কক্সবাজারের মহেশখালীর ভাসমান টার্মিনাল দিয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ বাড়িয়েছে পেট্রোবাংলা। ১৭ অক্টোবর থেকে দিনে গড়ে ৯শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে; যা এর আগে ছিল ৬শ’-৭শ’ মিলিয়ন ঘনফুট। এর ফলে দেশে মোট গ্যাস সরবরাহ আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে সরবরাহ বাড়লেও সার্বিকভাবে গ্যাস সংকট কাটেনি।
মহেশখালীতে থাকা ভাসমান দুটি টার্মিনালের একটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক্সিলারেট এনার্জি (এমএলএনজি) আগে থেকেই সচল ছিল। দেশীয় প্রতিষ্ঠান সামিট এলএনজি টার্মিনাল (এসএলএনজি) কারিগরি ত্রুটি সারিয়ে সাড়ে চারমাস পর সচল হয় ১২ সেপ্টেম্বর। কিন্তু পর্যাপ্ত গ্যাসভর্তি জাহাজ না থাকায় সেই টার্মিনাল দিয়ে কাঙ্ক্ষিত গ্যাস সরবরাহ দেওয়া যায়নি। ফলে এলএনজি সংকট থেকেই যায়।
স্পট মার্কেট থেকে কেনা এলএনজিভর্তি জাহাজ দেশে পৌঁছার পর ১৭ অক্টোবর থেকে এলএনজি সরবরাহ বাড়ানো হয়। এখন প্রতিদিন ৯শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে দুটি ভাসমান টার্মিনাল। যদিও দুটি টার্মিনালের গ্যাস সরবরাহ সক্ষমতা ১১শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। কিন্তু যোগান পর্যাপ্ত না থাকায় দিনে ২শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম সরবরাহ দিতে পারছে পেট্রোবাংলা।
জানতে চাইলে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “১৭ অক্টোবর থেকে দুটি টার্মিনাল দিয়েই আমরা ৯শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দিচ্ছি। এরফলে এলএনজি সরবরাহ আগের চেয়ে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। পর্যাপ্ত এলএনজি মজুদ না থাকায় আমরা সক্ষমতা অনুযায়ী সরবরাহ দিতে পারছিলাম না। সরকারিভাবে জিটুজি ভিত্তিক এলএনজি আগে থেকেই ছিল, কিন্তু স্পট মার্কেট থেকে এলএনজির দুটি জাহাজ আসায় আমরা সরবরাহ বাড়াতে পেরেছি।
“সরকার স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি ক্রয়ের যে আদেশ দিয়েছে সেটি ঠিক থাকলে নভেম্বর পর্যন্ত আমরা এই পরিমাণ (৯শ’ মিলিয়ন ঘনফুট) এলএনজি সরবরাহ দিতে পারব। দুটি টার্মিনালের ১১শ’ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতার বিপরীতে পুরোটাই দিতে পারব কিনা সেটি সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে।”
সরকার দুইভাবে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে থাকে। একটি হচ্ছে, সরকারের সঙ্গে সরকারের (জিটুজি) দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিভিত্তিক। আরেকটি হচ্ছে, তালিকাভুক্ত বিদেশি ২৩ কম্পানির কাছে থাকা স্পট মার্কেট থেকে। চুক্তিভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি সরবরাহ নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। কাতারের রাস গ্যাস থেকে ২০২৪ সালে ৪০ কার্গো জাহাজ এলএনজি আনার চুক্তি আছে, বিপরীতে জুলাই পর্যন্ত এসেছে ২৪ কার্গো। আর ওমানের ওমান ট্রেডিং থেকে ১৬ কার্গো জাহাজ আনার চুক্তির বিপরীতে জুলাই পর্যন্ত এসেছে ৯ কার্গো।
কিন্তু স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার ক্ষেত্রে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত বদলেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগে আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেটে তালিকাভুক্ত ২৩টি কোম্পানির কাছ থেকে এলএনজি কেনার ক্ষেত্রে কোটেশন নিয়েই অনুমোদন দেওয়া হতো। এক্ষেত্রে দ্রুত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ (বিশেষ) আইন ২০১০ অনুসরণ করা হতো। এখন সেই ২৩ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে এলএনজি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ৪ সেপ্টেম্বর অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়। ফলে স্পট মার্কেট থেকে সেই এলএনজি কিনে দেশে পৌঁছতে সময় লেগে যায়।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশে স্পট মার্কেট থেকে কেনা এলএনজি দেশে না আসায় ৫ অক্টোবর পর্যন্ত দিনে ৬শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল পেট্রোবাংলাকে। এলএনজি আসার পর ১৭ অক্টোবর থেকে দিনে ৯শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যোগ হলে সেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। কিন্তু মোটাদাগে দেশের মোট গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি।
গ্যাস উত্তোলন সরবরাহে নিয়োজিত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার ২০ অক্টোবরের হিসাব বলছে, দেশে দিনে ৩ হাজার ৮২৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়ার সক্ষমতা আছে প্রতিষ্ঠানটির। যদিও সেই সক্ষমতা পেট্রোবাংলা কখনই পূরণ করতে পারেনি। ৩ হাজার ৮২৯ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার বিপরীতে ২০ অক্টোবর পাওয়া গেছে ২ হাজার ৮৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। সক্ষমতার বিপরীতে সরবরাহের হার ৭৪ শতাংশ।
দুটি টার্মিনাল চালুর আগে ৩ অক্টোবরের গ্যাস সরবরাহের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সেদিন সক্ষমতার বিপরীতে এলএনজিসহ মোট ২ হাজার ৬৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়। সরবরাহের হার ছিল ৬৯ শতাংশ।
অর্থ্যাৎ দুটি টার্মিনাল চালুর পর এখন সরবরাহ বেড়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। ফলে গ্যাস সংকট রয়েই গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পেট্রোবাংলার এক শীর্ষ কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “৩ হাজার ৮২৯ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার বিপরীতে আমরা যদি ৩ হাজার থেকে ৩১শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দিতে পারি, তাহলে কোনোমতে গা বাঁচিয়ে চলা যায়। গ্যাস সংকট নিয়ে এত হাহাকার থাকে না। আমাদের মনে হয় না ডিসেম্বর নাগাদ দিনে ৩১শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দিতে পারব। ফলে আগামী ক’মাস এভাবেই চলতে হবে।”
বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে, দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াট। বিপরীতে সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট থেকে সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। গ্যাস সংকট প্রভাব ফেলছে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও।
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সাড়ে ৪৪ শতাংশ অর্থ্যাৎ ১২ হাজার মেগাওয়াটই গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত গ্যাস না পাওয়ায় বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রই এখন অলস বসে আছে। এর বাইরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৬ শতাংশ বিদ্যুৎ ও সৌরবিদ্যুৎ থেকে ২ শতাংশ বিদ্যুতের যোগান আসে। জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে ২১ শতাংশ। চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় এখন সরকারকে জ্বালানি তেল পুড়িয়েই বিদ্যুতের সংকট সামাল দিতে হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশি খরচ করতে হচ্ছে।
আবার গ্যাস না পাওয়ায় গ্যাসনির্ভর শিল্প কারখানার উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। রেশনিং করেই সামাল দিতে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সার উৎপাদন কারখানাগুলো।
চট্টগ্রাম বিভাগে ২৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৪ হাজার ৮৫৭ মেগাওয়াট। বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১৬শ’ থেকে ১৮শ’ মেগাওয়াট। অর্থ্যাৎ সক্ষমতার বিপরীতে সরবরাহের হার ৩৭ শতাংশ।
উৎপাদন এত কমার কারণ হচ্ছে গ্যাস ও কয়লা সংকট। চট্টগ্রামে গ্যাসনির্ভর পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ আছে, যাদের উৎপাদন সক্ষমতা ৮৬২ মেগাওয়াট। বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১৮০ মেগাওয়াট। পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে বন্ধ আছে তিনটিই।
চট্টগ্রামে কয়লাভিত্তিক দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ২ হাজার ৩৭৪ মেগাওয়াট। বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৮শ’ মেগাওয়াট। এতে দেশজুড়ে বিদ্যুৎ সংকট কাটছে না।