ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের বাইরের ফুটপাতে এক কোণায় দাঁড়িয়েছিলেন ৬৫ বছর বয়সী আলী মিয়া। ব্যবহৃত একটি লাল রঙের বালতি তার হাতে, একটি মগ ও একটি পাটিও আছে। এগুলো কম দামে বিক্রি করে দিতে চান তিনি, সেজন্য ক্রেতা খুঁজছিলেন। তা পেয়েও গেলেন।
আলী মিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার নাতি আলম হোসেন এই হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তার বাড়ি রংপুর। গত সপ্তাহে নাতিকে নিয়ে এসেছিলেন হাসপাতালে। তখন ব্যবহারের জন্য বালতি, মগ, পাটি কিনেছিলেন। এখন চলে যাবেন বলে বিক্রি করে দিলেন।
কিন্তু ফুসফুসের সমস্যায় আক্রান্ত আলমের চিকিৎসা এখনও শেষ হয়নি। চিকিৎসক বলেছেন, আরও এক সপ্তাহ থাকতে।
তারপরও কেন হাসপাতাল ছাড়ছেন- এই প্রশ্নে আলী বলেন, “না যাইয়া কি করুম? রাইত নাই দিন নাই, পুলিশ আইয়া ধইরা নিয়া যায়। আমার নাতি ক্লাস টেনে পড়ে। এহন তো যারা পড়ালেখা করে, তাদের নিয়া যায়।”
সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন গত ১৫ জুলাই সংঘাতে গড়ানোর পর দুই শতাধিক নিহত হওয়ার পাশাপাশি কয়েক হাজার আহত হয়। ঢাকার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় গুরুতর আহতদের অনেকেই এখন ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি।
সহিংসতার মধ্যে সরকারি অনেক স্থাপনা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসার পর এখন নাশকতায় জড়িতদের খুঁজে খুঁজে গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। এই অভিযানে নির্দোষ ব্যক্তিরাও ধরা পড়ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল থেকে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে- এমন নিশ্চিত তথ্য পাওয়া না গেলেও রাজধানীর বাইরে থেকে আসা অনেক তরুণ রোগীর স্বজন গ্রেপ্তারের ভয় পাচ্ছে।
হাসপাতালের বাইরে আলী মিয়ার মতো এমন আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারাও ভয় থেকে রোগীর চিকিৎসা শেষ না করেই বাড়ি ফিরতে চাইছে।
নারায়ণগঞ্জের ফাতেমা বিবি বলেন, “আমাদের তো আর বিপদ না। এখন যত বিপদ ছেলেমেয়েদের। জোয়ানরাই এহন সবচেয়ে বেশি মুশকিলে আছে। তার থেকে বাড়ি গিয়া সাবধানে থাকব, ওষুধ খাইব।”
ফাতেমা বিবির ছেলে জন্ডিসে আক্রান্ত। গত ২২ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসক কমপক্ষে এক মাস হাসপাতালে থাকতে বলেছে। কিন্তু এক সপ্তাহ না যেতেই ছেলেকে নিয়ে যেতে চাইছেন ফাতেমা।
তিনি বলেন, “স্যার তো (চিকিৎসক) যাইবার দিতে চায় না। আমরাই জোর করে চলে যাইতেছি। বলছি, ওষুধ লিখা দেন, নিয়ম করে ওষুধ খাইব।”
১৯ বছর বয়সী মেয়ের পেটে ব্যথা হওয়ার পর সিলেটে কোনও সমাধান না পেয়ে দুদিন আগে ঢাকা মেডিকেলে আসেন আসমা বেগম। তিনিও থাকতে চাইছেন না।
আসমা বলেন, “ডাক্তার অনেক টেস্ট দিছে। বলছে সেগুলো করে বুঝব, কী হলো মেয়েটার। কিন্তু এখানে তো আরেক বিপদ। শুনছি কম বয়সীদের ধইরা নিয়া যায় পুলিশ। পুলিশ দেখলেই বুক ধড়ফড় করে।”
মেয়েও ভয় পাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার মেয়ে আন্দোলনেও যায় নাই। অনেক ভীতু। সেও আমাকে বলছে, হাসপাতালে থাকবে না। এখানে তার ভয় লাগে।”
চিকিৎসক এখনও ছাড়পত্র না দেওয়া তা নিয়েও চিন্তায় রয়েছেন আসমা। তিনি বলেন, সোমবার চিকিৎসক এলে আবার ছাড়পত্রের অনুরোধ করবেন তিনি।
কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মধ্যে আহত হয়ে যারা হাসপাতালে রয়েছে, তাদের স্বজনদের ভয় বেশি। রংপুর থেকে গুলিবিদ্ধ ছেলেকে নিয়ে আসা এক ব্যক্তি ছেলের কাছছাড়াই হচ্ছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যক্তি বলেন, তার গুলিবিদ্ধ ছেলেকে নিয়ে গত ১৯ জুলাই থেকে ঢাকা মেডিকেলে আসেন। তার ছেলের অবস্থার উন্নতি হয়েছে, তবে চিকিৎসক আরও কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে বলেছে।
“এই কয়টা দিন সারারাত ঘুম নাই। না ঘুমাইয়া ছেলেকে পাহারা দিই। আল্লাহ কখন কী বিপদ রাখছে, কখন পুলিশ নিয়ে যাইবো, এই ভয়ে।”
এই আন্দোলনের মধ্যে ঢাকা মেডিকেলে সাংবাদিকদের তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি চলছে। কর্তব্যরত আনসার সদস্যরা সাংবাদিক দেখলে তেড়ে আসছেন। হাসপাতালের পরিচালকও সাংবাদিকদের দেখা দিচ্ছেন না।
হাসপাতালের কয়েকজন নার্স বলেন, গত দুদিন ধরেই অনেক রোগীর অভিভাবকই চিকিৎসা বাকি রেখেই ছুটির আর্জি জানাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নার্স বলেন, “তাদের সবার মধ্যেই এক ধরনের আতঙ্ক রয়েছে। দুদিন ধরে এই আতঙ্ক আরও বেশি। রোগীদের অনেকের স্বজন এসে এসে ডাক্তারদের খোঁজ করছেন, ডিস্টার্জ হতে চাচ্ছেন।”
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার কিংবা মামলার হয়রানিতে পড়তে হবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আশ্বাস দিয়েছেন।
নাশকতাকারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চললেও নির্দোষ কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না বলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র উপকমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সুনির্দিষ্ট মামলা ও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকে আটক করলেও তথ্য যাচাইয়ের পর তাদের ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাও আছে। প্রমাণ ছাড়া গ্রেপ্তারের অভিযোগ সঠিক নয়।”