শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের দেওয়া এক বক্তব্য ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে আলোচনা।
তার মধ্যেই রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে মঙ্গলবার বঙ্গভবনের সামনে অবস্থান নেয় একদল; ‘ইনকিলাব মঞ্চ’, ‘সার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটি’ কমিটি ব্যানারে। তাদের দাবি, মো. সাহাবুদ্দিনকে পদত্যাগ করতে হবে।
বুধবার বঙ্গভবনের সামনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার এবং সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের অবস্থানের মধ্যেও সেখানে অবস্থান ছিল গুটিকয়েকের।
তবে এদিন কোনও সংগঠনের ব্যানার দেখা যায়নি। ঘোষণা দিয়েও আসেনি গণঅধিকার পরিষদের একাংশ।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সদস্যরা বিকালে বঙ্গবভন ঘেরাও করবে- এমন গুঞ্জনে উত্তেজনা ছড়ালেও দিনব্যাপী তাদের কাউকেই সেখানে দেখা যায়নি।
যতজন সেখানে অবস্থান নিয়ে ছিল, দিনভর তাদের দেখতে কৌতূহলী মানুষের সংখ্যাই ছিল বেশি। এমনকি সংবাদকর্মীদের সংখ্যাও ছিল কর্মসূচি পালনকারীদের চেয়ে বেশি।
৩ জনকে দেখতে শ’খানেকের ভিড়
বুধবার সকাল ১০ টার দিকে বঙ্গভবনের ফটকের সামনে গিয়ে দেখা যায়, পুলিশ, র্যাব, এপিবিএন ও বিজিবির সদস্যদের পাশাপাশি সাঁজোয়া যান নিয়ে আছে সেনাসদস্যরা। বঙ্গভবনের সামনের সড়কে কাঁটাতারের ব্যারিকেড দিয়ে সতর্ক অবস্থানে ছিল তারা।
সেসময় ব্যারিকেডের সামনে রাস্তার ওপর বসে থাকতে দেখা যায় তিনজনকে। তাদের ঘিরে প্রায় দেড়শো লোকের জটলা। কেউ তাদের ভিডিও করছেন, কেউ ছবি তুলছেন, কেউবা ভিড় ঠেলে কেবল একনজর দেখার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিলেন।
কাছে গিয়ে দেখা যায়, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে এই তিনজন অবস্থান কর্মসুচি পালন করছেন। তারা জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে তারা এখানে আছেন। শুরুতে তারা সাতজন ছিলেন। অসুস্থ বোধ করায় বাকিরা চলে গেলে এখন কেবল তারা তিনজন রয়েছেন।
এদের মধ্যে দুজন শিক্ষার্থী পরিচয় দিয়েছেন, অন্যজন নিজেকে ব্যবসায়ী পরিচয় দেন।
তাদের মধ্যে একজন ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলোজির শিক্ষার্থী ইব্রাহিম সাব্বির সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই রাষ্ট্রপতিকে আমরা মানি না। উনার উপর আমরা নাখোশ হয়েছি, রাগ হয়েছি। এত রক্ত দিয়ে যে স্বাধীনতা আমরা এনেছি, সেই স্বাধীনতায় থেকে তিনি মিথ্যাচার করছেন। তাই আমার মনে হয়েছে, আমি এর প্রতিবাদ করব।”
যে আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে, কোটা সংস্কারের দাবিতে সেই আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন জানিয়ে সাব্বির বলেন, “সংখ্যা যাই হোক। আমরা যারা আছি, আমাদের দাবি না মানা পর্যন্ত…চুপ্পুর পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরা এই অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাব।”
খিলগাঁও থেকে এই অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেন রিফাতুল ইসলাম কাজী পারভেজ নামে আরেক ব্যক্তি। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “খাওয়ার ব্রেক ছাড়া বাকি পুরোটা সময় আমরা এখানে অবস্থানে আছি।”
অবস্থানে থাকা তিনজন জানান, তারা কেউই কারও পুর্বপরিচিত নন, এখানে এসে দেখা হয়েছে।
বেলা গড়ানোর সাথে সাথে উৎসুক জনতার ভিড় কিছুটা কমতে থাকে।
দুপুর দেড়টার দিকে অবস্থান নেওয়া তিনজনও দুপুরের খাবার খেতে চলে যান। আড়াইটার দিকে আবার তারা ফেরত এসে রাস্তায় বসে পড়েন।
বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত খণ্ড খণ্ড ভাবে ছয়টি দল ব্যানার ছাড়া মিছিল নিয়ে বঙ্গভবনের সামনে আসে। ১০ থেকে ২০ মিনিট তারা বিক্ষোভ করে আবার মিছিল নিয়ে ফেরত চলে যায়।
এই দলগুলো থাকার মধ্যে বঙ্গভবনের সামনে এক সময়ে সর্বাধিক ২২ জন বিক্ষোভকারীকে দেখা গেছে। সারাদিনেও এক সময়ে সংখ্যাটি এর বেশি বাড়েনি।
নিজেদের মধ্যে হট্টগোল, পরিচয় দিতে নারাজ
মিছিল নিয়ে আসা বিক্ষোভকারীদের পরিচয় জানা যায়নি। নানা বয়সী এই মানুষদের কাছে পরিচয় জানতে চাইলে তারা অনীহা প্রকাশ করেন।
তারা আশা করছিলেন, বিকাল ৪টায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা এই ঘেরাওয়ে যোগ দেবে। কিন্তু তাদের না দেখে হতাশ হয়ে নিজেরাই মাইক নিয়ে নানা স্লোগান ও বক্তব্য দিতে থাকেন।
বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে এক যুবক মাইক হাতে নিয়ে ‘নারায়ে তাকবির’ বলে বক্তব্য শুরু করেন। এক পর্যায়ে তিনি রাষ্ট্রপতির মৃত্যুও কামনা করেন।
এইসময় এই বিক্ষোভকারীর মধ্যে অন্য একজন তাকে বাধা দেন। কেন এমন বক্তব্য দিচ্ছেন, কোথা থেকে আসছেন, সেই পরিচয় জানতে চান।
বাক-বিতণ্ডার এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠে বিক্ষোভকারীরা। কয়েকভাগে ভাগ হয়ে তারা একে অন্যকে গালাগালি করতে থাকে।
মাইক হাতে বক্তব্য দেওয়া সেই যুবক এবং তার সঙ্গে আসা নয়জনের কেউই নিজেদের পরিচয় দেয়নি। অন্যদের রোষানলে পড়ে তারা চলে যায়। যাওয়ার সময় তাদের একজন বলেন, “আমি আপনাদের মতো টাকায় কেনা ঘুঘু না, আমি হলাম বসন্তের কোকিল। আবার আসব। ইনসাফ কায়েম হবেই।”
বাধা দেওয়া বিক্ষোভকারীদের একজন নিজের নাম বলেছেন আবু তৈয়াব হাবিলদার, তিনি নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র বলে পরিচয় দেন।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আমরা অনেকেই এখানে আছি, শান্তিপুর্ণভাবে আমাদের দাবি জানাতে। কিন্তু এরা কম বয়সের, ইমোশনাল…রাজনীতি বুঝে না, আবেগে উত্তেজিত করে ফেলে। সেটিই বোঝাতে চেয়েছিলাম যে এখন পরিস্থিতিতি ভালো না, উসকানো যাবে না।”
মিছিল নিয়ে বিএনপি সমর্থিত সংগঠনের যোগদান
বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ‘জিয়াউর রহমান সমাজকল্যাণ পরিষদ’ ব্যানার নিয়ে একটি মিছিল বঙ্গভবনের সামনে আসে। মিছিলকারীরা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেয়। তারা জুতা হাতে নিয়ে হুঁশিয়ারি দিতে থাকে।
পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক সম্পাদক সোহেল রানা বলেন, “রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শেখ হাসিনার দোসর ও মনোনীত ব্যক্তি। ছাত্র-জনতার সরকারে তার থাকার কোনও অধিকার নাই। অনতিবিলম্বে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে হবে।
“সাহাবুদ্দিন খুনি হাসিনার দোসর হলেও আমাদের রাষ্ট্রপতি। তাকে আমরা সম্মান করি। তাই তাকে বলতে চাই, আপনি সসম্মানে চলে যান। ছাত্র-জনতার সরকারে আপনার দরকার নাই। নিজের সম্মান রক্ষার্থে আপনি নিজে পদত্যাগ করুন। অন্যথায় জনগণ আপনাকে ছাড়বে না। আপনাকে গদি থেকে টেনেহিঁচড়ে নামানো হবে।”
প্রায় ২০ মিনিট বিক্ষোভ করে পরিষদের মিছিলটি ৫টা ৫০ মিনিটে দৈনিক বাংলা মোড় দিয়ে চলে যায়।
বিএনপি অবশ্য এরই মধ্যে জানিয়েছে, তারা রাষ্ট্রপতিকে সরানোর পক্ষে নয়।
এদিকে দুপুরের দিকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে এসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান জানান, নতুন করে সাংবিধানিক কোনও শূন্যতা তারা চান না।
পরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “রাষ্ট্রপতির পদে শূন্যতা এই মুহূর্তে রাষ্ট্রীয় সংকট সৃষ্টি করবে, সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে। যেটা জাতির কাম্য নয়।”
বাড়তি নিরাপত্তা
বঙ্গভবনের সামনে মঙ্গলবারের তুলনায় বুধবার সকাল থেকেই নিরাপত্তা ছিল জোরদার। কাঁটাতারের ব্যারিকেড তৈরির পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল সেনা সদস্যরা।
বিকালে বৈষম্যবিরোধীদের ঘেরাও কর্মসুচির গুঞ্জনে দুপুরের পর আরও দুই স্তরে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়। আরও এক প্লাটুন বিজিবি সদস্যও মোতায়েন করা হয়।
বঙ্গবভনের সামনে নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, যে কোনও ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা মোকাবেলার জন্য এই প্রস্তুতি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।
এই সরকারের আড়াই মাস যাওয়ার পর এখন আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে বিদায় করার দাবি উঠেছে।