Beta
বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫
Beta
বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

কীভাবে ডেইটিং ইনস্টাগ্রামে ‘রিয়েলিটি শো’ হয়ে উঠল

instagram-flirting
[publishpress_authors_box]

সোশ্যাল মিডিয়া এবং এর কন্টেন্ট এর পরিবর্তন প্রতিদিনই একটু একটু করে হচ্ছে। ২০১০ সালে ইনস্টাগ্রাম ছবি শেয়ারের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে যাত্রা শুরু করে। দিনে দিনে এই মিডিয়ায় এত কন্টেন্ট আপ হচ্ছে যে, এটি একটি ‘ব্ল্যাকহোলে’ পরিণত হয়েছে। 

বিড়ালের মজার মজার ভিডিও থেকে শুরু করে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা জিআরডাব্লিএম (গেট রেডি উইথ মি) ধরনের ক্লিপস- ইনস্টাগ্রাম সবার জন্যই কিছু না কিছু রেখেছে।

এই সময়ে এসে জিআরডাব্লিএম ভিডিওগুলো মেইকআপ টিউটোরিয়ালস এবং ফ্যাশন শোকেজের অন্যতম আঁধারে পরিণত হয়েছে। গল্প বলার মধ্য দিয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতার বর্ণনা, রাজনীতি এমনকি দৈনন্দিন জীবনের প্রেম-ভালোবাসার মুহূর্তগুলো কোনও রকম ঘষামাজা ছাড়াই ইনস্টাগ্রামে মানুষ পোস্ট করছে।

ইন্সটাগ্রাম ব্যবহারকারীদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে- অপরিচিত মানুষের জীবনের প্রেম ও সম্পর্কের কাহিনী- যাতে নাটকীয়তা, উত্তেজনা এমনকি লজ্জাজনক পরিস্থিতি দেখা যায়। কখনও কখনও প্রেম এবং সম্পর্কের জটিল দিকগুলো এসব পোস্টে প্রকাশ পায়। 

এখানে ঠিক দম্পতি বা জুটিগুলোর গোছালো সুখময় রিলস এর কথা বলা হচ্ছে না, যেটি অনেক ক্ষেত্রেই রূপকথার মতো ঝকঝকে দেখায়। বরং সেইসব রিলস এর কথাই বলা হচ্ছে যেগুলো একেবারেই আনকোরা, অপ্রস্তুত অবস্থাকে যেখানে কাটছাঁট করা হয়নি।

এই রিলসগুলোর কিছু উদাহরণ দেয়া যাক, তাহলে আরেকটু পরিষ্কার হবে।

–        গেট রেডি উইথ মি টু গো অন আ ফার্স্ট ডেইট

–        গেট রেডি উইথ মি হোয়াইল আই টেল ইউ অ্যাবাউট মাই ডেইট

–        গেট রেডি উইথ মি টু গো অন আ সেকেন্ড ডেইট

–        গেট রেডি উইথ মি টু মিট মাই এক্স ইত্যাদি।

কীভাবে এটি শুরু হয়েছে?

সোশাল মিডিয়ার ‘গেট রেডি উইথ মি’ ট্রেন্ডটির শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রের ৩১ বছর বয়সী ড্যানিয়েল ওয়াল্টার। নিজের ডেইটিং জীবন শেয়ার করে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন । তার ভাষায়, যারা প্রেম খুঁজছেন তাদেরকে সাহায্যের জন্য এ ধরনের ভিডিও পোস্ট শুরু করেছেন। নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে তিনি মানুষকে দেখান, তারা একা নয়। তার ভিডিওগুলো খুব জনপ্রিয় হয়েছে এবং এখন তার প্রায় ১০ লাখ ফলোয়ার রয়েছে। এই বছরে, তিনি ইতিমধ্যে ১২টি প্রথম ডেইটে গিয়েছেন!

ভারতীয় ক্রিয়েটররাও এই ধরনের কনটেন্ট তৈরিতে পিছিয়ে নেই। সান ফ্রান্সিসকোয় বসবাসকারী ভারতীয় ইনফ্লুয়েন্সার জাকির সিদ্দিকি নিজেকে পরিচয় দেন ‘ভাইরাল ইন্ডিয়ান ম্যান উইথ আ ব্ল্যাক বেল্ট ইন ফার্স্ট ডেইট’। তার ডেইটের আগের এবং পরের ভিডিও এর সংখ্যা মাত্র ৫৯। এই সামান্য সংখ্যক পোস্ট দিয়েই তিনি ১ লাখ ফলোয়ার পেয়েছেন!

ইন্ডিয়া টুডে এ ধরনের ‘ডেইটিং কনটেন্ট’গুলো বিশ্লেষণ করে পেয়েছে, এগুলো অডিয়েন্সকে নিবিড়ভাবে আটকে রাখে। বিশেষ করে কমেন্ট সেকশনে ভিউয়াররা প্রচুর মন্তব্যের মাধ্যমে নিজেদের মত প্রকাশ করেন এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের ডেইটিং উত্তেজনাও যেন তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

নতুন রিয়ালিটি শো

ডেইটিং-ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘বাম্বল’ সম্প্রতি ৪১ হাজার ২৯৪ জনের ওপর একটি জরিপ চালিয়েছে। ওই জরিপে ২০২৫ সালের ‘ডেইটিং ট্রেন্ড’ কী হবে- সেটি খুঁজে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে।

পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে যে, ‘গেট রেডি উইথ মি’, লাইভে থেকে সম্পর্কে ভাঙন (লাইভ-স্ট্রিমড ব্রেক আপ), পোস্ট ডেইট ডিব্রিফস বা ডেইটিং- এর পরের অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া, হার্ড লঞ্চেস বা সোশাল মিডিয়ায় পাবলিকলি বলেকয়ে একটি প্রেমের সম্পর্কের শুরু, রিলেশনশিপ ‘টেস্টস’, ডেটিং র‌্যাপড বা নিজের প্রেমের ঘটনা নিয়ে মজা ও হাস্যরসাত্মক উপস্থাপন ইত্যাদি ট্রেন্ডই এখন নতুন ‘রিয়ালিটি শো’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। 

জরিপে আরও যা উঠে এসেছে-

ভারতীয় অবিবাহিতদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক (৪৮%) আরও বাস্তবসম্মত ডেইটিং এবং সম্পর্কের কনটেন্ট পছন্দ করছেন । এই কনটেন্ট শুধু ভালো দিক বা সুখকর পরিবেশ নয়, বরং খারাপ দিকগুলোও দেখায়, যা ডেইটিং অভিজ্ঞতার একটি পূর্ণাঙ্গ অবস্থা তুলে ধরে।

আবার সব ধরনের অভিজ্ঞতা শেয়ারের মধ্য দিয়ে সম্পর্ক বা চিন্তার স্বচ্ছতার চর্চাও হচ্ছে। ফলে ডেইটিং অভিজ্ঞতার শেয়ার মনোজগতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। স্থানীয়ভাবে জরিপকৃত নারীদের এক-চতুর্থাংশ (২৬%) নিজেদের সম্পর্কে কম সচেতন এবং কম একাকিত্ব অনুভব করছে।

অন্যদের খোলামেলাভাবে এই অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করতে দেখে, মানুষ স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের লক্ষ্য নির্ধারণে অনুপ্রাণিত হচ্ছে, সম্ভাব্য ঝুঁকি চিনতে পারছে এবং সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আরও তাড়াতাড়ি করতে পারছে।

প্রকৃতপক্ষে, এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি অবিবাহিত ব্যক্তি (৩৯%) জানান, বাস্তবসম্মত, ইতিবাচক ডেইটিং কনটেন্ট তাদের নিজস্ব প্রেম জীবন সম্পর্কে আশাবাদী করে তোলে। এই প্রবণতা নারীদের মধ্যে আরও বেশি প্রায় ৫০ শতাংশ।

কেন এসব কনটেন্টে এত আগ্রহ?

দিল্লি-ভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য ও সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অশ্বিন মুনজাল এসব ভিডিওর প্রতি মানুষের আগ্রহের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “অন্যদের প্রেমের জীবনের গল্পগুলো গভীরভাবে আমাদের মস্তিষ্কে নাড়া দেয় কারণ এগুলো আমাদেরই নিজস্ব স্বপ্ন, ভয় এবং ফ্যান্টাসিকে প্রতিফলিত করে। ‘স্প্লিটজ ভিলা’, ‘লাভ ইজ ব্লাইন্ড’ এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলো তাই বিশ্ব বিনোদন বাজারে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী হয়ে ওঠাটা বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল না। একই থিম এখন ‘স্ন্যাকস’ এর মতো সোশ্যাল মিডিয়া ফরম্যাটে জায়গা করে নিচ্ছে।”

রিলেশনশিপ বিশেষজ্ঞ রুচি রুহ যোগ করেন, “এ ধরনের কনটেন্টে আমরা কেবল হাস্যরস বা আকর্ষণীয়তার কারণে নয়, বরং আবেগের প্রকাশের ধরনেও মুগ্ধ হই- যা আকর্ষণ, রোমান্স এবং সংযোগের জটিলতা সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি দেয়। রিলস হোক কিংবা একজন বন্ধুর গল্প শোনার ক্ষেত্রেই হোক, আমরা নিজেদের সঙ্গে সংযোগ অনুভব করি।”

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে এই ‘অতিরিক্ত শেয়ারিং’ কারণে মূল্য চুকাতে হতে পারে।

অতিরিক্ত শেয়ারিং এর সংকট

“সে তোমাকে ছেড়ে গেছে, কারণ সম্ভবত তুমি এভাবে দেখছিলে,” ড্যানিয়েলের একটি পোস্টে একটি মন্তব্যে লেখা ছিল, যখন তিনি মনের মতো একটি ডেইট না হওয়ায় হতাশার অভিজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন।

ড্যানিয়েলের মতো প্রেমজীবন সোশাল মিডিয়ায় তুলে ধরা লোকদের প্রতি কমেন্টস বিভাগের মন্তব্যকারীরা বেশ কঠোর। এইসব কনটেন্ট অনেক এঙ্গেজমেন্ট পেতে পারে, তবে প্রচুর ট্রলেরও শিকার হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে পোস্ট দাতা মানসিকভাবে প্রভাবিত হওয়ার পাশাপাশি তার ‘সম্পর্ক’কেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

অশ্বিন সতর্ক করেন, “অতিরিক্ত শেয়ারিংয়ের অবাঞ্ছিত পরিণতি হতে পারে”।

তিনি বলেন, “একটি মিষ্টি মুহূর্ত শেয়ার করে প্রাথমিকভাবে ভালো বোধ করতে পারেন, কিন্তু যদি এটি প্রত্যাশিত লাইক বা প্রশংসা না পায়, তবে এটি আত্ম-সন্দেহের দিকে পরিচালিত হতে পারে।”

“একটি নতুন সম্পর্ককে মোমবাতির শিখার মতো ভাবুন। অতিরিক্ত বাতাস, মন্তব্য, মতামত এবং বিচার-বিশ্লেষণ এটিকে নিভিয়ে দিতে পারে,” তিনি যোগ করেন।

রুচি এর সঙ্গে একমত হয়ে সতর্ক করে বলেন, “একবার আপনি ব্যক্তিগত কিছু শেয়ার করলে, পরে সীমা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে যায়।”

“একজন বন্ধুকে আপনার ডেইট সম্পর্কে জানানো এক কথা, কিন্তু ইনস্টাগ্রামে সবার কাছে প্রচার করা আরেক কথা। গোপনীয়তা বিবেচনা করা এবং আপনার মানসিক স্বাস্থ্য এবং সম্পর্ক রক্ষা করার জন্য খোলামেলা এবং বিচক্ষণতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি,” তিনি পরামর্শ দেন।

তার প্রশ্ন, “এই মুহূর্তটি (প্রেমের মুহূর্ত) কি মূল্যবান এই কারণে এটি লাইক পেতে পারে, নাকি এটি একান্ত নিজেদের বলে?”

মনে রাখবেন

সোশ্যাল মিডিয়া ডেইটিংকে একটি বিনোদনমূলক রিয়ালিটি শোতে পরিণত করেছে, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, অর্থবহ প্রেমের গল্পগুলো অফলাইনে থাকে। সর্বোপরি, যদিও মানুষ শেষ পর্যন্ত সে-ই চিত্তগ্রাহী গল্প পছন্দ করে, যেখানে সেরা অধ্যায় দুইজনের জন্য লেখা হয়!

[ইন্ডিয়া টুডে অবলম্বনে]

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত