ছিল স্বাচিপের নিয়ন্ত্রণ, এখন তা হয়ে যাচ্ছে ড্যাবের, সরকার পতনের পর সরকারি হাসপাতালগুলোতে এমন চিত্রই দেখছেন চিকিৎসকরা। এ দেখে তারা বলছেন, এতে চিকিৎসা ব্যবস্থার তো কোনও উন্নতি হচ্ছে না, বরং ক্ষতিই হচ্ছে।
গত দেড় দশক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার মধ্যে এই দলের সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল চোখে পড়ার মতো। চিকিৎসক নিয়োগ, বদলিসহ হাসপাতালগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদেরই হাতে।
তার আগে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত একই ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল বিএনপি সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকে (ড্যাব)।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর স্বাচিপকে হটিয়ে হাসপাতালগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে আবার ড্যাবের চিকিৎসকরা সক্রিয় হয়ে উঠছে।
সাধারণ চিকিৎসকদের অভিযোগ, রাজধানী ঢাকার সব হাসপাতালে তৎপর এখন ড্যাবের নেতারা। হাসপাতাল ভাংচুর করে চিকিৎসকদের হুমকি দিচ্ছে। বিভিন্ন জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান থেকে শেখ হাসিনার ছবি নামানোর কাজও করছে তারা। এমনকি রাখছে না বঙ্গবন্ধুর ছবিও।
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বড় পদগুলোতে স্বাচিপের নেতারা বসেন। যোগ্যতা থাকলেও ড্যাবের চিকিৎসক এবং যেসব চিকিৎসক কোনও দল করেন না, তারা ছিলেন পদবঞ্চিত।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনে বিএনপি ক্ষমতায় না এলেও ড্যাবের চিকিৎসকরা এখন হাসপাতালগুলোতে ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া। তাদের ভয়ে হাসপাতালে আসতে পারছেন না স্বাচিপ চিকিৎসকরা।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের আগের দিন গত ৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাংচুর চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়। ভাংচুর হয় হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় প্রশাসনিক ভবন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টি বিভাগের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে মেডিকেল অফিসার, সবই স্বাচিপের সদস্য, প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও তাই। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর থেকে তারা কেউ হাসপাতালে আসছেন না।
“এমন পরিস্থিতিতে অন্য পক্ষ ভেবেছে, ওরা ক্ষমতায় এসে গেছে। এরমধ্যে বিশেষ করে যেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলেন, সেদিন থেকে ড্যাবের চিকিৎসকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে।”
কক্ষ দখল, প্রশাসনিক ভবনসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের নামফলকসহ ভেঙে ফেলা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বি ব্লকে অবস্থিত চিকিৎসকদের হোস্টেল ভেঙেছে, তালা মেরেছে, আমাদের নেইম প্লেইট ভেঙেছে, যাকে পাচ্ছে তাকেই হুমকি দিচ্ছে- এ এক অরাজক অবস্থা!”
“গত কয়েকদিনে যত পরীক্ষা ছিল সব বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি, রুটিনে থাকা বড় বড় অপারেশনগুলোও বন্ধ রয়েছে,” বলেন তিনি।
এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাচ্ছে চিকিৎসার জন্য আসা সাধারণ মানুষ।
এই চিকিৎসক বলেন, “ইনডোর-আউটডোর সব জায়গায় রোগীদের ভোগান্তি। আমরা না হয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কিন্তু যারা চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত, সেসব চিকিৎসকরাও হাসপাতালে আসতে ভয় পাচ্ছেন। আমরা তো তাদের কোনও নিরাপত্তা দিতে পারছি না, তাই তাদেরকে জোরও করতে পারছি না। এরপরও যেসব চিকিৎসক আসছেন, তারা নিজ দায়িত্বে আসছেন।”
পদত্যাগ করবেন কি না- এ প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা অধ্যাপক পদমর্যাদার এই চিকিৎসক বলেন, “নতুন সরকার যা আদেশ করবে, তাই হবে। আমাদের যদি বাদ দিতে হয়, তাহলে বহিষ্কার করতে হবে অথবা পদত্যাগ করার আদেশ দিতে হবে। সরকারকে আদেশ দিতে হবে। তার আগ পর্যন্ত আমরা পদত্যাগ করবো না।”
গত বৃহস্পতিবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নিয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েছেন নূর জাহান বেগম। তবে এখনও তিনি কিছু বলেননি।
বিএসএমএমইউর আরেক চিকিৎসক বলেন, “নদীতে জেগে ওঠা চর যেভাবে ক্ষমতাবানরা দখল করে নেয়, সেভাবে হাসপাতালগুলো দখল হচ্ছে। সব বিভাগের চিকিৎসকদের তারা হুমকি দিচ্ছে।
“তারা যে আগের দলের মতোই দখলবাজির একই বৃত্তে ঘুরছে, সেটা তারা বুঝছে না। ওরা ভেবেছে ওরা ক্ষমতায় চলে এসেছে, সেই দম্ভ দেখাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টা এত সহজ না, তারা বুঝছে না।”
বিএনপির সমর্থক চিকিৎসকদের দীর্ঘদিন বঞ্চিত থাকাটা ‘অন্যায়’ ছিল মন্তব্য করে এই চিকিৎসক বলেন, “কিন্তু এটা একটা সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে ঠিক করতে হবে। কিন্তু তারা যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করছে, সেটা একদম ঠিক নয়।”
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের এক চিকিৎসকের কাছ থেকেও জানা যায়, সরকার পতনের পরদিন থেকে বর্তমান পরিচালক আসেননি। ড্যাব নেতারা এসে মুখ দেখিয়ে গেছে।
একই অবস্থা জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের। এই হাসপাতালে ড্যাব চিকিৎসকদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। তারপরও বাইরে থেকে এসে ভাংচুর করা হয়েছে বলে জানান একজন চিকিৎসক।
মহাখালীর শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালেও আসছেন না অনেক চিকিৎসক। হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম কিবরিয়া জানান, হাসপাতালে ভাংচুর করা হয়েছে, হাসপাতালের নাম ফলক থেকে শেখ রাসেল মুছে ফেলা হয়েছে।
মহাখালীতে পুরান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাশে স্বাস্থ্য বিভাগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিষ্ঠান নিপসম, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস), জাতীয় পুষ্টি প্রতিষ্ঠান। এই তিন প্রতিষ্ঠানের প্রায় সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিসে আসছেন না। আবার কেউ এলেও খুবই অল্প সময় থেকে চলে যাচ্ছেন।
এদের কয়েকজন বলেন, সেখানে ড্যাবের চিকিৎসকরা না থাকলেও স্থানীয় বিএনপি সমর্থকরা হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। গত ৭ আগস্ট নিপসমে স্থানীয় বিএনপি সমর্থকরা এসে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনার ছবি নামিয়ে যায়।
স্বাচিপের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান ড্যাবের তৎপরতা নিয়ে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, এরকম পরিস্থিতিতে যে কোনও চিকিৎসক সংগঠনের হঠকারিতা রোগী তথা দেশের কল্যাণের বদলে ভোগান্তি বাড়াবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিএনপি সমর্থিত কিংবা সাধারণ চিকিৎসকরা বঞ্চিত হয়েছেন কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমার বিভাগেই (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) বিএনপি সমর্থিত অনেক চিকিৎসক অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন, বাকিরা তো আছেনই।
“তবে কিছু কিছু জায়গায় নিশ্চয়ই কেউ কেউ বঞ্চিত হয়েছেন, এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। আমি অস্বীকার করতে পারবও না।”
চিকিৎসকদের অভিযোগের বিষয়ে ড্যাবের সাবেক সভাপতি এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি এগুলো কিছু জানি না, ধারণাও নাই। কেউ আমাকে জানায়ওনি।”
এই পরিস্থিতিতে কোনও ধরনের অনিয়মে জড়িত না হতে নেতা-কর্মীদের কঠোর বার্তা দিয়েছে বিএনপি।
সেই সুরে ডা. জাহিদও বলেন, “জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন কোনও চিকিৎসক হাসপাতাল ভাংচুর, চেয়ার দখল করার মতো কিছু করতে পারে না।
“আমি পরিষ্কার করে একটা কথা বলতে চাই, কোনও নেতা-কর্মীরা যদি কোনও অনিয়ম করে থাকেন, তাহলে সেটা মেনে নেওয়া হবে না, এ বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
এই প্রেক্ষাপটে জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সালের মত, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশায় রাজনৈতিক দলাদলি থাকাই উচিৎ নয়।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এসব পেশাজীবীরা মানুষের জন্য কাজ করে। কিন্তু দলাদলির মতভেদে তাদের আসল কাজ ব্যাহত হয়। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দমিয়ে রাখে, যার প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষ অর্থাৎ পুরো দেশের ওপর।”