Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

চিকন তারে ঝুলছে ডেঙ্গু রোগীর স্যালাইন

স্ট্যান্ড না থাকায় রোগীদের স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে চিকন তারে ঝুলিয়ে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
স্ট্যান্ড না থাকায় রোগীদের স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে চিকন তারে ঝুলিয়ে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের চতুর্থ তলা। সেখানকার ৪০২ নম্বর ওয়ার্ডটি ডেঙ্গু আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের জন্য নির্ধারিত। ওয়ার্ডে শয্যাসংখ্যা ২০টি। গত ২ অক্টোবর বুধবার সেখানে রোগী পাওয়া যায় ৪৫ জন।

বাড়তি চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল, নাকাল হচ্ছে চিকিৎসক-নার্সরা, ভোগান্তি পোহাচ্ছেন রোগীরাও। এমনকি বারান্দায় বা সিঁড়ির গোড়ায় থাকা রোগীদের জন্য নেই ফ্যানের ব্যবস্থাও।

চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোগীদের যেভাবে এখানে রাখা হয়েছে সেটা ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট প্রটোকলের পুরো বিপরীত। গরমে এসব রোগীর আরও ‘শকে’ যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। শক সিনড্রোমে রোগীর দেহে পানি শূন্যতা তৈরি হয়, সঙ্গে পালস রেট বেড়ে যায়। আর কমে যায় রক্তচাপ।

তাই প্রশ্ন উঠেছে ‘ডেডিকেটেড ওয়ার্ড কতটা ডেডিকেটেড?’ এভাবে চিকিৎসা দেওয়াকে ‘অমানবিক’ বলে মন্তব্য করছেন অনেকে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২ অক্টোবর সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এক হাজার ২২ জন। এ সময়ে মৃত্যু হয়েছে তিন জনের।

তাদের নিয়ে চলতি বছরের ৩ অক্টোবর পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৪ হাজার ১২১ জনে। আর মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭৭ জনে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে এক হাজার ৬০৫ জন। এ সময়ে ছাড়পত্র নিয়েছে এক হাজার ৩৯২ জন। ভর্তি ছিল ১৭৮ জন। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩৫ জনের।

ওয়ার্ডের চিত্র

চলতি বছরে রোগী বাড়তে শুরু করেছে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে। সামনে রোগী আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বর্তমানে থাকা রোগীদের সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ডের ভেতরের শয্যাগুলোতে নেই স্যালাইন স্ট্যান্ড, মেঝেতে থাকা রোগীদের জন্য সে সুযোগের আরও বেশি অভাব। ফলে রোগীদের স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে চিকন তার টাঙিয়ে বা জানালার গ্রিলে ঝুলিয়ে।

চিকিৎসক-নার্সদের সুযোগ সুবিধাও অপ্রতুল। বারান্দায় বা সিঁড়ির গোড়ায় রাখা রোগীদের জন্য নেই কোনও ফ্যান। ফলে এসব রোগী গরমে আরও বেশি শকে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছে।

জানালায় ঝুলিয়ে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে রোগীকে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

সারা দেশ থেকে চিকিৎসা নিতে এই হাসপাতালে আসে রোগীরা। গত বুধবার (২ অক্টোবর) হাসপাতালে গিয়ে রোগী ও চিকিৎসক-নার্সদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় রোগীও বাড়ছে। কিন্তু এত রোগীর জায়গা হচ্ছে না।

বেডের থেকে বেশি রোগী মেঝেতে

ডেঙ্গু ওয়ার্ডে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্স সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আজ সকালে রোগী ছিল ৫৬ জন। তবে সকাল থেকে কয়েকজনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে, এখন আছেন ৪৫ জন। অথচ বেড রয়েছে ২০টা।”

মেঝেতে থাকা রোগীর চাপে হাঁটা যায় না জানিয়ে তিনি বলেন, পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব থাকায় রোগী একটু ভালোর দিকে গেলেই ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। এই ওয়ার্ডে দুজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে শুধু আইসিইউ না পাওয়ার কারণে।”

‘ডেডিকেটেড ওয়ার্ড’ কতটা ডেডিকেটেড

ওয়ার্ডের নাম দেওয়া হয়েছে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড। কিন্তু সেটা কতটা ডেডিকেটেড বা তাদের জন্য নির্ধারিত?

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের এক চিকিৎসকের কথায় তার একটা চিত্র পাওয়া গেল।

তিনি বলেন, “অন্য জটিলতা না হলে ডেঙ্গু রোগীর একমাত্র চিকিৎসা ফ্লুয়িড ম্যানেজমেন্ট বা তরল ব্যবস্থাপনা। সেটা মানা হচ্ছে না এখানে। মেঝেতে যাদের জায়গা হয়েছে, তাদের জন্য ফ্যান নেই। গরমে এসব রোগীর শকে যাওয়ার ঝুঁকি আরও বাড়ছে।”

ডেডিকেটেড ওয়ার্ডে রোগীদের স্যালাইন দেওয়ার জন্য স্ট্যান্ড নাই, চিকন তারে টাঙানো হয়েছে স্যালাইন। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় ফলোআপ খুব জরুরি। কোনও রোগীকে একটা স্যালাইন দেওয়ার পর তার কতোটা উন্নতি হলো, পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে- সেজন্য পরীক্ষার রিপোর্ট ভীষণ জরুরি।

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, “এখানে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হলে রিপোর্ট আসে একদিন পর। তা দিয়ে কি কাজ হবে? তাই চিকিৎসা দিতে হয় নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে। শুধু ডেডিকেটেড লিখে নোটিস টাঙানো মানেই কোনও ওয়ার্ড ডেডিকেটেড করা নয়।”

চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুর জন্য ডেডিকেটেড ওয়ার্ড করতে হলে ডেঙ্গু সম্পর্কিত সবকিছু আলাদা করতে হবে। বিশেষ করে যখন রোগী পরিস্থিতি এমন হয়। টাকা জমা দেওয়ার জন্য ব্যাংকে আলাদা বুথ থাকতে হবে। ল্যাবে ও রিপোর্ট ডেলিভারির জন্য আলাদা বুথ থাকতে হবে। কারণ তাদের পরীক্ষাগুলো খুব দ্রুত করা দরকার হয়।

হাসপাতালের বর্তমানে যে ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ, তাতে সুস্থ হতে বেশি সময় লাগবে। তাই রোগী একটু সুস্থতার দিকে গেলেই ছাড়পত্র দিয়ে দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন চিকিৎসক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যদি রোগীদের বারান্দায় রাখতেই হয়, তাহলে সেখানে ফ্যান-বাতি নেই কেন? গরমে তো রোগীর শক সিনড্রোম আরও বাড়বে।

এই ভবনটি নতুন তাহলে সেখানে আগের অভিজ্ঞতা কেন কাজে লাগানো হয়নি সে প্রশ্নও তোলেন অনেকে।

মেঝেতে যাদের জায়গা হয়েছে, তাদের জন্য ফ্যান নেই। গরমে এসব রোগীর শকে যাওয়ার ঝুঁকি আরও বাড়ছে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

শুধু রোগী নয়, এই ওয়ার্ডে কাজ করা চিকিৎসক-নার্সদের অবস্থাও ভীষণ সঙ্কটাপন্ন।

নাম না প্রকাশের শর্তে এক নার্স বলেন, “আমাদের বেসিন নেই, বাথরুম নেই। সারাদিনে একবার হাত ধোয়ার সুযোগ পাই। অথচ এই সময়ে কত কত কাজ করতে হয়।”

নারীদের নেই আলাদা ওয়ার্ড

এই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত পুরুষ রোগীর জন্য আলাদা ওয়ার্ড থাকলেও নেই নারীদের জন্য। নারীদের রাখা হচ্ছে অন্য সব নারী রোগীদের সঙ্গে। তাতে যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত নন, তারাও ভীষণ ঝুঁকিতে পড়ছেন।

চিকিৎসকরা জানান, নতুন ভবনে জায়গা না থাকায় নারী রোগীদের জন্য এভাবে ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক থেকে তিন নম্বর বেড নির্ধারণ করা হয়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত নারীর জন্য। কিন্তু রোগী সংখ্যা অনেক বেশি, তাই তাদেরকে রাখতে হয়েছে বিভিন্ন বেডের মাঝে মাঝে।

যা বললেন হাসপাতাল পরিচালক

ডেঙ্গুর মৌসুমে রোগী, চিকিৎসক ও নার্সদের নানা অভিযোগের বিষয়ে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান প্রথমে সব অভিযোগই অস্বীকার করেন।

মেঝে ও বারান্দায় থাকা রোগীদের বিষয়ে তিনি বলেন, “বেডেই রয়েছে বেশিরভাগ রোগী। হয় তো কয়েকজন মেঝেতে রয়েছেন।”

ওয়ার্ডে ২০টি বেডের বিপরীতে রোগী আছে ৪৫ জন।

বেশিরভাগ রোগীই বেডের বাইরে রয়েছে- এমন প্রমাণ রয়েছে জানালে সুর পাল্টে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বলেন, “ডেঙ্গু রোগীদের অবশ্যই বিশেষ ব্যবস্থাপনায় রাখা উচিত, তাদের চিকিৎসার কোনও ঘাটতি নেই।”

স্ট্যান্ড না থাকায় চিকন তারে স্যালাইন ঝুলানোর প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কিছুটা রেগে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক।

তিনি বলেন, “এটা হওয়ার কথা না। আপনার আর কিছু জানার থাকলে আমার অফিসে এসে কথা বলেন, আমি আপনার কথা নিচ্ছি না।”

তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এখনকার চিত্র ‘ভীষণ অব্যবস্থাপনার উদাহরণ’ বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “ডেঙ্গু যখন বাড়ে তখন আমরা মশা নিয়ে কথা বলি। কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার কী হাল- সেটা কেউ দেখে না, কথাও বলে না।”

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল জানান, একজন ডেঙ্গু রোগীকে কোনোভাবেই মশারি ছাড়া এবং অন্য রোগীদের সঙ্গে এক ওয়ার্ডে রাখা যাবে না।

তিনি বলেন, “ডেঙ্গু রোগীদের যদি মেঝেতে, ফ্যান-মশারি ছাড়া এবং অন্য রোগীদের একসঙ্গে রাখা হয়, তাহলে বলতে হবে রোগী ব্যবস্থাপনার মিনিমাম প্রিন্সিপাল সেখানে ফলো করা হচ্ছে না। দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতালের যদি এই অবস্থা হয় এবং সেটা মনিটরিং না করা হয় তাহলে তা ভীষণ অব্যবস্থাপনার উদাহরণ।”

ডেঙ্গু আর বাইরে কী ছড়াবে, এখান থেকেই তো ছড়াচ্ছে, যোগ করেন আবু জামিল ফয়সাল।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত