কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের দুই নেতা আফজল খান ও আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের দ্বন্দ্ব দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার বিষয় ছিল দীর্ঘদিন। আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা মেয়র হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। আফজলের মৃত্যুর পর বাহারের একচ্ছত্র আধিপত্যের মধ্যে তার মেয়ে তাহসীন বাহার সূচনা ঠিকই মেয়র হয়ে যাচ্ছেন।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে শনিবার অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে তাহসীন হারিয়েছেন সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকে। বাস প্রতীকে তাহসীন পেয়েছেন ৪৮ হাজার ৮৯০ ভোট। সাক্কু টেবিল ঘড়ি প্রতীকে পেয়েছেন ২৬ হাজার ৮৯৭ ভোট।
দিনভর ভোটগ্রহণ শেষে বিকালে কুমিল্লা জিলা স্কুল মিলনায়তন থেকে মোট ১০৫ কেন্দ্রের প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে উপনির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরহাদ হোসেন বেসরকারি ফল ঘোষণা করেন।
মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন (ঘোড়া) পেয়েছেন ১৩ হাজার ১৫৫ ভোট। কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি নুর-উর রহমান মাহমুদ তানিম (হাতি) পেয়েছেন ৫ হাজার ১৭৩ ভোট।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোট ভোটার ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮ জন। তার মধ্যে ৩৮ দশমিক ৮২ শতাংশ ভোট দিয়েছেন বলে জানানো হয়েছে।
সকালে শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ শুরু হলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু গোলযোগের ঘটনা ঘটে। মুন্সি এম আলী স্কুল কেন্দ্রে দুপক্ষের সংঘাতে গুলিবিদ্ধ হন একজন। হারুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে আহত হন আরও ২ জন।
কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন দুই প্রার্থী মনিরুল ও তানিম। তবে সেই অভিযোগ অস্বীকার করেন তাহসীন বাহার।
দুই বছর আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বাহার ঘনিষ্ঠ আরফানুল হক রিফাত জয়ী হয়ে মেয়র হয়েছিলেন কুমিল্লায়। তার মৃত্যুতে এই উপনির্বাচন হয়।
সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ার সুযোগ থাকলেও বিএনপি ভোটে না আসায় সংসদ নির্বাচনের মতোই নির্দলীয় ভোটের কৌশল নেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
ফলে নৌকা প্রতীকের কোনও প্রার্থী ছিল না। বাহারের মেয়ে তাহসীন নির্দলীয় প্রতীকে অংশ নিলেও দলে বাহারের অনুসারী নেতা-কর্মীরা তার পাশেই ছিলেন।
অন্যদিকে সাক্কু এক সময় কুমিল্লা মহানগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদকের পদে থাকলেও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে নেমে তিনি গতবারই বহিষ্কৃত হন।
বাহার এক সময় কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন; সেই পৌরসভা সিটি করপোরেশন হওয়ার পর এর প্রথম নারী মেয়রের দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন মেয়ে তাহসীন। অর্থাৎ কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে নারী নেতৃত্বে সূচনা হচ্ছে সূচনার হাত দিয়ে।
বাবা যখন সংসদ সদস্য, তখন মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্বার্থের দ্বন্দ্ব হবে কি না- জয়ের পর তাহসীনকে এই প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। তিনি জবাবে বলেন, “এটা বরং কুমিল্লার জন্য ভালো হবে।”
যে নির্বাচনে বাহার প্রথম চেয়ারম্যান হয়েছিলেন, ১৯৮৪ সালের সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই আফজল খানের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের শুরু। তখন আফজল ছিলেন কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি, একই কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বাহার।
তখন নির্দলীয় নির্বাচনে দলের সমর্থন নিয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন আফজল খান। তবে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে দলের প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হয়ে যান বাহার।
এরপর যতটি নির্বাচন এসেছে, বাহার আর আফজলের দ্বন্দ্ব ততই প্রকট হয়েছে। আফজল খান মনোনয়ন পেয়ে হেরে বাহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন, আর বাহার হারলে অভিযোগবিদ্ধ হন আফজল খান।
এই কারণে কুমিল্লা সদরে বিএনপি থেকে বারবার নির্বাচিত হয়ে আসা বিএনপি নেতা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আকবর হোসেনের (বর্তমানে প্রয়াত) একটি কথা মানুষের মুখে মুখে ফেরে, তা হলো- ‘যতদিন আফজল খান আর বাহার আছে, ততদিন আমার কোনও সমস্যা নেই’।
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বাহার কুমিল্লা-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে প্রথম সংসদ সদস্য হন। সেটাই ১৯৭৩ সালের পর কুমিল্লা শহরের আসনে নৌকার প্রথম জয়।
আফজল সেই নির্বাচনে দলের কেন্দ্র থেকে পাঠানো নির্দেশে বাহারের পথের কাঁটা হননি, তবে এরপর আবার শুরু হয় তাদের দ্বৈরথ।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন হওয়ার পর ২০১২ সালে প্রথম নির্বাচন নির্দলীয় প্রতীকে হলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছিল আফজলকে। বর্ষীয়ান এই নেতা হেরে যান সাক্কুর কাছে। তখন হারের জন্য তিনি বাহারকেই কাঠগড়ায় তুলেছিলেন।
এরপর দুই বছরের মাথায় ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত বিএনপিবিহীন নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী বাহারের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়াইয়ে নামেন আফজল খানের ছেলে মাসুদ পারভেজ খান ইমরান। বাহারের জয় ঠেকাতে না পারলেও ৩৮ হাজার ভোট পান তিনি।
এর তিন বছরের মাথায় দলীয় প্রতীকে সিটি করপোরেশন নির্বাচন আসে এবং তাতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করে আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে।
সেই নির্বাচনে সীমা ১১ হাজার ভোটে হেরে যাওয়ার পর পরাজয়ের জন্য বাহারের দিকেই তোলেন অভিযোগের আঙুল।
এরপর ২০২২ সালের মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বাহারের অনুসারী রিফাতকে প্রার্থী করলে ইমরান স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন, তবে কেন্দ্রের নির্দেশে ভোটের মাঠ ছেড়ে দেন।
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বাহার নির্বাচিত হন। আর সীমাকে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য করা হয়।
তবে গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তারা দুজনই আবার মুখোমুখি হয়ে যান। বাহার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন, সীমা নামেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে। তবে এবারও হারতে হয় আফজল পরিবারকে।
সীমা কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হিসাবে রয়েছেন। এই কমিটির সভাপতি বাহার। তার মেয়ে তাহসীন রয়েছেন সাংগঠনিক সম্পাদক পদে।
আফজল খান ২০২১ সালে মারা যান, তার ছেলে ইমরানও মারা গেছেন এক বছর হলো। এখন পারিবারিক দ্বন্দ্বের উত্তরাধিকার নিয়ে চলছেন সীমা।