন্তর্জাতিকভাবেই এমনভাবে নিন্দনীয় হয়েছে, আর দেশের মধ্যে তো র্যাব মানেই একটা দানব সৃষ্টি করেছে তারা (আওয়ামী লীগ); যত ধরনের খুন-গুম, যত এক্সট্টা জুডিশিয়াল কিলিং অধিকাংশই এই র্যাব বাহিনীর মাধ্যমে হয়েছে। সেজন্য আমরা এটিকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছি। র্যাব বিলুপ্ত হলে র্যাবের দায়িত্ব আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ান এবং থানা পুলিশ যেন পালন করতে পরে সেলক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”
মতবিনিময়ে প্রতিষ্ঠার পর থেকে র্যাবের হাতে নির্যাতিত ও নিহতদের পরিবারের সদস্যদের কাছে বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্ষমাও প্রার্থনা করেন তিনি।
মতবিনিময়ের শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বীর শহীদ ও বীরাঙ্গণাদের স্মরণ করেন তিনি। স্মরণ করেন জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নিহতদেরও। যারা আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাদের সুস্থতা কামনা করেন।
এরপর র্যাবের সাম্প্রতিক বিভন্ন সফলতা তুলে ধরেন। মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে হামলা, হত্যা ও হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে এবং নাশকতার নেতৃস্থানীয় যাদের নামে দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা আছে তাদের গ্রেপ্তারের পরিসংখ্যানই সফলতা হিসেবে তুলে ধরেন র্যাব মহাপরিচালক। এছাড়া লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের কথাও জানান।
র্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিস্তর অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা।
জবাবে র্যাব মহাপরিচালক বলেন, “র্যাব মানবাধিকার রক্ষায় প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। র্যাবে যেকোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয় এবং প্রমাণিত হলে দায়ী সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
সম্প্রতি র্যাবের সদস্যরা চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে বলে যে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে সে সম্পর্কে তিনি বলেন, “র্যাবের সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এলে তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত করা হয় এবং প্রমাণিত হলে কঠোর বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
“সম্প্রতি র্যাব সদর দপ্তরসহ কয়েকটি ব্যাটালিয়নের ১৬ জন সদস্যকে চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও ডাকাতির অভিযোগে আটক হয়। তাদের বিরুদ্ধে আমরা বিধি মোতাবেক বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত র্যাবের ৫৮ কর্মকর্তাসহ ৪ হাজার ২৩৫ জন সদস্যকে শৃঙ্খলা বহির্ভূত কার্যক্রমের জন্য লঘু ও গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।”
এসময় আলোচনায় আসে র্যাবের নির্যাতন কেন্দ্র বা ‘আয়নাঘরের’ প্রসঙ্গও।
র্যাব মহাপরিচালক বলেন, “র্যাবের যে সব আয়নাঘর ছিল সেগুলো এখনও আগের মতোই আছে। সেগুলো কোনও ধরনের পরিবর্তন করা হয়নি। র্যাব কোনও গুম বা খুনের ঘটনাকে সমর্থন করে না। গুমের অভিযোগ এবং আয়নাঘরের বিষয়ে তদন্ত চলছে। অভিযোগগুলোর সত্য উদঘাটনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।”
জুলাই অভ্যুত্থানে র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে গুলির বিষয়েও জানতে চান সাংবাদিকরা।
জবাবে একেএম শহিদুর রহমান বলেন, “হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণের অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন করা হবে। র্যাব কখনোই এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন কার্যকলাপ সমর্থন করে না। সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ থাকলে তা সরবরাহ করার জন্য আহ্বান জানাই।
“এ বিষয়ে ইউএন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিনিধিরাও বিভিন্ন ঘটনাস্থল ও র্যাব সদর দপ্তরসহ র্যাবের বিভিন্ন অফিস পরিদর্শন করে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত চেয়েছিল, যা আমরা তাদের সরবরাহ করেছি।”
র্যাবের সফলতা
মতবিনিময়ে জানানো হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার উপর হামলা, হত্যা ও হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে এবং নাশকতার নেতৃস্থানীয় যাদের নামে দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা তাদের মধ্যে চার জন সাবেক মন্ত্রী, ১৭ জন সাবেক এমপি, সাবেক মেয়র/উপজেলা/ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ৪০ জন, কাউন্সিলর/মেম্বার ১৬ জন, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের ১৮৩ জন নেতাকর্মী এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ ও সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনার মাধ্যমে চিহ্নিত করে ৩০ জন সরাসরি গুলিবর্ষণকারীসহ সর্বমোট ৩৫৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
এছাড়াও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের সময় র্যাবের লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে ৯০টি অস্ত্র ও ৭ হাজার ৩০৩ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট থেকে লুট হওয়া ২২৮টি অস্ত্র ও ১১ হাজার ৯৪১ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে র্যাব।
৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৮০ জন অপরাধীকে গ্রেপ্তার, ১৫০টি অস্ত্র ও ১ হাজার ২৯ রাউন্ড গোলাবারুদসহ মোট ৪৬৮টি অস্ত্র ও ২০ হাজার ২৭৩ রাউন্ড গোলাবারুদও উদ্ধার করা হয়েছে।
জুলাই বিপ্লবের পর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১ হাজার ২৩৮ জন মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি সাড়ে ৭ লাখের বেশি পিস ইয়াবা, ২৮ কেজির বেশি হেরোইন, প্রায় সাড়ে ৫৮ হাজার বোতল ফেনসিডিল, সাড়ে ৫ হাজার কেজির বেশি গাঁজা এবং প্রায় ৫ হাজার বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করেছে র্যাব।
এছাড়াও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে পলাতক সাজাপ্রাপ্ত ১১০ জন এবং দেশের বিভিন্ন স্থান হতে ১০৫ জন ডাকাতকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পোশাক খাতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী ১৬ জন দুষ্কৃতিকারীকে গ্রেপ্তার, বিভিন্ন মন্দিরে হামলাকারী পাঁচ জন; আনসার বিদ্রোহের মদদদাতা দু’জন ও পল্লী বিদ্যুৎ খাতে অস্থিরতা সৃষ্টিকারী দু’জনসহ মোট ৩৫ জনকে গ্রেপ্তারও করেছে র্যাব।
র্যাব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে রংপুরে নিহত আবু সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। আহত আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে।
যারা আর্থিক সংকটের কারণে চিকিৎসা নিতে পারছিলেন না, র্যাব নিজ ব্যবস্থাপনায় তাদের বাড়ি থেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে বলেও মতবিনিময়ে সাংবাদিকদের জানানো হয়।