কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় নিহতদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে যে ৯৯টি লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে, তাদের সবাই ছিলেন গুলিবিদ্ধ।
ঢাকা মেডিকেল মর্গে দায়িত্বরত এক পুলিশ কর্মকর্তা সোমবার সকাল সন্ধ্যাকে এই তথ্য জানিয়েছেন। তবে কতটি লাশ ঢাকা মেডিকেলে রয়েছে, সে বিষয়ে কোনও তথ্য প্রকাশ করছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এই আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি চালানোর নিন্দা জানিয়ে আইনজীবীদের একটি দল বলেছে, এর মধ্যদিয়ে সরকার ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত করেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে ঢাকা মেডিকেলে আহতদের ভিড় বাড়তে থাকে।
এরপর সংঘাতের মাত্রাও বাড়তে থাকে, ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। কয়েকদিনে নিহত হয় দুই শতাধিক, আহত হয় কয়েক হাজার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী নামাতে হয় সরকারকে।
ঢাকায় নিহতদের বেশিরভাগই আসে ঢাকা মেডিকেলে; আবার দেশের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আহতদের অনেককে ঢাকায় পাঠানো হয়, তাদের মধ্যেও কারও কারও মৃত্যু ঘটে।
ঢাকা মেডিকেলে যারা মারা গেছেন কিংবা যাদের লাশ আসে, সবারই স্থান হয় মর্গে। সেখানে ময়নাতদন্তের পর লাশ বুঝে নিতে হয় স্বজনদের।
সোমবার মর্গে দায়িত্বরত অবস্থায় পাওয়া যায় শাহবাগ থানার কনস্টেবল ছালাউদ্দীন আহমেদ খানকে। তার কাছে এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় গত ১৮ থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত নিহতদের ময়নাতদন্তের তথ্য পাওয়া যায়।
আন্দোলনে নিহত কতজনের ময়নাতদন্ত এখন পর্যন্ত হয়েছে- জানতে চাইলে এই পুলিশ সদস্য বলেন, “৯৯ জনের হয়েছে।”
তাদের মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সবই বুলেট ইনজুরি।”
শরীরের কোথায় বুলেটের আঘাত বেশি ছিল- এই প্রশ্নে কনস্টেবল ছালাউদ্দিন বলেন, “মাথায়, হাতে, কাঁধে, পিঠে, পেটে। মূলত শরীরের উপরের দিকেই ইনজুরি ছিল বেশি।”
রাজধানীতে নিহতদের বেশিরভাগ লাশই রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। এছাড়া শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গেও কিছু লাশ রয়েছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক শাফিউর রহমান রবিবার জানিয়েছিলেন, তাদের হাসপাতালে ১৩ জনের লাশ আনা হয়। কিন্তু তাদের ময়নাতদন্ত হয়নি।
“আমাদের কোনও সুযোগই ছিল না ময়নাতদন্ত করার। পরিবারের সদস্যদের কাছে সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
তবে তিনিও জানান, ওই হাসপাতালে আসা আহত ও নিহতদের মধ্যে গুলিবিদ্ধই ছিল বেশি।
এই আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় সারাদেশে মোট ১৫০ জন নিহত হওয়ার তথ্য সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। তবে আন্দোলনকারীদের দাবি, সংখ্যাটি অন্তত ২৬৬। তারা সময় ও ঘটনাস্থল ধরে এই হিসাব দিয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল থেকে শুরুতে সেখানে নিহতের সংখ্যাটি প্রকাশ করা হলেও পরে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সাংবাদিকদের দেখা দিচ্ছেন না। তার দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, সহকারী পরিচালক (অর্থ ও স্টোর) ডা. মো. আশরাফুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
রবিবার ডা. আশরাফুলের কাছে সাংবাদিকরা সেখানে নিহতের সংখ্যা এবং কতজন গুলিবিদ্ধ ছিল জানতে চাইলে তিনি এসংক্রান্ত কোনও তথ্য দিতে রাজি হননি।
তিনি শুধু জানান, গত ১৫ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত সহিংসতায় আহত ১ হাজার ৬৯ জন এই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়। তাদের মধ্যে ১৫৯ জন এখন ভর্তি আছে। তাদের মধ্যে নয়জন শিক্ষার্থী, বাকিরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার।
“যা বলেছি, এর চেয়ে বেশি আর কোনও তথ্য আমার দেওয়ার এখতিয়ার নেই। আমার কাছে আর কোনও তথ্য নেই.” বলেন তিনি।
তবে গত ২৪ জুলাই হাসপাতালের পরিচালক আসাদুজ্জামান সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছিলেন, সেদিন পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৭১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। মৃত অবস্থায় আনা হয় ৬০ জনকে, চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় ১৯ জন।
দেশের বৃহত্তম এই হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, হাসপাতালে যারা এসেছে, তাদের বেশিরভাগের দেহই ছিল গুলিবিদ্ধ।
‘গুলি চালানো ফৌজদারি অপরাধ’
জুলাই মাসের শুরুতে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণই ছিল। তবে ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীরা হামলার শিকার হওয়ার পরদিন সংঘাত বাড়ে। তাতে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে ছয়জন নিহত হয়।
তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিজিবি মোতায়েন করে সরকার। ২০ জুলাই কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েনের আগেই শতাধিক নিহত হয়।
সরকারের মন্ত্রীরা দাবি করে আসছে, শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত ঢুকে পরিকল্পিত সহিংসতা ঘটায়। তবে আন্দোলনকারীদের দাবি, পুলিশ ও সরকার সমর্থকরাই তাদের ওপর গুলিবর্ষণসহ হামলা চালায়।
আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ জানিয়ে সোমবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি প্রাঙ্গণে একদল আইনজীবী মানববন্ধন করে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তোবারক হোসেন সেই কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে বলেন, “ছাত্ররা যখন একটি দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিলো, তখন একজন মন্ত্রী একটি ছাত্র সংগঠনকে লেলিয়ে দিলেন। সেখান থেকে গণ্ডগোল ও অরাজকতার সূত্রপাত। এরপর নির্বিচার গুলি চালায় পুলিশ। এরপর নামানো হলো বিজিবি। পরে সেনাবাহিনী নামিয়ে দেশে কারফিউ জারি করা হলো।
“এসব অসাংবিধানিক, অন্যায় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সরকার এসব করে দেশের মানুষের সঙ্গে ফৌজদারি অপরাধ করেছ। এর বিচার হওয়া উচিৎ।”
মানববন্ধনে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সারা হোসেন, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, অনীক আর হকও বক্তব্য রাখেন।
শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি বর্ষণ বন্ধে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনও হয়েছে। সোমবার তার শুনানিতে রিট আবেদনকারী আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন বলেন, “আন্দোলনকারীদের ওপর অবাধে গুলি ছোড়া হচ্ছে। সরকারি বাহিনীগুলো ছিল সশস্ত্র। বিপরীতে আন্দোলনকারীরা ছিল নিরস্ত্র। গত কয়েক দিনের ভিডিও ফুটেজ আমরা দিতে পারব।”
ব্যারিস্টার অনীক আর হক শুনানিতে বলেন, “আমাদের আরজি হলো তাজা গুলি ছোড়া বন্ধ করা, তাতে প্রাণরক্ষা হবে। দেশের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, সেটাও আমরা চাই না। কিন্তু যারা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন, তাদের অধিকাংশেই বয়সে তরুণ। তারাও দেশের সম্পদ। অবশ্যই যাতে তাজা গুলি বন্ধ করা উচিৎ। আমরা আর একটিও প্রাণহানি চাই না।”
হতাহতের ঘটনায় গণতদন্ত কমিশন
গত ১৬ জুলাই ছয়জন নিহত হওয়ার পর সরকার হাইকোর্টের বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানকে প্রধান করে এক সদস্যের একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করে।
দুই শতাধিক নিহত হওয়ার পর নাগরিকদের পক্ষ থেকে সোমবার একটি গণতদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এই কমিশনের যুগ্ম সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আব্দুল মতিন এবং মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। কমিশনের যুগ্ম সচিব অধ্যাপক তানজিমউদ্দিন খান এবং গবেষক মাহা মির্জার পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই কমিশন গঠনের কথা জানানো হয়।
এই কমিশন গঠনের কারণ ব্যাখ্যা করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “পুলিশ যখন মামলা দায়ের করে, তখন সাধারণ ছাত্র এবং জনগণকে দায়ী করা হয়। এতে গোটা তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের মনে প্রশ্ন উঠেছে এবং এইসব ঘটনায় সত্য উদ্ঘাটনের দাবি উঠেছে।”
পাশাপাশি সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠার কথা জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “এসব ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন, সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আবশ্যকতা রয়েছে। তাই দেশের শিক্ষক, আইনজীবী, সংস্কৃতিকর্মী ও সাধারণ অভিভাবকদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কয়েকজন প্রথিতযশা ব্যক্তির সমন্বয়ে জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে।”
কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন- জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন, সাংবাদিক আশরাফ কায়সার, আইনজীবী অনীক আর হক।
এছাড়া এই গণতদন্ত কমিশনে উপদেষ্টা হিসাবে থাকবেন আইনজীবী তোবারক হোসেন, সারা হোসেন, শাহদীন মালিক, রাশনা ইমাম, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, কাজী মাহফুজুল হক সুপন, সাইমুম রেজা তালুকদার।