Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

প্রণোদনায় কাটছাঁট : রপ্তানি বাড়াতে কৌশল কী 

রপ্তানিতে প্রণোদনা থেকে সরকারের বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তে উদ্বিগ্ন  পোশাকসহ অন্যান্য শিল্প সংশ্লিষ্টরা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
রপ্তানিতে প্রণোদনা থেকে সরকারের বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তে উদ্বিগ্ন পোশাকসহ অন্যান্য শিল্প সংশ্লিষ্টরা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

পণ্য রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা দেওয়া থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তার হার অল্প অল্প করে কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বলা হয়েছে, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটতে যাচ্ছে। তাই নিয়ম অনুযায়ী রপ্তানিতে প্রণোদনা দেওয়া যাবে না।

তবে ভর্তুকিতে কাটছাঁট চললে রপ্তানির বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা উদ্যোক্তাদের ক্ষতিতে ফেলবে।

হুট করে ভর্তুকি কমানো হলে অনেক শিল্পের বিকাশ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাই পরিকল্পনা করে ধাপে ধাপে তা কমানো উচিত বলে পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের।

ব্যবসায়ীদের অনেকে বলছেন, গত কয়েক বছরে সব ধরনের জ্বালানির দাম কয়েক গুণ বেড়েছে, এ অবস্থায় প্রণোদনাটা বাড়বে বলে তারা আশা করছিলেন। কিন্তু হচ্ছে তার উল্টোটা। সরকারের এই নীতি সময়োচিত হয়নি বলে মনে করছেন তারা।  

গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলারে জানিয়েছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানির বিপরীতে প্রচলিত নগদ সহায়তার হার ও কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা গত ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর ধরা হবে।

চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য (জানুয়ারি-জুন) রপ্তানির বিপরীতে প্রণোদনার নতুন হার ঘোষণা করা হয়েছে। এতে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশে উত্তরণের বিষয়টি সামনে রেখে তৈরি পোশাক, হস্তশিল্প, প্লাস্টিক, কৃষি, চামড়াসহ ৪৩ খাতের পণ্যে রপ্তানির বিপরীতে বিভিন্ন হারে আর্থিক প্রণোদনা কমানো হয়েছে।

প্রণোদনার নতুন হার অনুযায়ী, পণ্যভেদে প্রণোদনা কমেছে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ থেকে স‌র্বোচ্চ ১৫ শতাংশ প্রণোদনা পাবেন রপ্তানিকারকরা। আগে যা ছিল ১ শতাংশ থেকে স‌র্বোচ্চ ২০ শতাংশ।

দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোয় সরকারের নতুন নীতি কতটা প্রভাব ফেলবে—তা নিয়ে এরই মধ্যে তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে।

হুট করে ঘোষিত এই নীতির কারণে সংকটকালে দেশ আরও ডলার সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ডলার সংকটের এ সময়ে পণ্য রপ্তানি বাড়ানো জরুরি, তবে রপ্তানি সেভাবে বাড়ছে না।

কোভিড-১৯ অতিমারী পরবর্তী সময়ে নগদ প্রণোদনাসহ বিভিন্ন নীতি সহায়তা পাওয়ায় দেশের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়ে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের রপ্তানির পরিমাণ বাড়ে ৩৪.৩৮ শতাংশ।  ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি ডলার ও ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ছিল ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার।

আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। তবে প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে, রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৭৫৪ কোটি ডলারের পণ্য। এ ৬ মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ৮৪ শতাংশ।

গত অর্থবছরে রপ্তানিতে প্রণোদনার জন্য ৯ হাজার ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা এখনও পরিশোধ করা হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

হস্তশিল্প মালিকদের সমিতি বাংলাক্রাফটের সভাপতি এস ইউ হায়দার বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “২০২২ সালের বেশকিছু অর্ডারে প্রণোদনার অর্থ এখনও বাকি আছে, আর ২০২৩ সালেরটা, সেটা বাদই দেন।”  

রপ্তানি আয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখা তৈরি পোশাক শিল্পে নতুন প্রণোদনা নীতি অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুঁকি ও বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে মনে করছে শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

ক্ষুদ্র রপ্তানিকারকরা বলছেন, ন্যূনতম কোনও আলোচনা না করে প্রণোদনা কমানো সংকট আরও বাড়িয়ে তুলবে। পরিকল্পনা সাজানোর সময় ও সুযোগ পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ তাদের।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা-নির্ভর কাঠামো থেকে বেরিয়ে উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতানির্ভর বাজারের দিকে ঝুঁকতে হবে।

তবে পরিকল্পনা মোতাবেক প্রণোদনা কমানোর পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। তারা বলছেন, সরকারকে প্রণোদনায় টাকা নষ্ট না করে পরিকল্পনা গ্রহণ করে সহায়তা দিতে হবে অন্য উপায়ে। টাকা খরচ করতে হবে শিল্পকে আধুনিকায়ন ও টেকসই করতে, যাতে পণ্যের ধরন পাল্টে বিশ্ববাজারে জায়গা করে নিতে পারে বাংলাদেশের পণ্যগুলো।

পরিকল্পনা না করে প্রণোদনা কমানো হলো কেন

সম্প্রতি হস্তশিল্পকে বর্ষপণ্য ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। তখন এই ক্ষুদ্র শিল্পে যারা যুক্ত রয়েছেন তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়। তবে প্রণোদনা কমানোর নীতি তাদের নিরাশ করেছে।

হস্তশিল্প মালিকদের সমিতি বাংলাক্রাফটের সভাপতি এস ইউ হায়দারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ফ্রাঙ্কফ্রুটে মেলা চলছে, হস্তশিল্পের অন্যতম বড় বৈশ্বিক মেলা। আমাদের ৬০ শতাংশের মতো অর্ডার এই মেলা থেকে হয়।

“সেই মেলায় যেই রপ্তানিকারকরা গিয়েছে, তারা সবাই কান্নাকাটি শুরু করেছে। তারা তো ১০ শতাংশ প্রণোদনা ধরেই পণ্যের দাম ঠিক করেছে, এখন হঠাৎ করে ২ শতাংশ কমিয়ে দেওয়াতে তাদের তো সবার মাথায় হাত।”

পূর্ব ঘোষণা না দিয়ে প্রণোদনা কমানোর অভিযোগ করে তিনি বলেন, “আমাদের সাথে একবার কথা বলা হলো না, হুট করে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ঘোষণা দিয়ে দিল। এভাবে তো হতে পারে না। আমাদের সাথে ব্যাংক বা মন্ত্রণালয় কেউ তো একজন কোনও কথা বলবে। আমাদের প্ল্যান করার সুযোগ তো দিতে হবে।”

“প্রধানমন্ত্রী হস্তশিল্পকে বর্ষপণ্য ঘোষণা করলেন, তা নিয়েও তো আমাদের সাথে কোনও কথা হলো না। এ বছর তাহলে আমাদের খাত কী বিশেষ সুবিধা পাবে, তা নিয়ে কিছুই আলাপ হলো না, কিন্তু প্রণোদনা কমিয়ে দেওয়া হলো।”

একই অভিযোগ প্লাস্টিক শিল্প উদ্যোক্তাদেরও। সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ প্লাস্টিক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি শামীম আহমেদের সঙ্গে।

তিনি বলেন, “এ সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। আমরা সব অর্ডার হাতে নিয়েছি, এই অর্থের পরিমাণ মাথায় রেখে। এখন হঠাৎ করে এটা কমিয়ে দিলে আমরা সেই অর্ডারগুলো করব কীভাবে।

“এ সিদ্ধান্তে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে গেল। এলডিসি বাস্তবায়ন করতে হবে আমরা জানি, কিন্তু তাই বলে আমাদের নিয়ে একটি পরিকল্পনা করা হচ্ছে তাতে আমাদের কোনও অংশগ্রহণ নেই, এ তো উচিত না।” 

শামীম আক্ষেপ করে বলেন, “এমনিতেই আমাদের রপ্তানির অবস্থা ভালো না, ডলার ও জ্বালানি সংকটে আমরা রয়েছি। সরকারের এ সিদ্ধান্ত আমাদের মতো রপ্তানিকারকদের হতাশ করবে।

“যখন আমরা স্বপ্ন দেখছি বাংলাদেশে প্লাস্টিক শিল্প সামনে রপ্তানিতে এগিয়ে যাবে, বৈশ্বিক বাণিজ্যে বড় ভূমিকা রাখবে, তখন এরকম সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী হয়নি।”

আর্থিক সহায়তা না, টেকসই শিল্প গড়ার লক্ষ্যে করতে হবে বিনিয়োগ

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নগদ সহায়তা দিয়ে হবে না, আর্থিক সহায়তাটা অন্য উপায়ে উদ্যোক্তাদের দিতে হবে। আরও একটু লক্ষ্য ঠিক করে টাকা খরচ করতে হবে। টাকাটাকে এমনভাবে বিনিয়োগ করতে হবে যাতে উদ্ভাবনশীলতা, উৎপাদন ক্ষমতা এবং সৃজনশীলতা বাড়ে, যাতে পণ্যের ধরনই পাল্টে যায়, আর বৈশ্বিক বাজারের জন্য প্রস্তুত হয় ক্ষুদ্র শিল্পগুলো।

সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এম আকাশের সঙ্গে। পরিকল্পনা না করে হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে নন তিনি।

তিনি বলেন, “যেকোনো শিল্পের উপর আকস্মিক কোনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে একটি ক্রাইসিস তৈরি হয়। সেই ক্রাইসিস যে উদ্যোক্তা পার করতে পারেন না, তার ব্যবসাই বন্ধ হয়ে যায়। এরকম সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া উচিত না, আর যদি সিদ্ধান্ত নিতেই হয় তাহলে পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করা দরকার।

“সহজ নিয়ম হলো, যেকোনো প্রণোদনা হতে হয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সময় ঠিক করে প্রণোদনা দিতে হয়। অনন্তকাল ধরে কোনও প্রণোদনা অর্থনীতিবিদরা সুপারিশ করবে না।”

প্রণোদনা দেওয়ার সময় প্রথমেই সময় নির্দিষ্ট করে দিতে হয়, কীভাবে প্রণোদনা ধাপে ধাপে কমবে, সেই পরিকল্পনা করতে হয় বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, “নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিল্পকে টেকসই অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে, এটাই অর্থনীতির নিয়ম। ধাপে ধাপে শিল্প সংশ্লিষ্টদের প্রস্তুত করার মাধ্যমে পরিকল্পনা মোতাবেক প্রণোদনা কমাতে হয়।”

পরিকল্পনার অভাব সরকারের রয়েছে মন্তব্য করে এম এম আকাশ বলেন, “যখন প্রণোদনা ঠিক করে দেওয়া হলো, তখন সময় ঠিক করে দেওয়া হয়নি। এখন যখন প্রণোদনা কমানো হচ্ছে তখন স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি রপ্তানিকারকরা প্রস্তুত না।

“সরকারের উচিত ছিল আগে জানিয়ে দেওয়া, আমরা এতদিনের মধ্যে প্রণোদনা কমিয়ে নিয়ে আসব, ততদিনের মধ্যে তোমরা তোমাদের পরিকল্পনা কর, প্রস্তুত হও। হঠাৎ করে কমানোটা ন্যায়সংগত বা যুক্তিযুক্ত নয়।”

তিনি বলেন, “ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোর জন্য সরকারের কিছু নীতি আছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। যেমন- এসব শিল্পের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পাওয়ার কথা, কিন্তু ব্যাংকগুলো তা করে না।”

ভারত বা বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য নীতিগুলো দেখে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সংশোধন করা উচিত বলে মনে করেন এম এম আকাশ।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে কথা হয়। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যেসব শিল্প বিকশিত হয়নি, সেসবে কিন্তু অনেক প্রণোদনা দেওয়া হয়।

“এবারের ঘোষণাতেও পাটে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া আছে, ২০ শতাংশ পর্যন্তও দেওয়া ছিল, কিন্তু তাতে এসব শিল্পে বড় উল্লম্ফন হয়েছে, তা কিন্তু না। আমাদের অন্য কিছু করতে হবে, ভুর্তকি দিয়ে আমরা এটা অর্জন করতে পারব না।”

শিল্পগুলোর জন্য বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন জানিয়ে আইএমএফের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “আমাদের এসব খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হবে, তাদের থেকে হয়তো আমরা অনেক কিছু শিখতে পারব। একইসঙ্গে তারা হয়তো বাজারটাও সাথে নিয়ে আসতে পারবে বাংলাদেশে।”

নিজেদের শিল্পকে আধুনিক না করার কোনও বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের প্রযুক্তি আধুনিকায়ন করতে হবে, আমাদের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে আধুনিক করতে হবে। এগুলো যদি আমরা না করতে পারি তাহলে ওই পাটের সিকা বিক্রি করে আমরা বাজারে দাঁড়াতে পারব না। 

“শিল্পগুলোতে উদ্ভাবনশীলতা আমাদের বাড়াতে হবে, নতুনত্ব আনতে হবে, টেকসই করতে হবে, পণ্যের গুণগত মান বাড়াতে হবে—এগুলো না করতে পারলে তৈরি পোশাক শিল্পের বাইরে আমরা নতুন কোনও বাজার তৈরি করতে পারব না।”

সরকারের সহায়তা দিতেই হবে, কিন্তু তা ব্যবসাকে টেকসই করার করার জন্য বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আর্থিক প্রণোদনাটা অন্য উপায়ে উদ্যোক্তাদের দিতে হবে। সরকারের এসব খাত সংশ্লিষ্টদের প্রযুক্তিগত সাহায্য করতে হবে, নতুন পণ্যের জন্য গবেষণা কেন্দ্র করতে হবে। তাদের জন্য দরকার পড়লে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠাতে হবে। তারপর তাদের বাংলাদেশে কাজে নিয়োগ করতে হবে শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।”

প্রণোদনা ফেরত চায় বিজিএমইএ

সরকরের নতুন প্রণোদনা নীতি শিল্পের জন্য মোটেও সহায়ক ও সময়োপযোগী নয়, বরং এটি শিল্পে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুঁকি ও বিপর্যয় ডেকে আনবে মনে করছে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান দেশের বাইরে থাকায় সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এস এম মান্নান (কচি) স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে এস এম মান্নান বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রণোদনা ছাড়া বাকি সব প্রণোদনার হার ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ কমানো হয়েছে। লক্ষণীয় যে, যদিওবা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রণোদনার হার কমানো হয়নি, তবে অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানার উৎপাদন ও রপ্তানি কিছু বেসিক পণ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, বিশেষ করে টি-শার্ট, ট্রাউজার ও সুয়েটার। এই পণ্যগুলো সামগ্রিক প্রণোদনা ব্যবস্থা থেকে বাদ দেওয়ায় মূলত এসব পণ্য রপ্তানিকারী ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো কোনও প্রণোদনাই পাবে না। আমাদের মোট পোশাক রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠিানের মধ্যে ৬০ শতাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণির।

এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী সময়ে বিকল্প প্রণোদনা প্রবর্তনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারটিতে কোনও উল্লেখ নেই বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ।

তারা বলছে, অনেক মধ্যম আয়ের দেশ তাদের শিল্পের জন্য সরাসরি প্রণোদনা না দিয়ে বিকল্প প্রণোদনা দিয়ে আসছে। বিকল্প প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণায়ও উঠে এসেছে। বিকল্প ব্যবস্থা না করে হঠাৎ প্রচলিত ব্যবস্থা কর্তন শিল্প ও অর্থনীতির জন্য সহায়ক পদক্ষেপ বলে তারা মনে করে না।

প্রধান ৩টি অপ্রচলিত বাজার- জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রণোদনা বাদ দেওয়া হয়েছে নতুন নীতিতে।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বলেন, “২০২২-২৩ অর্থবছরে এই ৩টি বাজারে আমাদের পোশাক রপ্তানি ছিল ৩.৭৭ বিলিয়ন ডলার, যা আমাদের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ৮ শতাংশ। বিগত প্রায় ১৪ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম, বিনিয়োগ ও সরকারের সহায়তার মাধ্যমে আমরা এই বাজারগুলো তৈরি করতে পেরেছি।

“চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে যখন আমাদের প্রধান দুটি বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে রপ্তানি কমেছে যথাক্রমে ৫.৬৯ শতাংশ ও ১৭.০৫ শতাংশ, তখন প্রণোদনা থেকে বাদ পড়া তিনটি নতুন বাজারে আমাদের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪৩.৫৬ শতাংশ। এই বাজারগুলো বাদ দেওয়ার ফলে সেখানে আমাদের রপ্তানি বিপর্যস্ত হবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারের ফলে পোশাকখাতে প্রচলিত প্রণোদনার প্রায় ৭০ শতাংশ প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

তিনি বলেন, যেখানে চলতি অর্থবছরের শুরুতে গতবছরের ২৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলারের মাধ্যমে সব প্রণোদনার হার ও কাঠামো ঘোষণা করে তা চলতি অর্থবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত জাহাজীকৃত পণ্যের উপর কার্যকর থাকবে বলে ঘোষণা করা হয়। এই প্রণোদনাগুলো বেশকিছু বছর ধরে কার্যকর রয়েছে। ঘোষিত প্রণোদনা অনুযায়ী কারখানাগুলো অর্ডার কনফার্ম করেছে ও বিনিয়োগ করে ফেলেছে। এখন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়া হঠাৎ এরকম একটি গুরুতর সিদ্ধান্ত শিল্পকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করবে।

গত ৫ বছরে ডিজেলের মূল্য ৬৮ শতাংশ, গ্যাসের মূল্য ২৮৬.৫ শতাংশ ও বিদ্যুতের মূল্য ২১.৪৭ শতাংশ বাড়ায় পরিবহন খরচসহ সার্বিক উৎপাদন খরচ বেড়েছে বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে ন্যূনতম মজুরি বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। নতুন ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নের পর শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে, অধিকাংশ ক্রেতাই মূল্য সমন্বয় করছেন না। ফলে পণ্যের দরপতন, চাহিদা হ্রাস ও বর্ধিত উৎপাদন খরচ মিটিয়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে সরকারের এই পদক্ষেপটি শিল্পকে এক গভীর সংকটে ফেলবে।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে শিল্প ও শ্রমখাতে যেন কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে সেজন্য কারখানাগুলো আর্থিক চাপে থাকলেও ব্রেক-ইভেন মূল্য এমনকি লোকসান দিয়েও উৎপাদন ও শ্রমিকের কর্মসংস্থান ধরে রাখা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এস এম মান্নান।  

তিনি বলেন, “আমাদের প্রত্যাশা ছিল সরকার ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পোশাকখাতের জন্য বিশেষ নীতি সহায়তা প্রদান করবে।”

দেশে প্রণোদনা প্যাকেজ যখন কাটছাঁট করা হচ্ছে, তখন প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের শিল্পের জন্য সহায়তা বৃদ্ধি করছে উল্লেখ করেন তিনি।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভিয়েতনামের এফটিএ (মুক্তবাণিজ্য চুক্তি) গত বছর কার্যকর হয়েছে, ফলে ইউরোপে তাদের শুল্ক প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গেছে, যা ২০৩০ সাল নাগাদ শুল্কমুক্ত হবে বলে জানান এস এম মান্নান।

তিনি বলেন, “২০২৯ এর পর আমরা ডাবল ট্রান্সফরমেশনের চ্যালেঞ্জে পড়ব। এরকম একটি সময়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড ওরগানাইজেশনের বিধান অনুযায়ী যতদিন আমরা স্বল্পোন্নত দেশের সুবিধা ভোগ করছি, ততদিন পর্যন্ত নগদ সহায়তাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে দেওয়া অধিক যুক্তিযুক্ত ছিল, যার মাধ্যমে শিল্পকে আমরা টিকিয়ে রাখতে পারতাম।”

অন্যান্য সুবিধার নিশ্চয়তা না দেওয়া পর্যন্ত প্রণোদনা দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

বর্তমান বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলা করে ২০৪১ সাল নাগাদ দেশের অর্থনীতিকে একটি উন্নত অর্থনীতির দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকার শিল্প ও দেশের স্বার্থে এই পদক্ষেপটি পুনঃবিবেচনা করবে বলে তার আশা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত