পর্যটন খাতের অন্যতম বিতর্কিত ধারণার একটি হচ্ছে ‘ডার্ক টুরিজম’। এই অদ্ভুত পর্যটন তত্ব মানুষ যে অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় ভ্রমণে যেতে চায়। ‘ডার্ক টুরিজম’ এ মানুষ এমন সব স্থানে ভ্রমণের কথা বলা হয় যেখানে ইতিহাসের কোনো এক সময়ে মৃত্যু, যন্ত্রণা, বা ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে।
যেমন, যুদ্ধক্ষেত্র, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, দুর্ঘটনার স্থল, ইত্যাদি। এমনকি ভুতূড়ে বা গা ছমছম করা পরিবেশে ভ্রমণও এ ধরনের পর্যটনের আওতায় পড়ে। গা শিউরে ওঠা বেদনা বা ভীতির অনুভূতি এই টুরিজমের প্রধান উপজীব্য।
উৎপত্তি এবং নামকরণ
‘ডার্ক টুরিজম’ টার্মটি ১৯৯৬ সালে প্রথম ব্যবহার করেন গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান ইউনিভার্সিটির দুই অধ্যাপক জন লেনন এবং ম্যালকম ফোলি। তাদের মতে, মানুষের মধ্যে মৃত্যু, ভয়, বিপদ, অত্যাচারের প্রতি একধরনের আকর্ষণ রয়েছে। এই আকর্ষণের কারণেই মানুষ এই ধরনের স্থানে ভ্রমণ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
ডার্ক টুরিজমের বাজার
২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপি ডার্ক টুরিজমের বাজার ছিল ৩ লাখ ১৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ। ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর এই বাজার ২ দশমিক ৯ শতাংশ হারে বাড়বে বলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্র্যান্ডভিউ রিসার্চ ডটকম জানাচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী ডার্ক টুরিজমের জনপ্রিয় স্থান
পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর ভুতূড়ে শহরে পরিণত হওয়া ইউক্রেইনের চেরনোবিল, জার্মানির নাৎসিদের ভয়াবহ নির্যাতনের স্মৃতিচিহ্ন অশভিৎজ-বিরকেনৌ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, কম্বোডিয়ার খেমেররুজ ক্ষমতায় থাকাকালীন গণহত্যার স্থান তুল সিং সেন্ট্রে, অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত ইতালির প্রাচীন শহর পম্পেই, যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১ হামলার স্মৃতি বিজড়িত স্থান নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার মেমোরিয়াল ইত্যাদি।
এছাড়া এশিয়ার জাপানের এমন কিছু ডার্ক টুরিজমের স্পটও খুব বিখ্যাত। যেমন, ১৯৪৫ সালে পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞ ধরে রাখার স্থান হিরোশিমা ও নাগাসাকি পরমাণু বোমা স্মৃতিসৌধ, যুদ্ধ ও অত্যাচারের সাক্ষী ৫০০ বছরের পুরনো প্রাচীন শহর আজিকুকু হাশিমোৎ, মৃত্যু ও দুর্ঘটনার জন্য কুখ্যাত ‘জাহান্নামের রাস্তা’ হিসেবে পরিচিত সানরিকু ডেথ রোড, নির্জন দ্বীপ সেতো আইল্যান্ডে একটি মানসিক রোগীদের হাসপাতাল ইত্যাদিও ডার্ক টুরিস্টদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
ভারতে এই কিছুদিন আগেও ডাক টুরিজমের অতটা চাহিদা ছিল না। কিন্তু গবেষণা বলছে, আগামী দশ বছরে ভারতে ডার্ক টুরিজম বাড়বে ৫ শতাংশেরও বেশি হারে। অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগ, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সেলুলার জেল, গুজরাতের ভুজ, দিল্লির গান্ধী স্মৃতি, উত্তরাখণ্ডের রূপকুণ্ড লেক ইত্যাদি।
ডার্ক টুরিজমের মনোবিজ্ঞান
ডার্ক টুরিজমের প্রতি মানুষের আকর্ষণের পেছনে বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানগত কারণ রয়েছে।
জীবনের অর্থ খোঁজা: অনেকে মৃত্যু এবং ধ্বংসের সামনে দাঁড়িয়ে জীবনের মূল্য এবং নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বুঝতে চান।
ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ: ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মানুষ ইতিহাসের এক অংশ স্পর্শ করতে চায়।
অন্যের দুঃখের প্রতি সহানুভূতি: অনেক মানুষ অন্যের দুঃখের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে এবং তাদের স্মরণে এই ধরনের স্থানে যায়।
অনন্য অভিজ্ঞতা: ডার্ক টুরিজম অনেকের কাছে একটি অনন্য এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হতে পারে।
সমালোচনা
ডার্ক টুরিজমকে নিয়ে অনেক সমালোচনাও রয়েছে। অনেকে মনে করেন, এই ধরনের ভ্রমণ মৃত্যু এবং ধ্বংসের প্রতি অসম্মান। আবার অনেকে মনে করেন, এটি একটি বাণিজ্যিক উদ্যোগ মাত্র। তবে কেউ কেউ বলেন শিহরণ ও ভীতি জয় করার মানুষের যে আদিম প্রবৃত্তি ‘ডার্ক টুরিজম’ কেবল সেটাকেই গতিশীল করে।