Beta
শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

২১ চিকিৎসককে বদলি, কারণ কি ফেইসবুক পোস্ট

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেকেই সাম্প্রতিক সহিংসতায় আহত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেকেই সাম্প্রতিক সহিংসতায় আহত।
Picture of জাকিয়া আহমেদ

জাকিয়া আহমেদ

কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সহিংসতা নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাঁচ শিক্ষক চিকিৎসককে ঢাকা থেকে বদলি করা হয়েছে, কর্মস্থল পরিবর্তন হয়েছে আরও ১৬ চিকিৎসকের।

আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়ার কারণে সরকারের রোষের শিকার হয়েছেন বলে এই শিক্ষকরা অভিযোগ করছেন।

সেই অভিযোগ অস্বীকার করে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. টিটু মিঞা বলছেন, এটা ‘রুটিন বদলি’।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন গত ১৫ জুলাই সহিংসতায় গড়ানোর পর কয়েক দিনে দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অফিস-আদালত বন্ধ করার পাশাপাশি ইন্টারনেট অচলের পর কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করতে হয় সরকারকে।

সীমিত পরিসরে অফিস খোলার দিন ২৪ জুলাই ও ২৫ জুলাই মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাঁচ শিক্ষককে বদলি করা হয়। তাদের সাতদিনের মধ্যে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে বলা হয়।

তারা হলেন- সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নুর আহমেদ গিয়াস উদ্দিন, সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. নাঈম দেওয়ান, স্পাইন সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাক ডা. মো. শহীদুল ইসলাম আকন, ভাইরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা ও প্যাথলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রিজওয়ানা রহমান খান।

গত ২৪ জুলাই ডা. রিজওয়ানাকে সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয়। পরদিন বাকি চারজনের বদলির আদেশ হয়।

তাদের মধ্যে নেত্রকোণা মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয় ডা. নূর আহমেদ গিয়াসউদ্দিনকে। সাইকিয়াট্রির এই চিকিৎসককে বদলি করা হয়েছে কার্ডিওলজি অ্যান্ড সিসিইউ বিভাগে।

পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলি করা হয়েছে ডা. নাঈম দেওয়ানকে। সার্জারির এই চিকিৎসক পাঠানো হয়েছে গ্যাস্ট্রোঅ্যান্টোরোলজি বিভাগে।

শহীদুল ইসলাম আকনকে সুনামগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয়েছে। স্পাইন সার্জারি বিভাগের এই সহযোগী অধ্যাপককে বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে পাঠানো হয়েছে।

ভাইরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানাকে বদলি করা হয়েছে নীলফামারী মেডিকেল কলেজে নেফ্রোলজি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে।

এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন চিকিৎসালয় থেকে ১৬ জন চিকিৎসককে বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হয়েছে।  

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. উত্তম কর্মকারকে বদলি করা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিউরোট্রমা সার্জারি বিভাগে।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. গাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে বদলি করা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজে।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রির সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. রশিদুল হক এবং কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শরীফ মুশফেকুর রহমানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয়েছে।

গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. অসীম কুমার সাহাকে নোয়াখালীর আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজে ফিজিওলজি পদে, যশোর মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক (সার্জারি) ডা. মো. আহসান হাবীবকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয়েছে।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের নিওনেটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আ ন ম নূরুল হক ভূঞাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের নিউরো মেডিসিন বিভাগে বদলি করা হয়েছে।

কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ত্রিদ্বীপ কান্তি বর্মনকে ময়মনসিংহ মেডিকেলে, গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. খন্দকার মো. সোহেল উল্লাহকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয়েছে।

নওগাঁ মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের প্রভাষক ডা. মো. যোবায়ের আল আমীনকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ধামুইরহাটের ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি) এবং কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. মো. আমিনুল ইসলামকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে জেলার পত্নীতলার মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট ট্রেনিং স্কুলে (ম্যাটস) পদায়ন করা হয়েছে।

এই চিকিৎসকদের সবার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ না হলেও কয়েকজন সকাল সন্ধ্যাকে বলেছেন, এই বদলিতে তারা বিব্রত, অপমানিত ও ক্ষুব্ধ।

একজন শিক্ষক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার কোনও পক্ষ নেই। ছাত্রজীবন থেকে মানুষের জন্য কাজ করেছি। সেদিন (১৭ জুলাই) যখন ঢাকা মেডিকেলে অনেক রক্তের প্রয়োজন হলো, তখন কেবল হাসপাতালে রক্ত দরকার বলে পোস্ট দিয়েছিলাম। জানতে পেরেছি, এই পোস্টের জন্য আমাকে বদলি করা হয়েছে।”

তাদের বদলির ক্ষেত্রে সোশাল মিডিয়ার পোস্ট দেখা হয়েছিল বলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে জানান।

তিনি বলেন, “ফেইসবুক পোস্টের জের ধরে তাদেরকে বদলি করা হয়েছে। বদলি করা হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে তাদের পক্ষে লেখার জন্য। সেসব লেখার স্ক্রিনশট আবার কিছু চিকিৎসকই জায়গামতো পৌঁছে দিয়েছেন।”

সরকারি চাকরিতে বদলি নিয়মিত বিষয় হলেও এই সময়ে বদলির ক্ষেত্রে তাদের সরিয়ে দেওয়াটাই মূল বিবেচ্য ছিল দাবি করে তার সপক্ষে কিছু যুক্তি দেখান একজন চিকিৎসক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই চিকিৎসক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একজন চিকিৎসক সাইকিয়াট্রিস্ট, তাকে বদলি করা হয়েছে হৃদরোগ বিভাগে। শহীদুল ইসলাম আকন একজন দেশসেরা স্পাইন সার্জন, তাকে বদলি করা হয়েছে বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে। মেডিকেল কলেজে বায়োকেমিস্ট্রি একটা প্রি-ক্লিনিক্যাল সাব্জেক্ট, শুধু স্টুডেন্ট পড়ানো আর পরীক্ষা নেওয়াই কাজ। সেখানে একজন স্পাইন সার্জনের কী কাজ?

“একজন ভাইরোলজিস্টকে বদলি করা হয়েছে কিডনি রোগ বিভাগে, একজন জেনারেল সার্জারির চিকিৎসককে বদলি করা হয়েছে গ্যাস্ট্রোলজি বিভাগে। এসব চিকিৎসকের বেশিরভাগকেই তাদের নিজ বিভাগ থেকে ভিন্ন বিভাগে বদলি করা হয়েছে।”

এক শিক্ষক বলেন, “কর্মকর্তারা হয়ত নিয়মিত বদলির অংশ হিসেবে এটা দেখাবে, কিন্তু কোনোভাবেই এটা নিয়মিত বদলি নয়।”

পাঁচ শিক্ষকের বদলি নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. শফিকুল ইসলামের মোবাইলে ফোন করা হলে প্রসঙ্গটি বলার পরই কলটি কেটে যায়। এরপর তাকে বারবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে জানান, বুধবার অধ্যক্ষ ডা. শফিকুল ইসলাম মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বদলি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

চিকিৎসক বদলির বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. টিটু মিঞা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা রুটিন প্রক্রিয়ার অংশ, অন্য কিছু নয়।”

শিক্ষকদের বদলি নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা মোটেই রুটিন বদলি নয়। রুটিন বদলি তখনই হতো, যদি এই শিক্ষকদের নিজ নিজ বিভাগে বদলি করা হতো।

“বদলি হবেই, সরকারি চাকরিতে নিয়মই তাই। কিন্তু রুটিন বদলিতে কখনও একজন শিক্ষককে নিজ বিভাগের বাইরে অন্য বিভাগে বদলি করা হয় না। স্কুল কলেজগুলোতে কি কোনও ইংরেজির শিক্ষককে ধর্ম পড়ানোর জন্য বদলি করা হয়? নাকি হয়েছে অথবা হবে?”

এই চিকিৎসক নেতা বলেন, “অথচ কত অব্যবস্থাপনা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে।”

অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান বলেন, “আমরা প্রথমত মানুষ এবং দ্বিতীয়ত চিকিৎসক। মানুষ হিসেবে এই সহিংসতায় যেভাবে মানুষ মারা গিয়েছে তার জন্য যে কারও মনে ক্ষোভ-কষ্ট তৈরি হবে। দ্বিতীয়ত হাসপাতালে রোগীদের জন্য যদি কারও মন কাঁদে তাহলে সে তো মানবিক চিকিৎসক। রোগীর জন্য তার মমতা রয়েছে।

“অথচ কেবলমাত্র এই কারণে যদি চিকিৎসকদের বদলি করা হয় তাহলে বলতে হবে, ফের ভুল করা হচ্ছে। আমি কোনোভাবেই একে রুটিন বদলি বলব না।“

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত