পোশাকশিল্পে চলমান অস্থিরতা নিরসনে বিগত সরকারের আমলে ঘোষিত এ খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কাঠামো পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের বিদ্যমান হাজিরা বোনাসসহ ১৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে মালিকপক্ষ সম্মত হয়েছে।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে সরকারের চার উপদেষ্টা, বিজিএমইএ নেতৃবৃন্দ ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের উপস্থিতিতে এ বিষয়ে যৌথ ঘোষণা দেওয়া হয়। তা পড়ে শোনান শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।
অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রম উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র, শিল্প এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। সচিব জানান, বুধবার সব কারখানা খুলবে।
চলমান শ্রমিক অসন্তোষের জেরে মঙ্গলবার ঢাকার আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে ৫৫টি কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এর বাইরে ডিইপিজেডসহ শিল্পাঞ্চলের অন্যান্য কারখানায় স্বাভাবিক কার্যক্রম চলে বলে জানিয়েছে শিল্প পুলিশ।
মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, “পোশাক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ চলছে। এ অসন্তোষ নিরসণে ১৮ দফা দাবিতে শ্রমিক-মালিক ঐক্যমতে পৌঁছেছে। বিগত সরকারের আমলে শ্রমিকদের দাবিকে দমিয়ে রাখা হয়েছিল। ধীরে ধীরে সব ন্যায্য দাবি পূরণ করা হবে।”
মঙ্গলবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শ্রমিক ও মালিক পক্ষের ৩ জন করে প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত অতিরিক্ত সচিবের (শ্রম) নেতৃত্বে ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ কমিটি ন্যূনতম মজুরির বিধি-বিধান পর্যালোচনা করে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড বরাবর একটি সুপারিশ দেবে। এই কমিটি বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনা করে শ্রম আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করণীয় বিষয়ে নভেম্বরের মধ্যে একটি সুপারিশ করবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত শ্রমিক নেতারা তৈরি পোশাক শিল্পে অসন্তোষ বাদ দিয়ে শ্রমিকদের কাজে ফেরার আহ্বান জানান।
এর আগে কয়েকদিন ধরে পোশাক শিল্পে চলমান অস্থিরতা নিরসনের লক্ষ্যে চার উপদেষ্টার উপস্থিতিতে বিভিন্ন পক্ষের সভা হয়। এর মধ্য দিয়েই মঙ্গলবারের বৈঠকে শ্রমিকদের দাবির বিষয়গুলো নিয়ে মতৈক্য এল।
শ্রম আইন সংশোধন হবে
শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিতে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) ফের সংশোধনের কার্যক্রম চলমান। সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে ডিসেম্বরের মধ্যে সংশোধন কার্যক্রম শেষ করা হবে বলে জানান শ্রম সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।
তিনি বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকের সার্ভিস বেনিফিট দেওয়া হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ শ্রম আইন এর ২৭ ধারাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় অংশ সংশোধন করা হবে।
অক্টোবরের মধ্যে শ্রমিকের সব বকেয়া মজুরি দিতে হবে। না হলে শ্রম আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিজিএমইএভুক্ত সব কারখানায় শ্রমিকের বিদ্যমান হাজিরা বোনাস হিসেবে অতিরিক্ত ২২৫ টাকা ও রাত ৮টার পর বিদ্যমান টিফিন বিলের সঙ্গে ১০ টাকা এবং বিদ্যমান নাইট বিলের সঙ্গে ১০ টাকা বাড়ানোরও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিষয়ে পর্যালোচনার জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মাধ্যমে শ্রমিক ও মালিক উভয়পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পন্ন অন্যান্য দেশের আদলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি
১. মজুরি বোর্ড পুনর্গঠনপূর্বক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ
২. যেসব কারখানায় ২০২৩ সালে সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি এখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি তা দ্রুত বাস্তবায়ন
৩. শ্রম আইন সংশোধন করতে হবে
৪. কোনও শ্রমিকের চাকরি ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর চাকরি থেকে অব্যাহতি দিলে/চাকরিচ্যুত হলে একটি বেসিকের সমান অর্থ প্রদান করতে হবে, এর সাথে সাংঘর্ষিক শ্রম আইনের ২৭ ধারাসহ অন্যান্য ধারাসমূহ সংশোধন
৫. সব বকেয়া মজুরি অবিলম্বে পরিশোধ
৬. হাজিরা বোনাস (২২৫ টাকা), টিফিন বিল (৫০ টাকা), নাইট বিল (১০০ টাকা) সকল কারখানায় সমান হারে বাড়াতে হবে
৭. সব কারখানায় প্রভিডেন্ড ফান্ড ব্যবস্থা চালু
৮. বেতনের বিপরীতে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ন্যূনতম ১০ শতাংশ করা
৯. শ্রমিকদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা চালু
১০. বিজিএমইএ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বায়োমেট্রিক ব্ল্যাকলিস্টিং করা যাবে না। বায়োমেট্রিক তালিকা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। (বায়োমেট্রিক হলো আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে কারখানায় প্রবেশাধিকার। আঙ্গুলের ছাপ গ্রহণ না করলে কারখানায় প্রবেশ করতে পারেন না কর্মীরা।)
১১. সব হয়রানিমূলক ও রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার
১২. ঝুট ব্যবসার আধিপত্য বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ
১৩. কলকারখানায় বৈষম্যবিহীন নিয়োগ প্রদান করতে হবে (নারী-পুরুষ সমান হারে নিয়োগ)
১৪. জুলাই বিপ্লবে ‘শহীদ’ এবং আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত
১৫. রানা প্লাজা এবং তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের কল্যাণে তদন্তান্তে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ
১৬. শ্রম আইন অনুযায়ী সব কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন
১৭. অন্যায্যভাবে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ ও
১৮. নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ ১২০ দিন নির্ধারণ
বিগত সরকারের আমলে ২০২৩ সালের নভেম্বরে পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে মালিকপক্ষের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। তখন পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়। এর আগে তা ৮ হাজার টাকা ছিল।
শেষ মজুরি কাঠামো অনুযায়ী, মোট মজুরির মধ্যে মূল বেতন ৫৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ ১২ হাজার ৫০০ টাকা মজুরির মধ্যে মূল বেতন ৬ হাজার ৭০০ টাকা। আর মূল বেতনের অর্ধেক হচ্ছে বাড়িভাড়া। এছাড়া খাদ্যভাতা ১ হাজার ২৫০ টাকা, চিকিৎসাভাতা ৭৫০ টাকা ও যাতায়াতভাতা ৪৫০ টাকা। প্রতিবছর মূল বেতনের ৫ শতাংশ হারে মজুরি বাড়বে। ওই মজুরিকাঠামোতে সাতটি গ্রেডের বদলে পাঁচটি গ্রেড থাকার সিদ্ধান্ত হয়।
গত বছর আন্দোলনের সময় মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার দাবি ওঠে, যা এবার তুলেছে শ্রমিকরা।