মূল্যস্ফীতি সমন্বয়ের কথা বলে আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহককে সরবরাহ করা পানির দাম আগামী ১ জুলাই থেকে ১০ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ঢাকা ওয়াসা।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা ওয়াসা বিদেশি ঋণে যেসব উচ্চাভিলাসী প্রকল্প নিয়েছে, সেগুলো থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ, বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়নি। এরই খেসারত দিতে হচ্ছে জনগণকে।
বুধবার (২৯ মে) এক বিজ্ঞপ্তিতে পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। সেখানে বলা হয়েছে, ঢাকা ওয়াসা আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম নির্ধারণ করেছে ১৬ টাকা ৭০ পয়সা, যা এখন আছে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য একই পরিমাণ পানির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৬ টাকা ২০ পয়সা, যা বর্তমানে আছে ৪২ টাকা।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, এ সিদ্ধান্ত মিটারবিহীন হোল্ডিং, গভীর নলকূপ, নির্মাণাধীন ভবন, ন্যূনতম বিলসহ সব প্রকার (পানি ও পয়ঃ) অভিকরের ক্ষেত্রেও কার্যকর হবে।
পানির দাম বাড়ানোর খবরে সোশাল মিডিয়ায় তুমুল সমালোচনা শুরু হয়েছে।
নগরবিদরা বলছেন, ঢাকা ওয়াসা নিজের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের দায় জনগণের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে পানির দাম বাড়িয়ে। ওয়াসা উচ্চ সুদে বিদেশি ঋণের টাকায় প্রকল্প করছে, সেই দায় চাপাচ্ছে গ্রাহকের ঘাড়ে।
তবে ঢাকা ওয়াসার দাবি, ২০২১ সালের পর পানির দাম আর বাড়ায়নি তারা। এবার ওয়াসা আইন ১৯৯৬-এর ২২ ধারা অনুযায়ী মূল্যস্ফীতির সমন্বয়ের লক্ষ্যে পানির দাম বাড়ানো হয়েছে।
এ নিয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৬ বছরে ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়ল ১৬ বার।
এবারের আগে কোভিড মহামারীর সময় ঢাকা ওয়াসা দুই বছরে দুই বার আবাসিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে পানির দাম বাড়িয়েছিল।
ঢাকা ওয়াসা ২০১৭ সাল থেকে টানা ৩ বছর ৫ শতাংশ করে পানির দাম বাড়িয়েছিল। আবাসিক গ্রাহকদের জন্য ২০২০ সালে পানির দাম ২৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। এরপর এক বছর বিরতি দিয়ে সবশেষ ২০২২ সালের জুলাইয়ে পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হয় ঢাকা ওয়াসার পানির দাম।
এবার যে যুক্তি দিয়ে ঢাকা ওয়াসা পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, তার সঙ্গে একমত নন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছে, ঢাকা ওয়াসায় ব্যবস্থাগত অপচয় (সিস্টেম লস) ২০ শতাংশ। এ অপচয় কমাতে পারলে ওয়াসাকে পানির দাম হয়তো বাড়াতে হতো না।
কোনও প্রতিষ্ঠানে ৫ শতাংশের বেশি সিস্টেম লস অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার প্রমাণ বলে মনে করছেন নগরবিদরা।
সামর্থ্য বুঝে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব ছিল
ঢাকার বাসিন্দাদের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী পানির দাম নির্ধারণ করতে চেয়েছিল ঢাকা ওয়াসা। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সংস্থাটির করা কারিগরি সমীক্ষায় বর্তমান দামের তুলনায় শ্রেণিভেদে ২৪ থেকে ১৪৭ শতাংশ পর্যন্ত পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল।
সংস্থাটি প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) পানির দাম নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জন্য ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা, মধ্যবিত্তদের জন্য ২৫ টাকা, উচ্চ-মধ্যবিত্তদের জন্য ৩১ টাকা ২৫ পয়সা করার প্রস্তাব করে। আর উচ্চবিত্তদের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৭ টাকা ৫০ পয়সা।
আর্থিক সামর্থ্যের শ্রেণি বিভাজনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০০০ বিবেচনা করেছিল ঢাকা ওয়াসা।
সেই বিবেচনা অনুযায়ী, যিনি ২ হাজার ৫০০ বর্গফুটের বেশি আয়তনের বাসায় থাকেন, তিনি উচ্চবিত্ত। ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ বর্গফুটের বাসায় যিনি থাকছেন, তিনি উচ্চমধ্যবিত্ত। ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ বর্গফুটের বাসায় বসবাসকারী মধ্যবিত্ত। ১ হাজার বর্গফুটের নিচে বসবাসকারী নিম্নমধ্যবিত্ত। আর বস্তির বাসিন্দা নিম্ন আয়ের মানুষ হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা।
প্রস্তাব থাকলেও এখনই এই পদ্ধতিতে দাম বাড়ায়নি ঢাকা ওয়াসা। এর কারণ জানতে ঢাকা ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক উত্তম কুমার রায়ের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আমরা যে পদ্ধতিতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সেটা একটা নতুন পদ্ধতি। মানুষকে বোঝানোর বিষয় আছে। তাই এবারই আমরা তা করেনি।
“কিন্তু ভবিষ্যতে এই পদ্ধতিতেই ঢাকা ওয়াসা হাঁটবে। যারা সমাজে অর্থবিত্ত, তাদের জন্য কেন সরকার ভর্তুকি দেবে? আমরা তাই এবারই না পারলে ধীরে ধীরে এই রাস্তায় হাঁটব।”
প্রকল্পগুলো থেকে নেই আশানুরূপ ফল
নগরবিদরা বলছেন, ঢাকা ওয়াসার প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে ধীরগতিতে। এ কারণে ব্যয় বাড়ছে। ঢাকা ওয়াসার অধিকাংশ প্রকল্প বিদেশি ঋণ নিয়ে করা হচ্ছে।
এসব ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে ঢাকা ওয়াসাকে ঋণের সুদ ও আসলের কিস্তি পরিশোধে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন প্রকল্পে ঢাকা ওয়াসার বিদেশি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা।
ঢাকা ওয়াসার প্রকল্প বাস্তবায়নের মাসিক অগ্রগতি প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বিদেশি ঋণের এ হিসাব পাওয়া যায়। ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন হওয়ায় সংস্থাটির ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
দেশে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা) আছে ৪টি, যার একটি ঢাকা ওয়াসা। এই ওয়াসার উৎপাদিত পানির ৭৫ শতাংশ গভীর নলকূপের। বাকি ২৫ শতাংশ পাওয়া যায় ভূউপরিস্থ উৎস থেকে শোধনের মাধ্যমে। শোধন করা পানির উৎপাদন খরচ তুলনামূলক বেশি। এ বিবেচনায় ঢাকার পানির দাম অন্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি।
ঢাকা ওয়াসার সাভারের তেঁতুলঝোড়া ভাকুর্তা ওয়েলফিল্ড প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ২৫ কোটি লিটার পানি পাওয়ার কথা ছিল। হিমালয়ের চ্যানেল দিয়ে ভাকুর্তায় প্রচুর পানি আসে– এমন ধারণায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবির) কাছ থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ২০১৮ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছিল ওয়াসা। তবে সেখান থেকে পানি পাওয়া যায় লক্ষ্যের অর্ধেকেরও কম।
চীন থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে একই সময়ে বাস্তবায়ন করা হয় পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্প। এ প্রকল্প থেকে বর্তমানে পানি পাওয়া যায় দৈনিক ৪৫ কোটি লিটারের পরিবর্তে ২০ কোটি লিটার।
ঢাকা ওয়াসার আরেকটি প্রকল্প চীন থেকে নেওয়া চার হাজার কোটি টাকা ঋণে দাশেরকান্দিতে বাস্তবায়ন করা হয় স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট। তবে পয়ঃবর্জ্য যাওয়ার কোনও নেটওয়ার্ক তৈরি না করায় এই প্রকল্প থেকেও কোনও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বরং এটির ব্যবস্থাপনা বাবদ বছরে ২০০ কোটি টাকা গুনতে হচ্ছে ঢাকা ওয়াসাকে।
এসব প্রকল্পে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে এরইমধ্যে।
২০২৩ সালের এক অডিট রিপোর্ট থেকে দেখা গেছে, দাশেরকান্দি প্রকল্পে প্রতিবছর ওয়াসাকে ঋণের কিস্তি দিতে হচ্ছে ৪৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। পদ্মা-যশলদিয়া প্রকল্পে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে ৫৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। ভাকুর্তা প্রকল্পে পরিশোধ করতে হচ্ছে ৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি নগরবিদ আদিল মুহাম্মদ খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ওয়াসা কিছু প্রকল্প নিয়েছে যেগুলো অনেকটা সাদা হাতি পালার মতো। খরচ হচ্ছে, কিন্তু লাভ হচ্ছে না। ঋণ করে টাকা নিয়ে প্রকল্পের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে। এমনিতেই দেশের অন্য ওয়াসার থেকে ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বেশি।
“মুন্সীগঞ্জের প্রজেক্টটা (পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার) থেকে ফলাফল আসছে না। বাকিগুলোও একই অবস্থায় আছে। শুধু উচ্চাভিলাসী পরিকল্পনা নিলেই হয় না। বাস্তবভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হয়। যদি তা নেওয়া হতো তাহলে গ্রাহকদের মাথায় এই চাপ পড়ত না। এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষ বিপদে আছে। এখন পানির দাম বাড়ানো মানুষের বিপদকে আরও বৃদ্ধি করবে।”
বোঝা গ্রাহকের কাঁধে
পানির দাম বাড়িয়ে গ্রাহকের কাঁধে আরও চাপ বাড়ানো হলো বলে মনে করছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। মানুষ খুব কষ্টে আছে। এখন পানির দাম বাড়ানো আরও চাপ বৃদ্ধি করবে।
“একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দাম বাড়াচ্ছে, এক কথা। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের দাম বাড়ানোটা উচিত না। সরকার জানে মানুষ কেমন আছে। এই অবস্থায় দাম না বাড়িয়ে অন্য কোনও পদ্ধতি সরকারের নেওয়া উচিত ছিল। ভুল নীতি ও দুর্নীতির কারণে এ অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধির পুরোটাই বহন করতে হচ্ছে ভোক্তাদের।”
এ বিষয়ে ক্যাবের পক্ষ থেকে ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে বলেও জানান গোলাম রহমান।