Beta
বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

কঠিন পরীক্ষা, মনে করিয়ে দেওয়া হলো বদিউল আলমকে

ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে শনিবার  ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কেমন চাই?’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেন বদিউল আলম মজুমদার ও এস সাখাওয়াত হোসেন।
ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে শনিবার ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কেমন চাই?’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেন বদিউল আলম মজুমদার ও এস সাখাওয়াত হোসেন।
[publishpress_authors_box]

রাজনৈতিক মতবিরোধ জিইয়ে থাকার মধ্যে নির্বাচন সংস্কারের কাজটি যে কতটা কঠিন, তা বদিউল আলম মজুমদারকে মনে করিয়ে দিলেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সোহরাব হোসেন।

শনিবার ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কেমন চাই?’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, রাজনৈতিক মতৈক্য না হলে পাঁচজন ফেরেশতা এনে বসিয়ে দিলেও নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পারবে না।

‘রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আরএফইডি)’ আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে নির্বাচন সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার ছিলেন।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এবং বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন ছাড়াও রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারে হাত দিয়ে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে।

তার মধ্যে নির্বাচনী সংস্কারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বদিউল আলম, যিনি দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে আসছেন সুজন সম্পাদতক হিসাবে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, “বদিউল আলমের সামনে কঠিন পরীক্ষা। নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশ্নে আমরা রাজনৈতিক ঐক্যমতে আসতে পারিনি।”

নির্বাচন বর্তমান ব্যবস্থায় হবে, না কি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে হবে, তা নিয়ে দলগুলোর একমত না হওয়ার বিষয়টিও তোলেন তিনি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর আওয়ামী লীগ সরকার আমলে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনগুলোর প্রসঙ্গ টেনে সোহরাব বলেন, “আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই জায়গায় যায়নি, যেখানে দলীয় সরকারের অধীনে তারা সুষ্ঠু ভোট করবে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখাই জরুরি৷ পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।”

নির্বাচনকালে প্রশাসনের নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ নিশ্চিতের কথাও বলেন তিনি।

বদিউল আলম মজুমদার তার বক্তব্যের শুরুতেই তার সাম্প্রতিক এক বক্তব্য নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় ট্রোলের শিকার হওয়ার কথা বলেন।

তিনি বলেন, “আমাকে বলেছিল যে আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে কি না? আমি যেটা উত্তর দিয়েছিলাম, খোলামেলা ওই অবস্থান থেকে কথা বলেছি যে এখন তো আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা পলায়নপর, তারা মাঠে নেই, তারা যদি সংগঠিত হতে না পারে, তারা যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, তাদেরকে যদি ন্যূনতম বাধা দেওয়া না হয়, তখন নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য হবে না।

“কিন্তু এটাকে করা হয়েছে যে আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে। ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন, না করিলে ৫০ টাকা জরিমানা। আমি এটার শিকার হয়েছি।”

নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে হলে ভোটার তালিকা থেকে শুরু করে ভোটগ্রহণ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া সঠিক ও জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার ওপর জোর দেন বদিউল আলম।

১৯৯১ এর নির্বাচনে রাজনৈতিক মতৈক্য সৃষ্টির বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “নির্বাচনে আচরণবিধি প্রণয়ন করে তারা এটা পালন করেছে। সবাইকে ভূমিকা পালন করতে হবে। সকলেরই এগিয়ে আসতে হবে।”

সংস্কারের ওপর জোর দিয়ে উপদেষ্টা সাখাওয়াত বলেন, “অনেক রক্ত ঝরেছে। ছাত্ররা যে রক্ত দিয়েছে রাষ্ট্রে, সেটি সংস্কার করার জন্য, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নয়। পরিবর্তন যদি আমরা করতে না পারি, তাহলে এই রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করা হবে।”

সংস্কারের কাজটি ‘চাট্টিখানি কথা নয়’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে এই উপদেষ্টা বলেন, “সংস্কারের যে আলাপ হচ্ছে, সেগুলো আমার বিশ্বাস, তারাও ধারণ করবেন। আমি প্রত্যেককে ওতপ্রোতভাবে এর সঙ্গে জড়িত থাকার আহ্বান জানাই।

“আসলে দেশ পরিচালনা রাজনীতিবিদরাই করবেন, আজকে হোক, কালকে হোক। কাজেই দায়-দায়িত্ব তাদের আজ থেকেই শুরু করতে হবে।”

যা বললেন দলগুলোর নেতারা

অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া দলগুলোর নেতাদের সবাই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার পক্ষে বলেছে। তবে ভোটের বর্তমান পদ্ধতি পরিবর্তন করে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে মতভেদ দেখা গেছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন বর্তমান সরকারকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, “বিশেষ পরিস্থিতির কারণে উচ্চ আদালতের রেফারেন্সে এই সরকার গঠিত হয়েছে। যার ফলে এটা একটা সাংবিধানিক সরকার।”

‘বাস্তবতার নিরিখে নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার দরকার তা করার ওপর জোর দেন তিনি। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির বিরোধিতা করে তিনি বলেন, এটা একেবারে যৌক্তিক নয়।

ঐকমত্য শব্দটি আপেক্ষিক মন্তব্য করে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, “বিএনপির ওপরে অনেক দায়িত্ব। সংস্কারের বিষয়ে বিএনপি কিন্তু অভিভাবকের পরিচয় দিয়েছে। নির্বাচিত হলেও পরে অন্যান্য দল নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে।”

বিএনপি নেতারা বিরোধিতা করলেও তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে বলেন। ‘না’ ভোটের বিধান যোগ করার প্রস্তাবও জানান তিনি।

গণপ্রতিনিধিত্ব আইন সংশোধনের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্ত সহজ করার দাবি জানান সাকি।

সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতার অভাব আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “দলগুলো যখন চায় আমি ম্যানিপুলেট করব, তাহলে তা করা যায়।”

তিন থেকে পাঁচটি নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে করার পক্ষে মত জানিয়ে তিনি বলেন, “যার ফলে হয়তো আমরা একটা জায়গায় পৌঁছাব, যেখানে দলীয় সরকারে অধীনে ভোট করা সম্ভব।”

সংস্কারের সময়সীমা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সুস্পষ্ট বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান জানান সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, সংবিধান ততটুকু সংস্কারের পক্ষে মত দেন তিনি।

সিপিবি সাধারণ সম্পাদকও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল,  না ভোট ফিরিয়ে আনা এবং সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাব দেন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, নির্বাচন কমিশন নিজেই একটা কমিশন, তার আবার সংস্কার কমিশন কেন?

“বদিউল আলমকে সরাসরি প্রধান নির্বাচন কমিশনার বানিয়ে দিলে পারত।”

তিনি বলেন, “সংস্কারের চেয়ে কুসংস্কারের দিকে দৃষ্টি রাখতে হয়। প্রার্থীরা পছন্দের ডিসি-এসপি নেওয়ার জন্য তদবির করে। কেন্দ্রভিত্তিক দখলদারিত্ব ও ডামি প্রার্থী দেওয়া, এগুলো ইলেকশন রিগিংয়ের ছোটো ছোটো পয়েন্ট।”

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে জামায়াতের পক্ষ থেকে নয়টি প্রস্তাব তুলে ধরার কথা অনুষ্ঠানে বলেন দলটির কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য শফিকুল ইসলাম মাসুদ।
তার মধ্যে রয়েছে- সংখ্যানুপাতিক ভোট, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল, নিবন্ধন প্রথা বাতিল, একাধিক দিনে নির্বাচন আয়োজন, ইভিএম বাতিল ইত্যাদি।

জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারীও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে বলেন।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ জাতীয় পার্টিকে এরকম অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর প্রতিবাদ জানান।

তিনি বলেন, “তারা ফ্যাসিবাদের দোসর। ১৪ দলের কাউকে পরিবর্তিত বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তির আলাপের নামে ডাকার সুযোগ নাই।”

নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রশাসনে নিরপেক্ষ লোক দরকার মন্তব্য করে প্রশাসনের ওপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুর।

তিনি বলেন, “ছাত্ররা যদি ডিসি-এসপি নিয়োগ দেয়, তাহলে তো ভয়ংকর ব্যাপার!”

সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান রচনার ওপর জোর দেন তিনি। সংখ্যানুপাতিক ভোটের পক্ষে তিনিও বলেন।

‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’র সদস্য আরিফুর রহমান আদিব এই আলোচনায় অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করে বলেন, “দলগুলো বিচারের চেয়ে পরবর্তী ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।”

তিনি আমূল সংস্কারে জোর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “বিদ্যমান সংবিধান বা এই ব্যবস্থায় ভোট হলে যেই ক্ষমতায় আসুক, তারা কিন্তু ফ্যাসিবাদী দানবে রূপান্তরিত হবে।

“তরুণরা কী চাচ্ছে, সেই জায়গা থেকে দলগুলোকে গভীরভাবে ভাবতে হবে এবং তরুণদের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত