১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের মানুষের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তাকে সাদা বাংলায় বলা হয় গণহত্যা।
যদিও গণহত্যা শব্দের ইংরেজি অর্থ ম্যাস মার্ডার, ম্যাস কিলিং বা ম্যাসাকার। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সংজ্ঞা অনুযায়ী, একটি ঘটনায় একটি স্থানে একবারে যদি তিন বা তার বেশি মানুষকে হত্যা করা হয় তবেই সেটি গণহত্যা।
সে হিসেবে ২৫ মার্চের ঘটনাকে গণহত্যা না বলে সরাসরি জেনোসাইড বা জাতিগত নিধন বলতে চান শহীদ সন্তান ও প্রজন্ম ৭১ এর সভাপতি আসিফ মুনীর। তার মতে গণহত্যা শব্দ দিয়ে জেনোসাইডের ভয়াবহতা বোঝানো সম্ভব নয়।
গণহত্যা ও জেনোসাইড এক বিষয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “২৫ মার্চ জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস বলা হচ্ছে। কিন্তু জেনোসাইড শুধু গণহত্যা নয়, এটি গণহত্যা প্লাস প্লাস।”
“বাংলাদেশ ‘জেনোসাইড ১৯৭১’এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী বৃহত্তম গণহত্যার ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্বের নীরবতা” শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সেমিনারের আয়োজন করেছিল সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ও মুক্তিযুদ্ধ ৭১।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের অপরাধের কারণে দেশটির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা উচিত বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মাদ আলী সিকদার।
তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারে যদি প্রতিষ্ঠিত হয় যে গণহত্যা হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই সারাবিশ্বে তখন স্বীকৃতি পাওয়া যাবে। রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের উচিত আন্তর্জাতিক আদালতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মামলা করা।”
জেনোসাইডে বিষয়ে বাংলাদেশে কম গবেষণা হয়েছে এমন কথা উল্লেখ করে আসিফ মুনীর বলেন, “যেসব কাজ হয়েছে সেগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ডকুমেন্টেশন হিসেবে নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা এবং প্রচার করা হলেও তা বিক্ষিপ্তভাবে।
“জেনোসাইড নিয়ে বাংলাদেশিদের গবেষণা কম। আন্তর্জাতিকভাবেও গবেষণা কম। পশ্চিমাদের নীরবতা ভাঙার জন্য একাডেমিক্যালি চেষ্টা করা যেতে পারে।”
২৫ মার্চ যেভাবে হত্যাযজ্ঞ চলেছে, যেভাবে নির্বিচারে জাতিগতভাবে নিধন করা হয়েছে সেসব বিষয় পাকিস্তানের অপরাধ প্রমাণের জন্য বড় হাতিয়ার বলেও মনে করেন তিনি।
জেনোসাইডের স্বীকৃতির জন্য কীভাবে এগোতে হবে তা বাংলাদেশের মানুষকেই চিন্তা করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথা বলতে হলে আন্তর্জাতিক পরিভাষা ব্যবহার করতে হবে।”
সেক্ষেত্রে গণহত্যা না বলে জেনোসাইড বলতে হবে, এমনটাই মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশের জেনোসাইডকে টেক্সটবুক জেনোসাইড উল্লেখ করে তিনি বলেন, “জেনোসাইডের সংজ্ঞায় যা যা বলা আছে, তার বেশিরভাগই বাংলাদেশে সংগঠিত হয়েছে।”
জেনোসাইডাল ক্রাইম কখনো তামাদি হয়না বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও লেখক মফিদুল হক। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে জেনোসাইড রাখঢাক করে ঘটেনি। অজস্র প্রমাণ তথ্যাদি রয়ে গেছে। এগুলো শুধু আমার ভাষায় লিখলে হবে না। আমরা যখন গ্লোবালি যাবো তখন অন্য ভাষায় বা ইংরেজিতে নিতে হবে।”
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দরকার বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন।
তিনি বলেন, “৫২ বছর পর আমরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাচ্ছি। কারণ মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দরকার। যেন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে তাদের সম্মান জানাতে পারি। আমাদের ক্ষতিপূরণটা পাকিস্তানের কাছ থেকে আদায় করতে পারি।”
যতদিন জেনোসাইডের সঠিক বাংলা শব্দ প্রণয়ন করা না যাচ্ছে ততদিন এই হত্যাকান্ডকে জেনোসাইড বলে ডাকার পক্ষপাতি এই শিক্ষক।
জেনোসাইড স্বীকৃতি আদায়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, পরারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে একটি সেল গঠন করা উচিত বলেও মত দেন তিনি।
সেমিনারে জেনোসাইড শব্দের অর্থ ভেঙে বুঝিয়ে দেন লেখক গবেষক হারুন হাবীব।
তিনি বলেন, “জেনোসাইড বাংলা বা ইংরেজি শব্দ নয়, রোমান শব্দ। বাংলাদেশের ঘটনায় জেনোসাইড শব্দটি প্রচলিত না হওয়ায় আমরা ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস বলি। সংবাদপত্রগুলোও জেনোসাইড না লিখে গণহত্যা বলে। উপযুক্ত শব্দ না পাওয়া পর্যন্ত জেনোসাইড শব্দটির প্রচলন করতে হবে।”
জেনোসাইডের স্বীকৃতি পাওয়া যাবে এবং পাকিস্তান আন্তর্জাতিকভাবে জেনোসাইডের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবে, এমন প্রত্যাশার কথাও ব্যক্ত করেন তিনি।
জেনোসাইড ও গণহত্যা নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তা ঠিক নয় মন্তব্য করে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, “জেনোসাইডের সাইড শব্দটা এটা মানেই তো হত্যা। হত্যা ওখানেও আছে।”
শব্দ নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি না করে তিনি গণহত্যা ও জেনোসাইড দুটো শব্দই ব্যবহারের পক্ষে মত দেন। তিনি বলেন, “এটা নিয়ে বিতর্ক করা সঠিক নয়। এর মাধ্যমে আমরা নতুন জটিলতা সৃষ্টি করছি। এখান থেকে আমাদের সরে আসতে হবে।”