Beta
বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫
Beta
বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫

অন্য সব ঘূর্ণিঝড় থেকে রেমালের ব্যতিক্রমী আচরণ

ঘূর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হানার পরদিন সোমবারও বরিশালের কীর্তনখোলা নদী ছিল উত্তাল।
ঘূর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হানার পরদিন সোমবারও বরিশালের কীর্তনখোলা নদী ছিল উত্তাল।
[publishpress_authors_box]

বঙ্গোপসাগরে সুপার সাইক্লোনের সৃষ্টিও দেখেছে বাংলাদেশ; সেই তুলনায় ঘূর্ণিঝড় রেমাল অনেক কম শক্তির; তারপরও এই ঝড়টির কিছু ব্যতিক্রমী আচরণ ধরা পড়েছে গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশের পর্যবেক্ষণে।

কানাডার সাসকাচুয়ান ইউনিভার্সিটির স্কুল অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটির এই পিএইচডি গবেষক বলছেন, উপকূলে আঘাত হানার বেশ কিছু সময় পরও বাতাসের গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার, এমনটা আগে দেখা যায়নি।

প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়ে রবিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূল দিয়ে স্থলভাগে উঠে আসে ঘূর্ণিঝড় রেমাল।

আবহাওয়াবিদরা আগেই আভাস দিয়েছিলেন, রেমালে ঘূর্ণিবায় উঠতে পারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত। যেখানে সুপার সাইক্লোন আম্পানে বাতাসের গতি ২২০ কিলোমিটার ছাড়িয়েছিল।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, সোমবার সকালে ‘রেমাল’ দুর্বল হয়ে গভীর নিম্নচাপ হয়ে যশোর এলাকায় অবস্থান করছিল। এটি আরও আরও উত্তরপূর্ব দিকে এগিয়ে যাবে এবং বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে নিঃশেষ হয়ে যাবে।

এই পর্যায়েও রেমালে বাতাসের তীব্রতা ১০০ কিলোমিটার দেখতে পাওয়ার কথা জানিয়ে মোস্তফা পলাশ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আজ দুপুর ৩টার সময়ও ঘণ্টায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার গতিবেগের বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলার উপর দিয়ে।

“অর্থাৎ, গতকাল (রবিবার) রাতে যে গতিবেগে রেমাল উপকূলে আঘাত করেছিল, তার প্রায় কাছাকাছি গতিবেগে এখনও বাতাস প্রবাহিত খুলনা ও বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলার উপর দিয়ে।”

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রেনাল উপকূলে আঘাত হানার সময় এর কেন্দ্রে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ উঠেছিল পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায়, রাত দেড়টায়। তখন ঘণ্টায় ১১১ কিলোমিটার বেগে বাতাস বইছিল।

ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগের কলকাতার রাডারের চিত্র বিশ্লেষণ করে আবহাওয়া বিষয়ক গবেষক মোস্তফা পলাশ বলেন, ১৫ ঘণ্টা পরও সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা জেলার একাধিক উপজেলার উপর দিয়ে সোমবার দুপুর ৩টায় ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১০০ কিলোমিটার গতিতে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল।

“ঘুর্ণিঝড় রেমাল এমন কিছু উদাহরণ সৃষ্টি করছে, যা ইতোপূর্বে বাংলাদেশের কোনও ঘুর্ণিঝড় সৃষ্টি করেনি।,” বলেন তিনি।

ঝড়ের পরে এমন বাতাস বইছিল নোয়াখালীর হাতিয়ায়।

রেমালের প্রভাবে ব্যাপক বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা আগেই জানিয়েছিলেন মোস্তফা পলাশ। তিনি এখন বলছেন, “অনেক বেশি সম্ভাবনা রয়েছে আরও একদিন পুরো বাংলাদেশের উপর দিয়ে ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে বাতাস প্রবাহিত হওয়া অব্যাহত থাকবে। সেইসঙ্গে কমপক্ষে আরও ২৪ ঘণ্টা উপকূলীয় এলাকাগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৬ ফুট বেশি উঁচু জোয়ারে প্লাবিত হবে।”

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী, গবেষক পলাশ যে কথাটি বলেছেন, তেমনটাই দেখছেন বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানান পিরোজপুরে বাসিন্দা তরিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় যে রকম বাতাস, সেরকম পানির চাপ। পিরোজপুরের মানুষ এ অবস্থা আগে দেখেনি।”

দূর্যোগপীড়িত আরেক জেলা সাতক্ষীরার সর্বদক্ষিণের উপজেলা শ্যামনগরের রাশেদ ভূইয়াও বাতাসের প্রবল শক্তি দেখছেন এখনও।

বাগেরহাটে নদীতে পানি স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় চার থেকে আট ফুট বেশি বেড়েছে। জলোচ্ছ্বাসে কয়েক জায়গার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ভেসে গেছে বহু মাছের ঘের।

খুলনার দাকোপ উপজেলায় প্রায় ছয় থেকে সাতটি রিসোর্ট রয়েছে। তার মধ্যে সুন্দরবনের একেবারেই গা ঘেঁষে রয়েছে ইরাবতী ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার।

রিসোর্টটির পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস মানুও বাতাসের তোড়ে প্রচুর গাছপালা ভেঙে পড়ার কথা জানিয়েছেন।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ইরাবতী শেষ …. সব রুমে পানি ঢুকছে হুহু করে। “

রবিবার রাত ১১টার দিকে রিসোর্টে অবস্থানরত কর্মীদের সঙ্গে কথা হয়েছিল মানুর, এরপর থেকে আর যোগাযোগ করতে পারছেন না।

ঘূর্ণিঝড় রেমালের তোড়ে বরিশালের বিভিন্ন স্থানে ভেঙে পড়েছে গাছ।

সুন্দরবনের ভেতরে পর্যটকদের নিয়ে জালি নৌকায় (দোতলা নৌকা) ঘুরে বেড়ান ৫৫ বছরের শরীফুল। বনের ভেতরে ছোট একটা নদীর পাড়ে তিনি নৌকা নোঙর করে রেখেছেন।

পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি ইরাবতী রিসোর্টের মানুকে বলেছেন, এত বাতাস তিনি তার জীবনে আগে দেখেননি।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী ২৪ বছর ধরে খুলনায় থাকেন। ২০০৭ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং এর দুই বছর পর আইলাও দেখছেন। তবে এবারের রেমাল ‘অন্য রকম’ ঠেকছে তার কাছেও।

অধ্যাপক হারুন বলেন, “সিডবেরর সময়ে ব্যাপ্তি এলাকা ছিল কম, কিন্তু বাতাসের গতিবেগ ছিল অনেক বেশি। কিন্তু রেমালের এলাকা অনেক বেশি, যার কারণে এর ক্ষতি অনেক এলাকাজুড়ে হবে। আর রেমালের তাণ্ডব গতকাল দুপুরের পর থেকে শুরু হয়েছে, সেটা এখনও চলছে।”

রেমালের সঙ্গে সাগরের জোয়ার দুই মিলে ক্ষতি বেশি বলে মনে করেন তিনি।

“গতকাল থেকে এখন পর্যন্ত তিনবার জোয়ার পেয়েছে। রেমাল এবং জোয়ার মিলে ক্ষতিটা অনেক বেশি হয়ে গেল আমাদের।”

ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) নির্বাহী পরিচালক এবং সাউথ এশিয়ান মিটিওরোলোজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (সামা) যুগ্ম সম্পাদক মোহন কুমার দাশও রেমালের ব্যতিক্রমী আচরণের বিষয়টি সামনে এনেছেন।

তিনি বলছেন, “গত কয়েক দশকে অনেকগুলো ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে, প্রধানত উপকূলীয় ও সংলগ্ন অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি করেছে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রেমাল প্রায় সারাদেশেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব ৪০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে স্থায়ী হওয়ার ঘটনা- এক ধরনের ব্যতিক্রম।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত