বৃষ্টির সঙ্গে বাড়তে থাকা মশা গত বছরের ডেঙ্গুর ভয় আনছে ফিরিয়ে। ডেঙ্গু কতটা ভয়ানক হতে পারে, তা ২০২৩ সালেই দেখেছে বাংলাদেশ। গোটা বছরে ৩ লাখের বেশি রোগী শনাক্ত হয়, তার আগে ২২ বছর মিলিয়েও এত রোগী পাওয়া যায়নি।
মৃত্যুর সংখ্যাটিও ছিল উদ্বেগজনক। যেখানে ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছিল ৮৪৯ জনের, সেখানে শুধু ২০২৩ সালেই সংখ্যাটি হয়ে যায় দ্বিগুণ।
এইডিস মশাবাহিত এই রোগ এবার আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, এমন শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বছরের শুরুতে আক্রান্তের সংখ্যাটি তেমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
সেক্ষেত্রে মশা দমন কিংবা রোগী ব্যবস্থাপনায় সরকারসহ কর্তৃপক্ষগুলোর প্রস্তুতি আসলে কতটা? সেই প্রশ্নই আসছে ঘুরে ফিরে।
ভয়ানক ২০২৩
রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুও, শয্যা পেতে হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল থেকে রোগীদের দৌড়াদৌড়ি- এমন চিত্র ছিল ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে।
গত বছর রোগী বাড়তে শুরু করে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে, জুন নাগাদ ডেঙ্গুর বিস্তার শুরু হয়, ছাড়িয়ে যায় আগের সব হিসাব। বিলম্বিত বর্ষায় প্রাদুর্ভাব চলে বেশি দিন। গত বছরই প্রথম দেশের সব জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়।
বছরের শেষ দিকে এসে রোগীর সংখ্যা কমতে থাকে। শেষ অবধি সরকারি হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন শনাক্ত হয় গত বছর, আর মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের।
গত ১৯ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের পর থেকে যত রোগী চিকিৎসা নিয়েছে, তার চাইতেও বেশি রোগী আক্রান্ত হয় গত বছরে।
সরকারি তথ্য বলছে, ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ৮৪৯ জনের, আর শনাক্ত রোগীর সংখ্যা আড়াই লাখের মতো।
এই হিসাবে সব রোগী নেই, কারণ হাসপাতালে যারা আসেন না, তারা এই হিসাবে নেই।
বছরের শুরুতেই উদ্বেগ
এবার বছরের শুরুতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দেখে শঙ্কা প্রকাশ করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বছরের শুরুর তিন মাসের ডেঙ্গু রোগীর যে তথ্য পাচ্ছি, তা গত বছরের প্রায় দ্বিগুণ। সুতরাং এবার যে কী হবে … “
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরে ১ জানুয়ারি থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৬৪৫ জন, যেখানে গত বছরের এই সময়ে রোগী ছিল ৮৪৩ জন। গত বছর এই সময়ে যেখানে মৃত্যু হয়েছিল ৯ জনের, সেখানে এবার ২২ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ডেঙ্গু।
২০২৩ সালে জানুয়ারিতে রোগী ছিল ৫৬৬ জন, মৃত্যু হয় ছয়জনের; ফেব্রুয়ারিতে রোগী ১৬৬ জন, মৃত্যু হয় তিনজনের। মার্চে ১১১ রোগী শনাক্ত হয়েছিল, তবে কারও মৃত্যু হয়নি।
২০২৪ সালের বছরের জানুয়ারিতে রোগী শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৫৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯ জন। জানুয়ারিতে মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের, ফেব্রুয়ারিতে তিনজনের। ২৬ মার্চ পর্যন্ত ২৫১ রোগী শনাক্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের।
মশা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার সংখ্যাগুলো দেখে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে ডেঙ্গু ভয়াবহ হবে।
“ডেঙ্গু এখন সারাবছরের রোগ হলেও গত বছরে জুলাই থেকে রোগী বাড়তে থাকে, আর সেটা পিক টাইম গিয়ে ঠেকে অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে…এবারও তাই হবে।”
মশার বিস্তারও ভয় জাগানিয়া
গত ২০ মার্চ সোসাল মিডিয়ায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। মশা নিধনে একটি খাল পরিচ্ছন্নতা অভিযানে গিয়ে মশার হাতে নাকাল হয়েছিলেন তারা।
তাতে মশার বিস্তার বাড়ার একটি ধারণা পাওয়া যায়। নগরবাসীরও অভিজ্ঞতাও বলছে, এবার মশার উপদ্রব বেশি।
কোনও এলাকায় মশার লার্ভার উপস্থিতিতির হার প্রকাশ করা হয় ব্রুটো ইনডেক্সের মাধ্যমে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মশার বিস্তার বোঝার জন্য জরিপ চালিয়ে থাকে। জরিপে প্রতি ১০০ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা তার বেশিতে যদি লার্ভা বা পিউপা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে মশার উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি বলেন বিশেষজ্ঞরা।
গত বছরের অক্টোবরের এক জরিপে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩০টি এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩৫টি ওয়ার্ডে এইডিস মশার লার্ভার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল।
ঢাকা উত্তরের ১, ৩ , ৪, ৫, ৬ , ৭, ১০, ১২, ১৩, ১৬, ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২,৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪১ নম্বর ওয়ার্ড এবং দক্ষিণের ১, ২, ৩, ৪, ৬, ৮, ৯, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৮, ১৯, ২০, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩৪, ৩৬, ৩৭, ৩৯, ৪২, ৪৩, ৪৫, ৪৬, ৫২, ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডে মশার ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি ছিল।
তার আগের জরিপে মশার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি ছিল কম। জুলাইয়ের সেই জরিপে উত্তর সিটির ২৭টি ওয়ার্ড এবং দক্ষিণ সিটির ২৮টি ওয়ার্ডে এইডিস মশার লার্ভা ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রায় ছিল।
এবারও মশার ঘনত্ব বেশি পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখনই আগাম ব্যবস্থা যদি না নেওয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতি কিন্তু গতবারের চাইতে ভয়ঙ্কর হবে।
“দেশজুড়ে বিশেষ করে যে জেলাগুলোতে মশার ঘনত্ব বেশি, সেখানে মশা নিধন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে, বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।”
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেনও আশঙ্কা করছেন, এবার পরিস্থিতি নাজুক হবে।
“গত বছরে রোগী সংখ্যা এবং মৃত্যুতে রেকর্ড হয়েছে, এবারে যদি এখন থেকেই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে নিজেদের রেকর্ড নিজেরাই ব্রেক করব আমরা।”
অধ্যাপক সেব্রিনা ফ্লোরা মশা দমনের কাজটি জোরদারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, “রোগীর চিকিৎসা করে তো রোগ নিয়ন্ত্রণ হয় না, বরং রোগের উৎস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। না হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।”
“যতক্ষণ মশা নিধন না করা যাবে, ততক্ষণ চিকিৎসা ব্যবস্থা দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না,” বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেনও।
নগর কর্তৃপক্ষের ‘হাস্যকর’ সব উদ্যোগ
ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রথম ধাপই হলো এইডিস মশা নিধন। সেই দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তথা স্থানীয় সরকারের কর্তৃপক্ষগুলোর। মহানগরগুলোতে দায়িত্বটি বর্তায় সিটি করপোরেশনের ওপর।
এই মশা নিধনের কাজে বারবারই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতা দেখছে নগরবাসী।
পানিতে ব্যাঙ, তেলাপিয়া ও গাপ্পি মাছ ছেড়ে মশা দমনের নানা উদ্যোগ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে। গত বছর তার সঙ্গে যোগ হয় ড্রোন।
২০১৭-১৮ সালের দিকে বিভিন্ন নর্দমায় গাপ্পি মাছ ছাড়া হয়েছিল। তখন দক্ষিণের তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকন বলেছিলেন, এই মাছ মশার লার্ভা খেয়ে ফেলবে।
তা ব্যর্থ হওয়ার পর ২০২০ সালে বর্তমান মেয়র শেখ ফজল নূর তাপস সিপাহীবাগ ঝিল ও রমনা পার্কে মাছ ও হাঁস চাষের উদ্বোধন করে বলেছিলেন, “আগের কার্যক্রম ছিল লোক দেখানো। শুধু ফাঁকি আর ফাঁকি।”
তেলাপিয়া মাছ মশার লার্ভা ধ্বংস করবে বলে তিনি আশা দেখিয়েছিলেন। তবে কিছুদিন পর হাঁস আর মাছ উধাও হয়ে যায়। এরপর ব্যাঙ আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাতেও কাজ হয়নি।
গবেষক কবিরুল বাশার বলছেন, এর মধ্যে গাপ্পি মাছ কিছুটা কার্যকরী, তবে বাংলাদেশের মতো দেশে নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদের চোখে, সিটি করপোরেশনের এসব উদ্যোগই ছিল ‘হাস্যকর’।
“কী করেনি তারা? সবই ব্যর্থ হয়েছে। সিটি করপোরেশনের কোনও ফাঁদই প্রকৃতপক্ষে কাজে আসেনি মানুষের জন্য। কেবল টাকাই খরচ হয়েছে, জনগণের তাতে কোনও সাহায্য হয়নি।”
কাজ যে হচ্ছে না, তার স্বীকারোক্তি মেলে গত বছর মেয়র আতিকুল ইসলামের যুক্তরাষ্ট্র সফর করে আসার পর। করপোরেশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, ঢাকা শহরে মশা নিধনে যে প্রক্রিয়ায় কাজ করা হয়, তা ভুল পদ্ধতি বলে মনে করছেন মেয়র আতিক। যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামি শহরে গিয়ে মশা নিধন কার্যক্রম দেখে তার এই উপলব্ধি হয়েছে। এত দিন ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করে মশা তো ধ্বংস হয়নি, বরং অর্থের অপচয় হয়েছে।
এবার কী হচ্ছে
মশা নিধনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এই অর্থ করপোরেশনের চলতি অর্থবছরে মোট ব্যয়ের দেড় শতাংশের সামান্য বেশি। আগের বছর ৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখলেও ব্যয় হয়েছিল ৫২ কোটি টাকা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এবার বরাদ্দ রেখেছে ৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে মশা নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি কেনায় ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা, কীটনাশক কেনায় ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন পরিবহনে ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। দক্ষিণে গতবার কীটনাশক কেনায় ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল, তবে শেষমেষ খরচ হয়েছিল ২৯ কোটি টাকা। এই করপোরেশনে মশা নিধনে এবারের বরাদ্দ মোট ব্যয় পরিকল্পনার ১ শতাংশেরও কম।
কয়েক বছর আগে মশা নিধনে কেনা কীটনাশক নিয়ে সমালোচনায় পড়েছিল দুই সিটি করপোরেশন, যখন দেখা গিয়েছিল যে তাতে মশা মরছে না।
এরপর গতবার ঘটা করে বিটিআই (ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস) নামের কীটনাশক এনেছিল ডিএনসিসি। তা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলেও আশা করছিলেন মেয়র আতিক।
কিন্তু পরে ওই কীটনাশক কেনা নিয়েও ওঠে প্রশ্ন। কারণ বিদেশি যে কোম্পানির কাছ থেকে কীটনাশক আনার কথা বলা হয়েছিল, তারা তা অস্বীকার করে।
তবে এবার ‘কার্যকর’ বিটিআই আনার কথা বলছেন ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, এবার বিটিএস আনার প্রক্রিয়া চলছে। দুই মাসের মধ্যে তা আসছে।
মেয়র আতিক বলেন, এবার আর অন্য মাধ্যমে নয়, সরাসরি উৎপাদনকারীর কাছ থেকে কিনবে সিটি কর্পোরেশন।
“বিটিএস আর ওষুধ ছিটানোর জন্য অত্যাধুনিক মেশিন (হুইলবারো মেশিন) আনারপ্রক্রিয়ার পাশাপাশি এবারে নতুন একটি ধারণা নিয়েছে ডিএনসিসি।”
কী সেই উদ্যোগ- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ময়লার বিনিময়ে টাকা। কেউ বাসা বাড়ির ময়লা সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত জায়গায় জমা রাখলে তার বিপরীতে তাকে অর্থ দেওয়া হবে।”
বর্ষা শুরুর আগে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছি দাবি করে মেয়র বলেন, “আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঈদের পর থেকেই ব্যাপকভাবে ক্যাম্পেইন শুরু করব।”
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল বলেন, মশা যেখানে জন্মায়, সেসব জায়গা সিটি করপোরেশনের নাগালের বাইরে থাকটাই সমস্যা।
“ঘরের ভেতরে, বিভিন্ন বাড়ির বেইজমেন্টে আমরা যেতে পারি না। তাই এ কাজের জন্য আমরা এবারে সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। আরও ডিপলি কাজ করব এবার।”
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, মশা নিধন অভিযানকে আরও জোরদার ও কার্যকর করার জন্য তিনজন কীটপতঙ্গবিদকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এনাটমি ল্যাব স্থাপনের জন্য।
মশা নিয়ন্ত্রণে উচ্চক্ষমতার টারবাইন মেশিন কেনার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে জানিয়ে তিনি বলেন, এই মেশিনের সাহায্যে অতি অল্প সময়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। কীটনাশকের কার্যকারিতা নতুন করে পরীক্ষা করা হচ্ছে।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে নিজেরাই এইডিস মশা নিয়ে জরিপ পরিচালনা করা হবে বলে জানান তিনি।
ঢাকা দক্ষিণের ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, তারা এরই মধ্যে সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করেছেন। রোজার ঈদের পর তা বড় আকারে শুরু হবে।
প্রথম তিন মাসের পরিসংখ্যানে রোগীর সংখ্যা বাড়লেও দক্ষিণে রোগীর সংখ্যা এখনও নগণ্য দাবি করে তিনি বলেন, “আমরা রোগী নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি।”
ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ফজলে নূর তাপস গত বছরও দাবি করছিলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে তারা সফল।
তিনি গত ১৯ মার্চও মন্ত্রণালয়ের এক সভায় মশা নিধনের চেয়ে চিকিৎসার ওপর জোর দিয়ে বলেন, “ডেঙ্গু আক্রান্ত সব রোগীকে সময়মতো চিকিৎসা সেবা দিতে হবে।”
স্বাস্থ্য বিভাগের কী প্রস্তুতি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানাচ্ছে, তারা এরইমধ্যেই দেশজুড়ে হাসপাতালগুলোকে ‘অ্যালার্ট’ করছেন। আরও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতালের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের তিনটি ধাপ। মশা নিধন, জনগণের সচেতনতা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা। তাদের কাজটি আসে সবার পরে।
সবার প্রতি অনুরোধ রেখে তিনি বলেন, জ্বরসহ ডেঙ্গুর অন্য কোনও লক্ষণ উপসর্গ দেখা দেওয়া মাত্র হাসপাতালে যেতে হবে। দেরি করা হলেই বিপদ, যা আগের বছর দেখা গেছে।
“যত দ্রুত রোগ শনাক্ত হয়, তত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা গেলে রোগীর জন্য মঙ্গলজনক।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, “গত বছরের ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখার পর এবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চলতি বছরে ডেঙ্গু মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত কার্যক্রম চলমান।
“তবে ডেঙ্গু এখন ঢাকার চাইতে ঢাকার বাইরে বেশি ছড়িয়েছে। যেখান যদি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তাহলে ঢাকার হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ কমবে।”
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কর্মকৌশল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাতে নিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেটা ‘অতি শিগগিরই’ সবাইকে জানানো হবে।
“তবে খুব স্ট্রংলি বলতে চাই, ডেঙ্গুর বাহক মশা নিধন না হলে পুরো দেশটাকে হাসপাতাল বানালেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না,” বলেন সেব্রিনা ফ্লোরা।
কলকাতা সফল, ঢাকা কেন নয়
দশককাল আগে ডেঙ্গু উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল পাশের দেশ ভারতের কলকাতাকেও। তবে তারা এই রোগ নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সফল হয়েছে। তাই বারবারই প্রশ্ন আসছে, কলকাতা পারলে ঢাকা কেন পারছে না?
“কারণ আমরা ডেঙ্গুকে বর্ষাকালের রোগ হিসাবে ধরছি। এটা যে কতবড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা, সে নিয়ে গুরুত্বই দিচ্ছি না, আর গুরুত্ব দিচ্ছি না বলে সে অনুযায়ী কোনও প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না,” বলেন সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, “অতীন ঘোষ (কলকাতার ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ) বলেছিলেন, ‘ফগার দিয়ে মশা তাড়ালে এক পাড়ার মশা আরেক পাড়ায় যায়। কাজের কাজ কিছুই হয় না। আমরা তাই উৎপত্তিস্থলে মশা নির্মূলের লক্ষ্য ঠিক করি। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে এছাড়া উপায় নেই’।
“ঠিক এই কথাটাই আমরা বলে আসছি, মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করতে হবে, কিন্তু কেউ আমলে নেয় না।”
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কলকাতা নগর কর্তৃপক্ষের কাজ তুলে ধরে ২০১৯ সালে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, তারা সারা বছর ধরে নিবিড় নজরদারি চালায়, যাতে কোথাও পানি না জমে থাকে।
অতীন ঘোষ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “১৪৪টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতেই আমাদের ২০ থেকে ২৫ জন করে কর্মী আছেন, যাদের মধ্যে একদল প্রচারের কাজ চালায়, আর অন্য দল জল জমছে কি না, সেটার ওপরে নজর রাখে।
“এর ওপর আছে র্যাপিড অ্যাকশন টিম। তাতে ৮ থেকে ১০ জন লোক থাকে সব ধরনের সরঞ্জাম নিয়ে, গাড়িও থাকে তাদের কাছে। কোনও জায়গায় ডেঙ্গুর খবর পাওয়া গেলে অতি দ্রুত তারা সেখানে পৌঁছে এইডিস মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণের কাজ করে।”
তিনি বলেছিলেন, পাশাপাশি শহরের প্রতিটি হাসপাতাল, নার্সিং হোম বা পরীক্ষাগারে রোগীদের কী কী রক্ত পরীক্ষা হচ্ছে, কী ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে, তার প্রতিদিনের হিসাব রাখা হয়, যাতে ডেঙ্গু রোগীর খোঁজ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
ডা. মুশতাক বলেন, “তারা (কলকাতা) যে মডেল ফলো করল, আমরা তো সে মডেল ফলো করছি না, গুরুত্বই দিচ্ছি না।
“ডেঙ্গুর ভয়াবহতা ঊর্ধ্বতন মহলকে বোঝাতে সক্ষম হইনি আমরা, তাই সরকারের কাছে এর গুরুত্ব নেই, স্বীকৃতি নেই। রোগী যখন বিছানা পায় না, মেঝেতে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়, তখনই সেটা স্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা। স্বাস্থ্যের এই জরুরি পরিস্থিতি বোঝাতে পারিনি দেশের পলিসি মেকারদের কাছে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অবশ্য জানাচ্ছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ডেঙ্গুমুক্ত করতে জাতীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশল হাতে নেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ পরিকল্পনাটি গত ১৯ মার্চ অনুমোদন দেওয়া হয়। এ কৌশলের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ও এ রোগে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা।
সাত বছর মেয়াদী এই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ কমিয়ে আনতে হবে, প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে সর্বোচ্চ একজন আক্রান্ত আর একজনের মৃত্যু।
পেশায় চিকিৎসক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ডেঙ্গু স্থায়ী সমস্যা হতে যাচ্ছে। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও এর নিয়ন্ত্রণে এই কৌশলপত্র নেওয়া হয়েছে।”
অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, বিশেষ এই কর্মকৌশলে চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা বাড়ানো হবে, যাতে দ্রুত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে ডেঙ্গু কার্যক্রমের জন্য একদম আলাদা বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে এই কর্মকৌশলে। এইডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে তোলার কথাও আছে।
কর্মকৌশলে নির্মাণাধীন ভবনগুলোতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকার কথা বলা হয়েছে, না রাখলে শাস্তির ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ডেঙ্গু বিষয়ে সচেতনতামূলক বার্তা অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট, স্যালাইন, অন্যান্য ওষুধ মজুদ রাখা এবং জরুরি প্রয়োজনে সরবরাহ নিশ্চিত করার কথা বলা আছে কর্মকৌশলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত ডেঙ্গু প্রতিরোধক টিকা দেওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, গত বছরে ৩ হাজারের বেশি চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, এবারেও এ কার্যক্রম চলবে।
বিশেষ এই কর্মকৌশল বাস্তবায়নে স্বাস্থ্যসহ সবার মধ্যে সমন্বয় তৈরি করতে হবে, বলেন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা।
এই সমন্বয়ের কাজটিই মহাগুরুত্বপূর্ণ বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, “কলকাতা তো একটি ব্যবস্থাপনা তৈরি করে সে অনুযায়ী কাজ করেছে। আমরা কেবল একের পর এক উদ্যোগই গ্রহণ করি, কাজের কাজ কিছু হয় না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ আমরা আসলেই চাই কি না, সেটাই প্রশ্ন।”