Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য উঠানামা টার্মিনালে বেড়েছে, জেটিতে কমেছে কেন

চট্টগ্রাম বন্দরে এনসিটিতে কন্টেইনার সরানো হচ্ছে। পুরোনো ছবি।
চট্টগ্রাম বন্দরে এনসিটিতে কন্টেইনার সরানো হচ্ছে। পুরোনো ছবি।
Picture of আসিফ সিদ্দিকী

আসিফ সিদ্দিকী

চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি ও রপ্তানির পণ্য উঠানো-নামানো হয় দুটি টার্মিনাল নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও চিটাগাং কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) এবং জেনারেল কার্গো বার্থ বা জিসিবির ১২টি জেটি দিয়ে। বছরে মোট ৩০ লাখ একক কন্টেইনার উঠানো-নামানো হয়। এরমধ্যে জিসিবির জেটিগুলোতে পণ্য উঠানামা কমেছে। তবে এর পাশে থাকা এনসিটি ও সিসিটি টার্মিনালে পণ্য উঠানামা বেড়েছে।

সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম বার্থ অপারেটর পদ্ধতি চালু করা হয়। পণ্য উঠানামার বড় সব যন্ত্রপাতি কিনে জেটি ও টার্মিনালে স্থাপন করা হয়। তবে পরিচালন কাজে কিছু ছোট যন্ত্রপাতি অপারেটররা নিজেরা জোগাড় করে। জিসিবির ১২টি জেটি পরিচালনা করে ১২টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তবে এনসিটি ও সিসিটি পরিচালনা করে আসছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক।  

টার্মিনালে পণ্য উঠানামা বেড়ে যাওয়া এবং জেটিতে তা কমা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জেটিতে কর্মরত বার্থ অপারেটররা। তারা বলছে, জাহাজ বার্থিংয়ে বৈষম্য করায় জিসিবিতে পণ্য উঠানামা কমেছে। এজন্য শ্রম অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। এ পরিস্থিতিতে সামনে এনে শ্রমিকদের ঈদ বোনাস মেটানো কঠিন হবে।   

এ বিষয়ে বার্থ অপারেটর, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর ও টার্মিনাল অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এম এ বকরের সঙ্গে কথা হয়।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আমরা লিখিতভাবে বলেছি জিসিবি জেটির কন্টেইনার, বাল্ক- দুই ধরনের জাহাজ আসাই কমেছে। এমনিতেই বন্দরে পণ্য উঠানামা কমেছে, তার ওপর জাহাজ কম বরাদ্দ দিচ্ছে। অথচ বড় জাহাজগুলো এনসিটি, সিসিটিতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এজন্য বড় জাহাজ এবং আরও বাড়তি জাহাজ জিসিবিতে বরাদ্দের অনুরোধ করেছি। কিন্তু এখনও সাড়া মেলেনি।

“এমন ঘটনা ঘটছে- একটি বড় জাহাজ প্রথমে এনসিটিতে ভিড়ছে কিছু পণ্য নামিয়ে, বাকি পণ্য নামানোর জন্য জিসিবিতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”  

তবে এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি ১২টি জেটির একটি পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইডেট ট্রেডিংয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বকর।  

কোন টার্মিনালে কী পরিমাণ পণ্য উঠছে-নামছে   

বিভিন্ন ধরন বা আকারের কন্টেইন্টার বন্দরে উঠানো-নামানো হলেও ২০ ফুটের কন্টেইনার ধরে হিসাব করা হয়, যা এক টিইইউএস (টোয়েন্টি-ফিট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট) একক হিসেবে গণ্য হয়।

২০২৩ সালের নভেম্বরে জিসিবিতে পণ্য উঠানামা হয়েছিল ৮৫ হাজার ৬০০ একক, ডিসেম্বরে ৮১ হাজার ৩৪৪ একক এবং জানুয়ারিতে সেটি আরও কমে ৭৮ হাজার ৮৯০ এককে নামে। বিপরীতে এনসিটি-সিসিটিতে নভেম্বরে পণ্য উঠানামা হয়েছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার একক, ডিসেম্বরে ১ লাখ ৪০ হাজার একক এবং জানুয়ারিতে সেটি বেড়ে ১ লাখ ৫১ হাজার একক হয়েছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে জিসিবিতে পণ্য উঠানামা কমেছে, এনসিটি-সিসিটিতে বেড়েছে।  

জিসিবিতে পণ্য উঠানামা কমছে কেন

জিসিবির ১২টি জেটি বন্দরের সবচেয়ে পুরোনো জেটি। জিসিবির জেটিগুলোকে আধুনিকভাবে নির্মাণ ও আধুনিক সব যন্ত্রপাতি দিয়ে পরিচালনার জন্য একটি সমীক্ষা করেছিল বিশ্ব ব্যাংক। কন্টেইনার খোলা জাহাজসহ মাল্টিপারপাস কাজে ব্যবহারের জন্য সেই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর আর সেই পথে এগোয়নি। কারণ এর চেয়েও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন চট্টগ্রাম বন্দরের বাইরে পতেঙ্গা এলাকায় বে টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ফলে জিসিবির আধুনিকায়নের প্রকল্প থমকে গেছে।

জিসিবির ১২টি জেটির মধ্যে ৬টিতে সাধারণ পণ্য যেমন- সিমেন্ট ক্লিংকার, গম, স্ক্র্যাপ জাতীয় অর্থাৎ বাল্ক আকারে আনা পণ্য উঠানামা হয়। বাকি ৬টি জেটিতে উঠানামা হয় শুধু কন্টেইনারভর্তি পণ্য।

দুই কারণে এসব জেটিতে জাহাজ কম ভিড়ছে বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।  

একটি হচ্ছে, সেই ১২টি জেটির পাশে কর্ণফুলী নদীর নাব্য বা ড্রাফট তুলনামূলক কম। নাব্যতা কম থাকায় সেখানে ৮ থেকে সাড়ে ৮ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়াতে হয়। কিন্তু বন্দরে ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়ানোর অনুমতি আছে। 

দ্বিতীয়ত, এসব জেটির কোনোটিতেই পণ্য উঠানামার আধুনিক যন্ত্র কোয়েসাইড গ্যান্ট্রি ক্রেন (কিউজিসি) নেই; নেই জাহাজ থেকে কন্টেইনার নামিয়ে রাখার আধুনিক যন্ত্রও। কিউজিসি না থাকায় এসব জেটিতে কেবল ক্রেনযুক্ত জাহাজই ভিড়তে পারছে। অর্থাৎ শুধু জাহাজে থাকা ক্রেন দিয়ে পণ্য উঠানো-নামানো হয়। ফলে পণ্য উঠানামার গতি সেখানে কম। এছাড়া বার্থ অপারেটরদের অদক্ষতাও এজন্য দায়ী।

ইদানিং বন্দরে ক্রেনবিহীন জাহাজ বেশি আসছে। আর ক্রেনবিহীন জাহাজ থেকে পণ্য নামানো হয় দ্রুতগতির কিউজিসি দিয়ে। কিন্তু কিউজিসির মতো আধুনিক যন্ত্র জিসিবির জেটিতে নেই। ফলে জাহাজ পরিচালনাকারীরা বাধ্য হয়েই জিসিবির বদলে এনসিটি, সিসিটিতে জাহাজ ভেড়াতে চান।

জিসিবির জেটিগুলোতে পণ্য উঠা-নামা কমছে কেন—এ প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দরে এখন ক্রেনবিহীন (গিয়ারলেস) কন্টেইনার জাহাজ বেশি আসছে। ক্রেনবিহীন জাহাজ থেকে কন্টেইনার নামাতে  প্রয়োজন কিউজিসি। কিন্তু জিসিবিতে সেই যন্ত্র নেই। ফলে জাহাজ পরিচালনাকারীদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা এনসিটি, সিসিটিতে জাহাজ ভেড়াই। এখানে বৈষম্যের সুযোগ নেই।”

কিউজিসিসহ আধুনিক সুবিধা রয়েছে টার্মিনালে

যে কারণে বাড়ছে এনসিটি ও সিসিটিতে পণ্য উঠানামা   

চট্টগ্রাম বন্দরে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আধুনিক টার্মিনাল হচ্ছে এনসিটি ও সিসিটি। দুটি টার্মিনালেই জেটি আছে ৭টি। এরমধ্য ৬টিতেই মোট ১৮টি কিউজিসি যুক্ত আছে। এরমধ্যে ছোট একটি জেটি বরাদ্দ রাখা আছে নারায়ণগঞ্জের পাঁনগাও ইনল্যান্ড কন্টেইনার টার্মিনালের জাহাজ ভেড়ার জন্য। এরমধ্যে এনসিটির ৪টি জেটিতে ১৪টি এবং সিসিটির দুটি জেটিতে ৪টিই কিউজিসিসহ আধুনিক সব যন্ত্র দিয়ে পণ্য উঠানামা চলে। আবার এই দুটি টার্মিনালেই কন্টেইনার নামিয়ে রাখার বিশাল সুবিধা আছে। আছে কন্টেইনার পরিচালন কাজের সবচেয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি। ফলে এই দুটি টার্মিনালে পণ্য উঠানামা সবচেয়ে দ্রুত।

এই দুটি টার্মিনালের পাশে নদীর নাব্য অনেক বেশি, ফলে বড় গভীরতা বা ড্রাফটের জাহাজ সেখানে অনায়াসেই ভিড়তে পারে। সবচেয়ে দীর্ঘ জাহাজটিও এসব টার্মিনালে ভেড়ার সুযোগ পায়। বেশি গভীরতা ও লম্বা জাহাজ মানেই বেশি পণ্য পরিবহন। আর একসঙ্গে বেশি পণ্য পরিবহন মানেই পরিবহন ব্যয় কম।

টার্মিনাল দুটির অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জাহাজ কোথায় ভিড়াবে সেটি জাহাজ পরিচালনাকারীদের চাহিদা অনুযায়ী বন্দর কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ দেয়। এখানে অপারেটর হিসেবে আমাদের কোনও প্রভাব বা করণীয় নেই। তবে আমি বলতে পারি, এনসিটি-সিসিটিতে কন্টেইনার উঠানামা হয় সবচেয়ে দ্রুত গতিতে।”

বন্দর ও শিপিং লাইনগুলোর হিসাবে, বহির্নোঙর থেকে একটি কন্টেইনার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটিতে ভিড়ে আমদানি পণ্যের কন্টেইনার নামিয়ে রপ্তানি পণ্যের কন্টেইনার জাহাজে তুলে বন্দর ছাড়তে ২০২২ সালে সময় লাগতো ৭২ ঘণ্টা। আর ২০২৩ সালে সেই সময় কমে ৪৮ ঘণ্টায় নেমেছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন ও পরিচালন ব্যবস্থার উন্নতির কারণে একটি জাহাজ আগের চেয়ে ২৪ ঘণ্টা আগেই বন্দরের এনসিটি ছাড়তে পারছে। আর সিসিটি ছাড়তে পারছে ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই।

শিপিং লাইন গ্যালাক্সি বাংলাদেশ লিমিটেডের এক কর্মকর্তা বলেন, “একটি জাহাজ একদিন বাড়তি বহির্নোঙরে থাকলে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার মার্কিন ডলার গুনতে হতো। ২৪ ঘণ্টা সাশ্রয় হওয়ায় সেই খরচ সাশ্রয় হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এনসিটি-সিসিটি টার্মিনালেই কেবল সেই সুফল মিলছে। ফলে যেখানে দ্রুত পণ্য উঠানামা হয়, আমাদের আগ্রহ তো সেদিকেই থাকবেই। এরচেয়ে ভালো সুবিধা যদি পিসিটিতে মিলে তখন আমরা সেখানেই ঝুঁকব।”

ক্রেনবিহীন জাহাজ বেশি আসছে

বন্দর জেটিতে জাহাজ ভেড়ার অনুমতি দেওয়া হয় বার্থিং মিটিংয়ে। প্রতিদিন বন্দর ভবনে মিটিংয়ে শিপিং এজেন্টদের চাহিদার প্রেক্ষিতে জেটিতে জাহাজ ভেড়ার অনুমতি দেয় বন্দরের মেরিন বিভাগ। কিন্তু এক বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে ক্রেনযুক্ত বা গিয়ারড জাহাজ আসা কমেছে। বেড়েছে ক্রেনবিহীন বা গিয়ারলেস জাহাজ আসা।

চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, “২০১৯ সালেও চট্টগ্রাম বন্দরে ক্রেনযুক্ত জাহাজ বেশি আসতো; এখন তার উল্টো। ওই বছর বন্দরে ক্রেনযুক্ত ও ক্রেনবিহীন মিলিয়ে মোট ৬৫-৬৮টি কন্টেইনার জাহাজ অনুমতি নিয়ে পণ্য পরিবহন করতো। এরমধ্যে ৪০টি ছিল ক্রেনযুক্ত, ২৮টি ছিল ক্রেনবিহীন।

“২০২৩ সালে এসে অনুমোদিত জাহাজের সংখ্যা বেড়ে ৭৪-৭৮টি হয়েছে। এরমধ্যে ক্রেনবিহীন জাহাজ চলাচল বেড়ে হয়েছে ৫০টি, আর ক্রেনযুক্ত জাহাজ কমে ২৫টিতে নেমেছে। ক্রেনবিহীন জাহাজ চলাচল বাড়ার কারণে কিউজিসি থাকা জেটিতে জাহাজ ভেড়াতে হচ্ছে। ফলে সেখানে বাড়তি জাহাজ ভেড়াটা স্বাভাবিক।”  

চট্টগ্রাম বন্দরে ক্রেনবিহীন জাহাজ বেশি আসার কারণ জানতে চাইলে শিপিং লাইনের এক কর্মকর্তা বলেন, “বিশ্বজুড়েই এখন ক্রেনযুক্ত জাহাজের বদলে ক্রেনবিহীন জাহাজের চাহিদা বেড়েছে। ক্রেনবিহীন জাহাজের ভাড়া অনেক কম, চাইলে সহজে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে এখন যারা জাহাজ পরিচালনা করেন তাদের ঝোঁকও ক্রেনবিহীন জাহাজের দিকে।”  

বন্দরেরও বাড়তি আয়

কোয়েসাইড গ্যান্ট্রি ক্রেন বা কিউজিসি দিয়ে জাহাজ থেকে কন্টেইনার উঠানামা করালে চট্টগ্রাম বন্দরের বাড়তি আয় হয়। কিন্তু জিসিবিতে সেই আয়ের কোনও সুযোগ নেই। ফলে বাড়তি আয়ের আশায় বন্দরের বাড়তি ঝোঁক থাকে সেই টার্মিনালে পণ্য উঠানো-নামানোর দিকে।

বন্দর পরিবহন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, “গ্যান্ট্রি ক্রেন দিয়ে এনসিটিতে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০টি কন্টেইনার উঠানো-নামানো যায়। বিপরীতে জিসিবিতে সেই কাজ হয় জাহাজের ক্রেন দিয়ে, ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৫টি কন্টেইনার।

“একটি কন্টেইনার গ্যান্ট্রি ক্রেন দিয়ে উঠানামা করালে বন্দর পায় ১৫-২২ মার্কিন ডলার। কিন্তু জিসিবিতে সেই আয়ের সুযোগ নেই। ফলে বন্দর এত টাকা বিনিয়োগ করে ১৮টি গ্যান্ট্রি ক্রেন বসিয়েছে মুনাফার জন্য। বসিয়ে রাখার জন্য নয়।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত