বায়ুদূষণে ২০২৩ সালে বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। বিশ্বে বায়ু মান নিয়ে লাইভ আপডেট দেওয়া সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ু মান প্রতিবেদন ২০২৩’-এ এই তথ্য উঠে এসেছে।
অনলাইন গণমাধ্যম সকাল সন্ধ্যা’য় গত ১৯ মার্চ ‘২০২৩ সালে বায়ুদূষণে শীর্ষে বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ‘‘২০২৩ সালে বাংলাদেশের গড় বায়ু মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত নিরাপত্তা নির্দেশিকা অতিক্রম করে প্রায় ১৬ গুণ বাড়ে। ফলে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ বায়ু মানের দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। পাকিস্তান ও ভারত তালিকায় বাংলাদেশের পরেই অবস্থান করেছে। ভারতের সর্বোচ্চ দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ৯টিই শীর্ষ ১০ তালিকায় রয়েছে।’’
‘বৈশ্বিক বায়ু মান প্রতিবেদন ২০২৩’-এর সূত্র ধরে গত ১৯ মার্চ প্রথম আলো’তে একই বিষয় নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, বায়ুদূষণে নগর হিসেবে বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ নগর ঢাকা। আর একদম শীর্ষে আছে ভারতের রাজধানী দিল্লি। বায়ু মান প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, জলবায়ু সংকট এই খারাপ বায়ু মানের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করছে।
এ প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে গবেষণায় বিশেষভাবে খুবই সূক্ষ্ম ধুলিকণা বা ‘পিএম ২.৫’ নামের কণার উপরে নজর দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষুদ্র এই কণাটি স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকারক। সকাল সন্ধ্যা’র প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে— বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাতাসে বার্ষিক গড় পিএম ২.৫-এর মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের (2021 AQGs) বেশি হওয়া চলবে না। বায়ু নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে ৭ হাজার ৮০০-এর বেশি শহরের মধ্যে মাত্র ৯ শতাংশ শহরেই এই নিরাপদ মাত্রা মেনে চলা হচ্ছে।
সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবীতে বায়ুর আছে বিশেষ একটি অবদান। পৃথিবী গড়তে বায়ু যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, তেমনি এর পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করতেও পালন করছে অভূতপূর্ব ভূমিকা। নাইট্রোজেন ৭৮ শতাংশ, অক্সিজেন ২০ শতাংশ, আর্গন ০.৯৩ শতাংশ, কার্বন ডাই অক্সাইড ০.০৪ শতাংশ এবং অন্যান্য গ্যাস দিয়ে বায়ু তৈরি হয়। যদি কোনও কারণে এই উপাদানগুলোর ঘাটতি হয় বা কোনওটি অতিরিক্ত হয়ে যায়, তখন বায়ুর মান সঠিকভাবে থাকে না। অথবা এই বায়ুর সঙ্গে যদি কোনও কারণে অন্য কোনও গ্যাস বা ধূলিকণা এসে মিশ্রিত হয়— তখনও এর মান ঠিক থাকে না। বায়ুর এই মান সঠিক না থাকাকেই আমরা বায়ু দূষণ বলে থাকি।
আমরা প্রতিদিন যে বায়ু গ্রহণ করি তা বিভিন্নভাবে দূষিত হয়ে থাকে। এই দূষণগুলো মূলত আমাদের এই দৈনন্দিন কার্যকলাপ থেকেই তৈরি হচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে এই দূষণের মাত্রা এমনই এক ভীতিকর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যা পৃথিবীর পরিবেশ, প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য, অর্থনীতি এবং মানব স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ ঝুঁকি তৈরি করছে। তাই দূষিত বায়ুকে এখন নীরব ঘাতক বলা হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এই দূষণ ঘরে এবং বাইরের পরিবেশকে করছে সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এর ফলে শিশু, বয়স্ক মানুষ, তরুণ-তরুণীসহ যে কোনও বয়সের মানুষ স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে পড়ছে। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি ১০ জনের প্রায় ৯ জন মানুষই দূষিত বায়ু গ্রহণ করছে।
বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের একটি প্রধান দূষিত বায়ুর দেশ। বায়ু দূষণ বাংলাদেশে এখন একটি বিশাল পরিবেশগত সমস্যা। বায়ু দূষণের কারণে শহর অঞ্চলের লোকজন বিশেষ করে ঢাকা শহরের পাঁচ বছরের নিচের শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, এলার্জি, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ছাড়াও অন্য অনেক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এটা অনেক সময় মানুষের মানসিক রোগও তৈরি করছে। এই বায়ু দূষণে প্রতিবছর দেশে প্রায় ৭৮ থেকে ৮৮ হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ যা বিভিন্ন পরিসংখ্যানে উঠে আসছে।
ঢাকার বায়ু দূষণের বেশিরভাগটাই হয় গাড়ির দূষিত নির্গমন থেকে। পরিবেশ বিভাগের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, অনেক মোটরসাইকেল, বাস, এবং ট্রাক নির্গমন ব্যবস্থার মান অনুসারে উত্তীর্ণ হয়নি। এই গাড়িগুলোর দূষণ নির্গমন ঢাকার বায়ু মানের অবনতির অন্যতম প্রধান কারণ। যদিও একাধিক গাড়ি রাখার ওপর কার্বন কর আরোপের কথাও দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া মেয়াদ উত্তীর্ণ পুরনো বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন গাড়ি সরিয়ে নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। তবে শুধু মেয়াদ উত্তীর্ণ গাড়ি সরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে বায়ু দূষণ ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। এছাড়া ঢাকার রাস্তায় প্রচণ্ড যানজটসহ উচ্চ দূষণযুক্ত ডিজেলের ব্যবহার— এগুলোও বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
২০২৩ সালে ঢাকার বাসিন্দারা মাত্র আট দিন ‘ভালো’ বায়ুর শ্বাস নিয়েছে। এর কারণ হলো বায়ু মানের সূচক (AQI) বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বায়ু দূষণের সমস্যাকে আরও প্রকট করেছে। নিয়ন্ত্রণহীন রাস্তার কাজ, যত্রতত্র উন্মুক্তস্থানে নির্মাণ সামগ্রী রাখা, অপরিকল্পিত নির্মাণ কাজ, বাড়তি যানজট এবং ফিটনেস না থাকা গাড়ি— এই দূষণের প্রধান কারণ। বায়ু দূষণ কমাতে এই ফ্যাক্টরগুলো নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি।
বায়ু দূষণ কমিয়ে আনতে বিশেষজ্ঞদের আলোচনা ও গবেষণায় পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা ও কাঠামো প্রবর্তনের বিষয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা হলো এমন একটি পরিবহন পদ্ধতি এবং অবকাঠামো নেটওয়ার্ক যা পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাবগুলো হ্রাস করার জন্য ডিজাইন করা হয়। এই সিস্টেম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন, বায়ু ও শব্দ দূষণ, শক্তি খরচ এবং জমির ক্ষয় হ্রাস করে স্থায়িত্বকে অগ্রাধিকার দেয়।
পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থায় পরিবহন ও যাতায়াতের বিভিন্ন উপায়কে অন্তর্ভুক্ত করে। এর মধ্যে রয়েছে পাবলিক ট্রানজিট, হাঁটা, সাইকেল চালানো, বৈদ্যুতিক যান এবং বিকল্প জ্বালানি, সেইসঙ্গে সহায়ক নীতি, অবকাঠামো এবং প্রযুক্তি যা পরিবেশবান্ধব অনুশীলনের প্রচার করে। একটি পরিবেশগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থার লক্ষ্য হলো, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ, পণ্য ও সেবাগুলোকে স্থানান্তরিত করার একটি স্বাস্থ্যকর, পরিচ্ছন্ন এবং আরও টেকসই উপায় তৈরি করা।
বিশ্বের অনেক দেশে বায়ুর বর্তমান মান নিয়ন্ত্রণ করতে পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থায় বেশ উন্নতি ঘটেছে। তেমনই একটি পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থার নাম মেট্রোরেল। এই মেট্রোরেল ব্যবস্থা বায়ু দূষণ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনসহ বায়ুর গুণগত মান বজায় রাখতে সাহায্য করে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বৈদ্যুতিক গণপরিবহন মেট্রোরেল ব্যবস্থা চালু হয়েছে। বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এশিয়ায় ২২তম দেশ হিসেবে মেট্রোরেল চালু করেছে বাংলাদেশ।
মেট্রোরেল সিস্টেম পরিবেশ ও চারপাশের বায়ুর গুণগতমান বজায় রাখতে সাহায্য করে নানাভাবে। প্রযুক্তিগতভাবে মেট্রোরেল বৈদ্যুতিকভাবে চলে। তাই মেট্রোরেল বায়ু দূষণ ঘটানোয় কোনও প্রভাব রাখে না বলে বিভিন্ন গবেষণায় ওঠে এসেছে। কিন্তু অন্য গণপরিবহন চালাতে ডিজেল, অকটেন বা বেঞ্জিন ইঞ্জিন ব্যবহার হয় যা পরিবেশের ক্ষতি করে। এছাড়া মেট্রোরেলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক যাত্রী একসঙ্গে পথ চলার সুযোগ পেতে পারে। এর ফলে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়।
মেট্রোরেল বায়ু মান ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং বিভিন্ন ধরনের পরিবহনের ওপর নির্ভরতা কমাতেও ভূমিকা রাখে। এটা এমনকি ইলেকট্রনিক টিকিট ব্যবহার করার কারণে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। মেট্রোরেলের কাঠামো ও ব্যবহারের নিয়ম-কানুন জনগণের মধ্যে নিয়মনিষ্ঠ হওয়ার সচেতনতা বাড়াতে ভূমিকাও রাখে।
এটাও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, মেট্রোরেল কতটা বায়ু দূষণ কমায় তা সিস্টেমের আকার এবং দক্ষতা, রাইডারশিপ লেভেল, বিদ্যুতের উৎস এবং এলাকার সামগ্রিক পরিবহন নেটওয়ার্কের বাস্তবতার ওপর নির্ভর করে। নানা বিবেচনায় মেট্রোরেলকে সাধারণত একটি পরিবেশবান্ধব পরিবহন হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের তথ্যানুসারে, উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত পুরো রুট শেষ করার জন্য পরিবেশবান্ধব মেট্রোরেলের জন্য প্রতিদিন ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের যোগান দিতে যেন অন্য কোনও উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা না হয় যেটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। তাই মেট্রোরেলের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়াও পরিবেশবান্ধব করা দরকার। এমন পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে মেট্রোরেলের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
পরিবেশবান্ধব পরিবহন এখন সময়ের দাবি, যেটা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে আমাদের দেশে। এখন শুধু এর ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে এবং এর প্রয়োজন বিবেচনা করে আমাদের সেইদিকেই অগ্রসর হতে হবে। এই পদক্ষেপ আমাদের শহরাঞ্চলে বায়ুদূষণ হ্রাস করতে অবদান রাখতে পারে। আসলে সবার সম্মিলিত পরিকল্পিত উদ্যোগই পারে বায়ুদূষণ কমাতে। এই কাজটি শুরু করতে হবে এখনই।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বায়ু দূষণ বিষয়ে পিএইচডি। বর্তমানে ইউএনডিপি-বাংলাদেশে কর্মরত।
ইমেইল: phdinpollution@gmail.com