Beta
মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫

ক্যামেরা দেখলেই ভোটের লাইনে

ঢাকা-১৭
ঢাকা-১৭ আসনের একটি ভোটকেন্দ্র
[publishpress_authors_box]

ঢাকা-১৭ আসনের গ্রিন হেভেন স্কুল কেন্দ্র। সকাল থেকেই বাইরে ছিল নেতাকর্মীদের ভীড়। তবে যখনই কোনও টেলিভিশনের ক্যামেরা ওই কেন্দ্রে প্রবেশ করছিল, তখনই এসব নেতাকর্মীরা লাইনে দাঁড়িয়ে হয়ে যাচ্ছিলেন ভোটার। ক্যামেরা বেরিয়ে যেতেই আবার আগের মতো এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন তারা।

কেবল এই একটি কেন্দ্রে নয়, আসনটির কেন্দ্রগুলো ঘুরে একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে। ঢাকার আরও কয়েকটি কেন্দ্রেও একইভাবে ক্যামেরার সামনে ভোটার সেজে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা।  

দিনভর ভোটের খবর সংগ্রহে মাঠে ছিলেন প্রিন্ট, অনলাইন, ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা। বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে দেখা গেছে, যখনই ক্যামেরা পৌঁছেছে বা ছবি তুলতে উদ্যত হয়েছেন ফটো সাংবাদিকরা, তখনই ভোটারদের লম্বা লাইন দেখা গেছে। কিন্তু ক্যামেরা সরে যেতেই সেই ‘ভোটার’রা লাইনচ্যূত হয়েছেন।

গ্রিন হেভেন স্কুল কেন্দ্রে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। বেশিরভাগই এড়িয়ে যান। এক তরুণ বলেন, “টিভিতে চেহারা দেখাবে তাই লাইনে দাঁড়াইছি। এইডা কোনও সমস্যা না।”

ভোট শুরুর আগে

সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৮ টা পর্যন্ত ঢাকা-১৭ আসনের ১৫, ১৮ ও ২০ নং ওয়ার্ডের ১২টি কেন্দ্র ঘুরেছি। চারটি কেন্দ্রের সামনে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছি নৌকার পোলিং এজেন্টদের। শুধুমাত্র একটিতে স্বতন্ত্র একজন প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট ছিলেন।

সেসময় পোলিং অফিসাররা ছিলেন দারুণ ব্যস্ত। কেন্দ্রের ফটকে এবং দেওয়ালে নির্দেশনা লেখা পোস্টার টানাচ্ছিলেন তারা।

এই আসনের অন্যতম ভেন্যু ভাষানটেক উচ্চ বিদ্যালয়। একসঙ্গে চারটি কেন্দ্র পড়েছে এখানে। বিদ্যালয়টিতে যেতে মূল সড়ক থেকে সরু গলি দিয়ে বেশ খানিকটা ভেতরে যেতে হয়। সকালে গলির মুখেই চেয়ার নিয়ে বসে ছিলেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর আনুমানিক ১৫ নেতাকর্মী। ভোট শুরু হতেই সেই সংখ্যা বেড়ে প্রায় পঞ্চাশে দাঁড়ায়। কথা বলে জানলাম, এরা কেউই স্থানীয় ভোটার নন। তবে সবাই নিজেদের ছাত্রলীগ কর্মী বলে পরিচয় দিলেন।

ভোটার না, তারপরেও সকাল থেকে কেন্দ্রের সামনে কী করছেন জানতে চাই তাদের কাছে।

ছাত্রলীগ কর্মী পরিচয় দেওয়া সারোয়ার রাজীব জানান, ভোটাররা যেন সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারেন সেজন্যই ‘বড়ভাইয়ে’র নির্দেশে এখানে আছেন।

এই কেন্দ্রে নৌকা ছাড়া অন্য কোনও দলের পোলিং এজেন্ট দেখা যায়নি।

ভোট হলো শুরু

নির্ধারিত সময়ের আগেই সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছিল। কিন্তু সকাল ১০টা পর্যন্ত পোলিং অফিসারদের অলস সময় কাটাতেই দেখা গেল বেশিরভাগ কেন্দ্রে। ভোটার না থাকায় অনেকে বুথ থেকে বের হয়ে বাইরে ঘোরাঘুরিও করছিলেন।

একটি বুথে পোলিং অফিসারদের বেঞ্চে মাথা রেখে বসে থাকতে দেখা যায়। বেসরকারি টেলিভিশনের একজন ক্যামেরাপারসন সেই দৃশ্য ধারণ করেন। বিষয়টি টের পেয়ে প্রিজাইডিং অফিসার সাংবাদিকদের ‘ধমক’ দেন। ওই ক্যামেরাপারসনকে দৃশ্যটি মুছে ফেলতেও অনুরোধ করেন।

বিষয়টি ব্যাখা করে তিনি বলেন, “উনারা ঘুমাচ্ছিলেন না। ঝিমুনির জন্য হয়ত মাথা নিচু করে রেখেছিলেন। এখন ঠিক আছে। এবার আপনি আরও কয়েকটা ছবি নেন সুন্দর করে।”

আসনটির অনেক কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট দেরিতে আসায় ভোট গ্রহণ শুরুই হয় সাড়ে ৮টার পরে। কিছু কেন্দ্রে আবার ভোটারদের ভোট দিতে আসতে মাইকে আহ্বানও জানানো হয়।

সকাল ১০টার কেন্দ্রগুলোর দৃশ্য কিছুটা বদলে যেতে থাকে। খুব ধীরে হলেও বাড়ছিল ভোটার সংখ্যা। বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত ভোটারদের ভালোই উপস্থিতি ছিল। তবে যদি মোট ভোটারের হিসাব করি, তাহলে ভোটার উপস্থিতির সংখ্যা ছিল খুবই নগন্য।

অন্য ভেন্যুর চেয়ে বড় বালুঘাট উচ্চ বিদ্যালয়। এখানেও চারটি কেন্দ্র। সকাল থেকেই ছিল ভোটারদের উপস্থিতি।

ভোটকেন্দ্রের সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর অবস্থান। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

সকাল ৮টা ১০ মিনিটে এই কেন্দ্রে প্রথম ভোট দেন আব্দুল তৈয়ব। তিনি জানান, পরিবারে ছয়জন ভোটার। যার মধ্যে চারজনই নারী। তারা ঘরের কাজ সেরে বেলা বাড়লে ভোট দিতে আসবেন।

এই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আরিফুর রহমান বলেন, তার কেন্দ্রের পুরুষ ভোটার ২ হাজার৮০৭ জন। দুপুর ১২ টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ১১৫ জন।

একই ভেন্যুর নারী কেন্দ্রে একই সময় পর্যন্ত ভোট পড়েছিল ৫১টি, মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৭৯০ জন।

মানিকদী ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার প্রিজাইডিং অফিসার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ভোটের পরিমাণ সম্পর্কে।

সরাসরি উত্তর না দিয়ে পাশে থাকা এক পুলিশ সদস্যের কাছে তিনি জানতে চান, “এই তথ্য কী উনাকে দেওয়া যাবে?”

পুলিশ সদস্য বলেন, “হ্যাঁ দেন, সমস্যা নেই।”

তখন মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, “দুপুর ২টা পর্যন্ত সাড়ে ৫০০ ভোট পড়েছে।”

তার কেন্দ্রে মোট ভোটার কতজন তা জানতে চাইলে জবাব মেলে, “আমি ব্যস্ত”।

মানিকদী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার তানভীর মিথুন জানান, কেন্দ্রের মোট ভোটার ৩ হাজার ২৬৪ জন। বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৫৭৬টি।

সবচেয়ে কম ভোটার উপস্থিতি দেখেছি ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত ২২ নম্বর কেন্দ্র শিশুমঙ্গল আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

সেখানকার প্রিজাইডিং অফিসার রুহুল আমিন বাশিরের কাছে সকাল ১০টা এবং দুপুর ২টায় গিয়ে ভোট কেমন পড়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অনেক ব্যস্ত আছি। এখন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না।”

বয়স হয়েছে, তবু ভোট দিতে এসেছেন তিনি। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

তবে কেন্দ্রের বাইরে অবশ্য ভোটারের তেমন উপস্থিতি দেখলাম না। পোলিং এজেন্টও ছিলেন কেবল তিনজন। যাদের হাতে নৌকার লিফলেট দেখা গেল।

মাটিকাটার ইন্সপায়ার গ্রামার স্কুল কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার রাকিবুল হাসানের কাছেও কেমন ভোট পড়েছে জানতে চাই। জবাব মেলে, “আমাদের কথা বলতে মানা আছে। কিছু মনে করবেন না, প্লিজ।”

শেষ ভোট দিতে কেন্দ্রে

“এইডাই আমার শেষ ভোট খালা। হেরপর ভোট দিওন অব্দি আর বাঁইচা থাকবো না। এইবারকার শীতেই আল্লাহ ডাইকা লইব আমারে।”

ভোট দিয়ে বেরিয়ে এভাবেই নিজের অনুভূতি বললেন হালিমা খাতুন। সঙ্গে থাকা ভোটার কার্ডের জন্ম নিবন্ধনের তারিখ অনুযায়ী তার বয়স ৯১ বছর।

বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে পড়েছেন। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতেই ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা জানালেন এই বর্ষীয়ান নারী।

বললেন, স্বামী বেঁচে থাকতে দুজন একসঙ্গে ভোটকেন্দ্রে যেতেন। স্বামী মারা গেছেন ছয় বছর, সন্তানও নেই। থাকেন ভাইয়ের ছেলের আশ্রয়ে। শরীর খারাপ, তারপরও স্বামীর কথা মনে করে ভোট দিতে এসেছেন।

নারী ভোটারের উপস্থিতি বেশি

ঢাকা-১৭ আসনের কেন্দ্রগুলো ঘুরে নারী ভোটারদের উপস্থিতি তুলনামূলক বেশিই দেখা গিয়েছে।

কড়াইল এলাকার নারী ভোটারদের জন্য চারটি কেন্দ্র বনানী মডেল স্কুলে। বেলা ১১টার দিকে ভোট দিয়ে ফিরছিলেন চার নারী।

ভোট দিয়ে বের হয়ে উচ্ছ্বসিত এই নারী। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

কথা বলি তাদের সঙ্গে। রাইসা আক্তার নামে একজন জানান, কলোনী থেকে ১৮ জন একসঙ্গে ভোট দিতে এসেছেন। কোনোভাবে জানতে পেরেছেন দুপুর ২টার পর ‘গ্যাঞ্জাম’ হবে। তাই সকাল সকাল এসে ভোট দিয়ে গেলেন।

ওই সময় প্রতিটি কেন্দ্রেই নারী ভোটারদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে।

নতুন ভোটারের উচ্ছ্বাস

দুপুর আড়াইটার দিকে মাটিকাটার একটি কেন্দ্রে ভোট দিয়ে বের হন এক তরুণ ভোটার সায়মা পারভীন। মায়ের সঙ্গে ভোট দিতে এসেছেন তিনি, যদিও মা অন্য কেন্দ্রের ভোটার হওয়ায় তাকে পথে আটকে দেন আনসার সদস্যরা। পরে পোলিং এজেন্টের সহায়তা নিয়ে কেন্দ্র গিয়ে ভোট দেন সায়মা।

ভোট দিয়ে বেরিয়েই অমোচনীয় কালি লাগানো আঙুলের ছবি তুলছিলেন। জানালেন, ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করবেন। তার অনেক বন্ধুই এখনো জাতীয় পরিচয়পত্র পায়নি। তিনি পেয়েছেন, ভোটও দিলেন। এটি তার জন্য ভীষণ আনন্দের।

সায়মার মতো আরও অনেক নতুন ভোটার দেখা গেল কেন্দ্রগুলো ঘুরে। কীভাবে ভোট দিতে হবে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন মাথায় নিয়ে কেন্দ্রে ঢুকছিলেন তারা। সেইসঙ্গে বিপুল উচ্ছ্বাস নিয়ে প্রথমবার ভোটও দিয়েছেন।

এমন নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। রবিবার সকাল ৮টায় শুরু হওয়া ভোটগ্রহণ শেষ হয় বিকাল চারটায়।

ঢাকা-১৭ আসনের ২৭টি কেন্দ্র ঘুরে ভোটার উপস্থিতি কম দেখেছি। তবে বিপুল উৎসাহ নিয়ে ভোট দিতে এসেছেন এমন মানুষের দেখাও মিলেছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত