বেঁচে থাকার জন্য যা যা চাই, তার সব কিছুরই দাম বেড়েছে। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে চাপে আছে সাধারণ মানুষ। এর মধ্যেই আবার মরণযাত্রার খরচও বেড়েছে। মরদেহ দাফন কিংবা সৎকারের খরচ এখন আগের চেয়ে বেশ বেশি। সেটা মুসলমান হোক, হিন্দু হোক কিংবা খ্রিস্টান, সবার ক্ষেত্রেই।
ঢাকার বছিলার একটি মসজিদে ইমামের দায়িত্ব পালন করেন মো. হাসান। এলাকার কেউ মারা গেলে ডাক পড়ে তার। লাশের গোসল থেকে শুরু করে জানাজা-দাফন সবকিছুতেই উপস্থিত থাকতে হয় তাকে।
কেউ মারা গেলে দাফনের জন্য ধর্মীয় কিছু রীতি পালন করতে হয়। লাশ পরিবহন, কাফনের কাপড়, কবরের জন্য বাঁশ-চাটাইসহ অনেক কিছু লাগে। এর সবেরই দাম বেড়ে গেছে বলে জানান হাসান।
তিনি বলেন, “আগে বছিলা থেকে রায়েরবাজার কবরস্থানে লাশ নেওয়ার জন্য ১০০০-১৫০০ টাকা গাড়ি ভাড়া লাগত। এখন ৪০০০ হাজার টাকার নিচে কেউ যায় না। কবরস্থানে সিটি করপোরেশন নির্ধারিত ৫০০ টাকা ফি দিতে হয়। এছাড়া বাঁশ, চাটাই ও কবর খোঁড়ার জন্য আরও ২৫০০-৩০০০ টাকা নেয়। আগে লাগত ১৫০০-২০০০ টাকা।
“সব শেষে আবার কবরস্থানের লোকজন বকশিশ দাবি করে। সেখানেও ৫০০ টাকার নিচে হয় না। সব মিলিয়ে আগে যদি একটা লাশ দাফন করতে ১০ হাজার টাকা খরচ হত, সেখানে এখন দ্বিগুণ লাগে।”
রায়েরবাজার কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক নজরুল ইসলাম অবশ্য বখশিশ নেওয়ার অভিযোগ মানতে নারাজ। তিনি বলেন, কবরস্থানের কেউ মৃতের স্বজনদের কাছ থেকে বকশিশ চেয়ে নেয় না, কেউ খুশি হয়ে দিলে সেটা হয়ত নেয়।
ঢাকার ভাটারার নতুন বাজার এলাকায় বিসমিল্লাহ ফার্নিচার মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় ‘শেষ বিদায় স্টোর’ নামে একটি দোকানে লাশ দাফনের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করেন মো. আয়নাল হক দুলাল। ১২ বছর ধরে এই ব্যবসা নিজে করছেন তিনি। তিনিও জানান, সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়াও এখন দাফনের খরচ বেশি পড়ছে।
দুলাল ২০২০ সালেও সাধারণ একটি কফিন বক্স বিক্রি করতেন ১৫০০-১৮০০ টাকায়। এখন ২৫০০ টাকার নিচে কোনও কফিন নেই। আর ভালো কফিনের দাম আরও বেশি।
আগে কাফনের কাপড়, সাবান, গোলাপ জল, সুরমা, আতর, কর্পুর, ব্লেড, টুথপিকসহ একটি প্যাকেজের দাম লাগত ২০০০ টাকা, এখন সেই একই প্যাকেজের দাম সর্বনিম্ন ৩০০০ টাকা।
দুলাল বলেন, “আমাদেরকে এখন সবকিছুই বেশি দামে কিনতে হয়, তাই বেশি দামে বিক্রি ছাড়া উপায় নেই। আগে চা পাতা বেচতাম ৬০০ টাকা কেজি, এখন আমাদের কিনতেই হয় ৮০০ টাকায়। একটা গোলাপ জলের দাম ছিল ১২ টাকা, এখন ১৮ টাকা। এক শিশি সাধারণ আতরের দাম আগে ছিল ২৫ টাকা, এখন ৩৫ টাকা। সাবানের দাম ছিল ২৬ টাকা, এখন ৪৫ টাকা।
“এখন লাশ পরিবহনের খরচও দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ঢাকার ভেতরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় লাশ নিতে ১৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০০ টাকা লাগত। এখন ৪০০০-৫০০০ টাকা ভাড়া লাগে। আর ঢাকার বাইরে আশপাশে কোথাও গেলেও ১৫০০০-২০০০০ টাকা গাড়ি ভাড়া দিতে হয়। এসব কারণেই দাফনের খরচ দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।”
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সৎকারের খরচও একই রকম বেড়েছে। সনাতন ধর্মের রীতি অনুযায়ী মৃতদেহের স্নান শেষে নতুন সাদা কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে যতটা সম্ভব চন্দন কাঠ বা অন্যান্য জ্বালানি সহযোগে মৃতদেহটি পুড়িয়ে দিতে হয়।
ঢাকায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মৃতদেহ সৎকারের জন্য রয়েছে দুটি শ্মশান। একটি পোস্তগোলা মহাশ্মশান, অন্যটি লালবাগের কামরাঙ্গীরচর শ্মশান। এই দুটি শ্মশানে মৃতদেহ সৎকারের জন্য সিটি করপোরেশন নির্ধারিত ১০০০ টাকা ফি দিতে হয়। এছাড়া সবুজবাগে রয়েছে হিন্দু সমাজ পরিচালিত একটি শ্মশান। এখানে মৃতদেহ সৎকারের জন্য মন্দির কমিটিকে ২০০০ টাকা অনুদান দিতে হয়।
সবুজবাগের শ্রী শ্রী বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির ও শ্মশান পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অখিল চন্দ্র দাস বলেন, মন্দিরে অনুদান দেওয়ার বিষয়ে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। যাদের সামর্থ্য নেই, তাদের কাছ থেকে অনুদান নেওয়া হয় না অনেক সময়। আবার সামর্থ্যবান অনেকে স্বেচ্ছায় বেশি অনুদান দেন।
তবে এই অনুদান ছাড়াই মৃতদেহ সৎকারের খরচ বেড়েছে অনেক, বলেন তিনি।
একটি মৃতদেহ সৎকারের জন্য সাদা কাপড় থেকে শুরু করে ঘি, চন্দন কাঠ, ধান, ফুল দুর্বাসহ ১০-১২ মন লাকড়ির প্রয়োজন হয়। ৫ বছর আগের তুলনায় এখন সবকিছুরই দাম বেড়ে গেছে। কিছুদিন আগেও লাকড়ির মন ছিল ২০০-৩০০ টাকা। এখন ১ মন সাধারণ লাকড়িও ৫০০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। এসব কারণে সৎকারের খরচও বেড়ে গেছে।
পোস্তগোলা শ্রী শ্রী সার্বজনীন শ্মশান কালী মন্দিরের পুরোহিত নিত্যানন্দ মালাকার বলেন, আগে এই শ্মশানে লাশ সৎকারের জন্য কোনও ফি দিতে হত না। কিন্তু এখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ১০০০ টাকা ফি ধার্য করেছে। এর সঙ্গে শ্মশানে মরদেহ পোড়ানোর জন্য দাহ্য সামগ্রী যেমন ঘি, লাকড়ি ইত্যাদি মৃতের পরিবারকে বহন করতে হয়।
একটি মৃতদেহ পোড়াতে ১০ থেকে ১২ মন লাকড়ির প্রয়োজন হয় বলে জানান তিনি।
ঢাকায় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষের মৃতদেহ সৎকারের জন্য তিনটি কবরস্থান রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় ওয়ারি খ্রিস্টান কবরস্থান। ১৬ বিঘা আয়তনের এই কবরস্থানে ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের দুই ধারার মানুষদেরই সমাহিত করা হয়। ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্টদের নিয়ে গঠিত সমন্বিত একটি কমিটি এই কবরস্থানের রক্ষণাবেক্ষণ করে।
অন্য দুটি হলো- তেজগাঁও খ্রিস্টান কবরস্থান এবং মোহাম্মদপুরের সেন্ট জোসেফ খ্রিস্টান কবরস্থান। এই দুটি কবরস্থানে শুধু ক্যাথলিকদের সমাহিত করার ব্যবস্থা রয়েছে।
২০০৪ সালে ২ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে ওঠা মোহাম্মদপুরের সেন্ট জোসেফ খ্রিস্টান কবরস্থান দেখভালের দায়িত্বে এখন রয়েছেন ভুট্টু মারান্ডি।
তিনি বলেন, এই কবরস্থানে মৃতদেহ দাফনের জন্য কোনও ফি নেওয়া হয় না। কিন্তু মৃতদেহ দাফনের জন্য প্রয়োজনীয় কফিন, কাপড় সব কিছুই মৃতের স্বজনদের বহন করতে হয়। এখন এসব পণ্যের দাম বাড়ায় দাফনের খরচও বেড়ে গেছে।
ঢাকায় বৌদ্ধদের মরদেহ সৎকারের জন্য নির্দিষ্ট কোনও শ্মশান নেই। সবুজবাগের শ্রী শ্রী বরদেশ্বরী কালী মাতা মন্দির ও শ্মশানে নিজ সম্প্রদায়ের মানুষদের দাহ করেন বৌদ্ধরা। তবে ঢাকার অদূরে আশুলিয়া বৌদ্ধদের জন্য একটি শ্মশান রয়েছে।
বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয় জানান, মৃতদেহ সৎকারে ২০২০ সালেও ১০-১৫ হাজার টাকা খরচ করতে হত স্বজনদের। এখন সবুজবাগই হোক কিংবা আশুলিয়ায়, কোথাও খরচ ৫০ হাজারের নিচে হয় না। কারণ দাহের জন্য জ্বালানি কাঠ, লাশ পরিবহন সবকিছুরই খরচ বেড়েছে।
তিনি বলেন, মৃতদেহ দাহের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য প্রীতিকাবন্ধনের (কফিনসদৃশ বাক্স) দাম বছর দুয়েক আগেও ছিল ১০০০০ টাকা। এখন সেই একই ধরনের বাক্সের দাম ১৫০০০ হাজার টাকার বেশি। শেষকৃত্যের জন্যও বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে মানুষকে।