Beta
বুধবার, ৮ মে, ২০২৪
Beta
বুধবার, ৮ মে, ২০২৪

একুশে ফেব্রুয়ারি এখন

জবরদস্তির কূটকচালে যেন পথ হারিয়ে না ফেলি

রওশন জামিল চৌধুরী। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ নাকি ‘শহীদ দিবস’? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালিত হবার কারণে কি শহীদ দিবসের মর্যাদা কমে যায়? ফিলহাল, এরকম একটা প্রশ্ন হাওয়ায় ভাসছে। বলা ভালো, ফেব্রুয়ারি এলেই তর্কটার পালে হাওয়া লাগে। খতিয়ে দেখা দরকার, এহেন কূটকচালে কান দেওয়া জরুরি, নাকি প্রশ্ন করা দরকার ভাষা আন্দোলন থেকে সত্যোপলব্ধির পথ বেয়ে যে দেশটার জন্ম হলো ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ এবং নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করল ১৬ই ডিসেম্বরে, সেই দেশ কি সব জায়গায় ভাষার—দেশের সকল ভাষার— সম্মান বজায় রাখতে পারছে? প্রশ্নটা, বোধকরি, এভাবে উপস্থাপন করলে দেখা যাবে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আর শহীদ দিবসের লাঠালাঠি নেই। বরং, আমাদের রক্তাক্ত ২১শে ফেব্রুয়ারির দিনটাকেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বের সবগুলো দেশ বেছে নেবার মধ্যে একটা গর্ব করার ব্যাপার আছে।

তবে এ আলোচনার আগে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের প্রেক্ষাপটটা আমলে নেওয়া দরকার। বাংলা ভাষা আন্দোলন বা স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের দাবি আচানক কোনও বিশেষ একটা দিনে গাছ থেকে টুপ্ করে পড়েনি। ভাষা আন্দোলনের শুরু ১৯৪৭-এ দেশভাগের অব্যবহিত পরে। আর বাঙালির জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র দাবির যৌক্তিকতা নিহিত ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে, যেখানে মুসলমানদের জন্য দুটো পৃথক পাকিস্তানের কথা মুসলিম লীগের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল। ১৯৪৬-এ দিল্লি প্রস্তাবনায় জিন্নাহর অনুরোধে বেঙ্গল মুসলিম লীগ প্রতিনিধি দলের নেতা সোহরাওয়ার্দী দুটো পৃথক রাষ্ট্রের জায়গায় একটা অখণ্ড রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা মেনে নিলে বাঙালির রাষ্ট্রগঠন ভাবনা প্রাথমিকভাবে হোঁচট খেয়েছিল। কিন্তু এরপর সেই সাতচল্লিশ সালেই ধর্মের ভিত্তিতে বাংলাভাগের বিরোধিতা করে বেঙ্গল মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম যুক্ত বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করেন যা বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও বেঙ্গল মুসলিম লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও এমনকি, মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, এবং বেঙ্গল কংগ্রেসের সভাপতি শরৎ বসু সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু মূলত ভারতীয় কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভার বিরোধিতার মুখে শেষপর্যন্ত এটা বাস্তবায়িত হতে পারেনি। তাই, একথা মানতে হবে, স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন ও অভিপ্রায় সুদূর ১৯৪০ থেকেই বাঙালির মধ্যে সুপ্ত ছিল।  

মূল আলোচনার আরও ভেতরে ঢুকবার আগে ভাষার রাজনীতি কীভাবে একটা জনগোষ্ঠীর উপর নানা মাত্রায় ক্রিয়া করে সেটা দেখাও জরুরি। সেই ফয়সালাটা হবার আগে ২১শে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্যটা বোঝা কঠিন হবে। শাঁসকে বাদ দিয়ে যখন কোনও দিবসকে ধর্ম বানিয়ে তুলে তাকে পুজোর অর্ঘ্য দেওয়া হয়, তখন পুরো ব্যাপারটাই হয়ে ওঠে অন্তঃসারশূন্য। ধর্মের চেয়ে ধর্মের জবরদস্তিটাই মুখ্য হয়ে পড়ে। ঘরে বাইরে উপন্যাসে এটা নানাভাবে বলে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

জাতপাতের দেশে ভাষা জনজীবনে একরকম সর্দারি ফলিয়ে থাকে। অস্ত্রটাকে অপেক্ষাকৃত মোক্ষমভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয় সমাজের উঁচুতলার মানুষেরা। একদা কী পশ্চিমে কী ভারতবর্ষে লাতিন ও সংস্কৃতের দৌরাত্ম্যে আমরা এটা লক্ষ করেছি। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ-ভারতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি; উপনিবেশ পত্তনকারীদের বুলি ইংরেজি ভাষাই হয়েছিল আর্থসামাজিক অগ্রগতিলাভের হাতিয়ার। শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগসুবিধায় অধিগম্যতার ক্ষেত্রে উপনিবেশবাদ প্রসারে দোসরের ভূমিকা পালন করেছিল ইংরেজি। 

ভাষার সম্মান রাখার অর্থ নিজের ভাষার মতো অন্য ভাষাগুলিকেও একই রকম সম্মান করা। পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করেছিল। আমরা যদি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে দেশে প্রচলিত অন্য ভাষাগুলিকে অবজ্ঞা করি, তাহলে একই দোষে দুষ্ট হবো। তাই, দেশে যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিগুলি (মতান্তরে আদিবাসী) আছে, তাদের ভাষা চর্চায় মনোযোগ দেওয়াটা কিন্তু একটি বিরাট কাজ।

বহুভাষিক সমাজে ভাষা যেমন অন্তর্ভুক্তির, তেমনি বর্জনের ভূমিকা পালন করে বৈকি। বিশেষ করে রুজির প্রশ্নে। চাকরির বাজারে ঢুকবার জন্য ইংরেজি প্রধান ভাষামাধ্যম হওয়ায়, স্বাভাবিকভাবেই, দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা অর্জন করার জন্য ভারতবর্ষীয় ভাষাগুলির মধ্যে শুরু হয়েছিল তীব্র রশি টানাটানি, বিশেষ করে হিন্দির সঙ্গে অপরাপর ভাষাগুলির। বলতে কি, এই কাজিয়ার প্রেক্ষাপটেই, ১৮৬৭ সালে, শাসক ইংরেজ উত্তর ভারত ও বিহারে আরবি-ফার্সি লিপিকে দরজা দেখিয়ে, দেবনাগরি লিপি ও হিন্দি ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দান করেছিল। ভাষাগত এই বর্জন নীতির ফলে, সঙ্গত কারণে, উর্দুভাষীরা প্রথম বঞ্চনার শিকার হয়। পরবর্তীকালে দক্ষিণ ভারতের ভাষাগুলিকেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখা যায় যখন ১৯৩৮ সালে মাদ্রাজ সরকার রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের জন্য হিন্দি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে। 

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ-ভারত ভাগ হবার পর পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী ঠিক এরকম এক দূরলক্ষ‍্য নিয়েই এগিয়েছিল যা ইউপিতে উর্দু এবং দক্ষিণে তামিল ভাষীদের ক্ষেত্রে করা হয়েছিল—অর্থাৎ, অন‍্যান‍্য ভাষাভাষীর উপর হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়া। পাকিস্তানে এটা করা হয়েছিল উর্দুভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে নয়া রাষ্ট্রে রুজি ও অন‍্যান‍্য সুবিধা থেকে অপরাপর ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে বঞ্চিত করার পাঁয়তারা করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উত্থানশীল এলিট ব্যাপারটাকে যে সুনজরে দেখবে না এটা তো জানা কথা।

এ সময়টায়ই নবজাগ্রত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাকিস্তানিদের মতলব সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। পেশাজীবী ও রাজনীতিকদের মৈত্রী দেখে জিন্নাহ সাহেব কঠোর অবস্থান থেকে খানিকটা পিছু হটলেও, আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন আন্দোলনের পরিণামফল সম্পর্কে পূর্ব-পাকিস্তানীদের হুঁশিয়ারি জানাতে কসুর করেননি। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ফলাফল থেকে একটা ব‍িষয় পরিষ্কার হয়ে যায় যে, প্রশাসনিক আধিপত্য বজায় রাখতে পাকিস্তানের বেসামরিক তরিকায় কার্যসিদ্ধি হচ্ছে না। মূলত এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীীর সেনাশাসন জারি অবশ্যাম্ভাবী হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় প্রমাণ করে সামারিক দমন-পীড়ন শেষপর্যন্ত পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারেনি। 

বিষয়টাকে আরেকটু খোলাসা করবার জন্য অতীতের সঙ্গে আরেকটু বোঝাপড়ার জরুরত আছে। মনে রাখা দরকার, পাকিস্তানের ৫৪ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বললেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হয় উর্দুকে। ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে বাংলাকে উর্দুর সঙ্গে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করবার প্রস্তাব রাখেন। খাজা নাজিমুদ্দিন, সম্ভবত জিন্নাহকে তুষ্ট করতেই, তার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, পূর্ববাংলার অধিকাংশ মানুষ উর্দুর পক্ষে।

গণপরিষদে উর্দুর সঙ্গে ইংরেজি অথবা বাংলা—এই সহজ বিষয়টা মেনে নিতে পারেননি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, যদিও এর একটা স্বাভাবিক সমাধান হওয়া সম্ভব ছিল আলোচনার মাধ্যমে। দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের ২২শে জুন থেকেই কেন বাংলাই হওয়া উচিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, তা নিয়ে পত্রিকায় লিখছেন আবদুল হক। সে আলোচনায় যোগ দিচ্ছেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মাহবুব জামাল জাহেদী প্রমুখেরা। কার্যত, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে একধরনের একগুঁয়েমি, বাংলার মানুষকে অবজ্ঞা করা, নিজেদের আশরাফ ধরে নিয়ে বাঙালিকে আতরাফ ভাববার সেটাই ছিল শুরু যার প্রমাণ পরবর্তীকালে মিলবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়টায়। পাকিস্তানি জেনারেলদের জীবনী পড়লেও বোঝা যায়, বাঙালির ব্যাপারে কতটা ভুল ধারণা নিয়ে তারা তাদের মস্তিষ্কের কোষগুলি ভরাট করেছিলেন। 

যাই হোক, যদি ১৯৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলি না চলত, তাহলে কি ভাষা-চেতনা মুখ থুবড়ে পড়ত? নাকি আরও বাড়তি উদ্যমে তা এগিয়ে যেত প্রাণবান উচ্ছ্বাসের সঙ্গী হয়ে? আজ আর সে বিষয়ে ভেবে কুল-কিনারা করা যাবে না। কিন্তু যা অর্জিত হলো, সেটা আমরা কীভাবে আত্মস্থ করলাম, অথবা সত্যিই আত্মস্থ করতে পারলাম কি-না, সে প্রশ্নটার সমাধান হয়নি—স্বাধীন হবার ৫২ বছর পরও।

এটা হয়ত অনেকেই জানেন যে, ফ্রেঞ্চ একাডেমির আদর্শে পরিকল্পিত হয়েছিল বাংলা একাডেমির কর্মকাঠামো। এখানে গবেষণা হবে, অনুবাদ হবে; সংকলন, প্রকাশনা থাকবে; থাকবে গ্রন্থাগার। তাতে ভাষার উৎকর্ষ প্রকাশিত হবে। বাংলা একাডেমির গৃহীত কর্মসূচির মধ্যে একটা ছিল শ্রেষ্ঠ বাংলা গ্রন্থ বিভিন্ন ভাষায় তর্জমা। এই কাজটা কতটা হচ্ছে, সেটা কি কিছুমাত্র জানা আছে কারও? আমাদের শ্রেষ্ঠ লেখকদের কাজগুলি যদি অনুবাদ করতে হয়, তাহলে তো সেই মাপের মানুষ লাগবে, যারা সেই লেখা আত্মস্থ করতে এবং তা অন্য একটা ভাষায় যথাযথভবে অনুবাদ করতে পারবেন। এ ব্যাপারে সাফল্য খুব একটা রয়েছে বলে জানা যায় না। 

বিভিন্ন ভাষার প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থের অনুবাদ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা খুব যত্নের সঙ্গে হচ্ছে বলে মনে হয় না। ইউরোপীয় ইতিহাসের ওপর রচিত একটা দুখণ্ডের বই কিছুদিন আগে হাতে এসেছিল। নেড়েচেড়ে দেখে বোঝা গেল, অনুবাদ যে একটা নান্দনিক ব্যাপার, তা নিয়ে অনুবাদকের কোনও ধারণা নেই। অন্য ভাষার শব্দগুলিকে যান্ত্রিকভাবে অনুবাদ করলে তা পড়বে কেন পাঠক?

উচ্চশিক্ষায় বাংলা নেই—এ রকম একটা আক্ষেপ শোনা যায়। কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। উচ্চমাধ্যমিক পার হওয়ার পর যে পড়াশুনো হয়, তা বাংলায় আর হয় না। অবশ্যি, অল্প কয়েকটা বিষয় আছে যেখানে বাংলার পাত পড়ে। বাকি সব ইংরেজির দখলে।

এখানে একটা বিষয়ের উল্লেখ করা দরকার। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে আমাদের দেশে ইংরেজি থাকতেই পারে। উচ্চস্তরের জ্ঞানলাভের জন্য ইংরেজির দরজায় ধরনা দেওয়া খারাপ কিছু নয়। দেশের বাইরের সভা-সেমিনারে অংশ নিতে হলে সেই ভাষার জ্ঞান থাকাটা জরুরিও বটে। কিন্তু মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে যখন বিদেশি ভাষার প্রতি অনুরাগ জন্মায়, তখন বোঝা যায়, ভাষার প্রতি এই মমত্বহীনতা সামগ্রিকভাবে পারস্পরিক সাংস্কৃতিক বন্ধনকে শিথিল করে দিয়েছে। কর্পোরেট যুগে এই বিপদটা বেড়েছে ঢের। খেয়াল করলে দেখা যাবে, বড় বড় কর্পোরেট হাউসের দাফতরিক ভাষা ইংরেজি। নিদেনপক্ষে পাঁচ শব্দের বাংলা বাক্যে অন্তত তিনটা ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে না দিলে জাতে ওঠা যায় না। এ ব্যাপারে প্রয়াত অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম একবার এক পত্রিকায় যে কথা লিখেছিলেন, তা মনে করা যায়।

তিনি মূলত বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার কথা বলেছিলেন। বাংলায় যে বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ লেখা কঠিন কিছু নয়, সেকথা তিনি বলেছেন। বলেছেন, অনেকেই এখন আমাদের দেশে বিজ্ঞানের বই লিখছেন। কিন্তু বিজ্ঞান তো অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমও। তাই বিজ্ঞানের প্রধান রচনাগুলি ইংরেজিতে লিখছেন তারা। একই সঙ্গে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতে লেখা হলে, বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার গুরুত্ব বাড়ত। তখন মাতৃভাষায় বিজ্ঞা­­নচর্চা বাড়তে পারত। আমাদের মাতৃভাষায় উচ্চতর বিজ্ঞানচর্চা করা খুবই সম্ভব। প্রশ্ন হলো, যারা দেখতে পাচ্ছেন, ইংরেজিতে শিক্ষালাভ এবং তার প্রয়োগ করলে সমাজে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা যায়, তারা কেন অযথা মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করবেন? শুধু দেশপ্রেমের বুলি কপচে সেটা হবে না। আর্থসমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে সমস্যা নিরসনের গাঁটছড়া বাঁধা না হলে, বাইরের খোলসটাই বদলাবে কেবল, ভেতরে মজুত থাকবে ফিটফাট ইংরেজিই।

আরও একটা প্রসঙ্গ এখানে আনা দরকার। সব শব্দের বাংলাকরণের প্রয়োজনটা কী? যারা কিঞ্চিত ভাষাচর্চা করেন, তারা বিলক্ষণ জানেন, অন্য ভাষা থেকে নতুন নতুন শব্দ এসে নিজ ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। সেই শব্দগুলিকে বিদেশি শব্দ বলা হলে ভুল বলা হবে। বিদেশি ভাষা থেকে এসে তা দেশি শব্দ হয়ে গেছে। তার মূল বা ভিত্তি হয়ত অন্য কোনও ভাষাবলয়ে, কিন্তু এখন তা নিতান্তই আমার। সেটা আর বিদেশি শব্দ নয়।

এই যেমন, টেলিভিশন, কম্পিউটার, বাজেট ইত্যাদি শব্দকে কি এখন আর বিদেশি শব্দ বলব? চেয়ারকে কেদারা বলা হলে বাংলা ভাষাই লজ্জা পাবে। মোবাইল ফোনকেও কেউ আসলে মুঠোফোন বলে না। খেয়াল করে দেখুন, খুব সুন্দর একটা অনুবাদ হয়েছে বটে, কিন্তু আপনি কি বলবেন কখনও, ‘তোর মুঠোফোনটা দে তো, একটা ফোন করব!’ খেয়াল করে দেখুন, আপনি বলছেন না, বরং উল্টোটা ঘটছে: আপনি ‘মোবাইল’ শব্দটা ব্যবহার করছেন। ওটা এখন বাংলা শব্দ। এমনকি শুধু ‘মোবাইল’ শব্দটা  দিয়ে ‘মোবাইল’ ও ‘ফোন’ শব্দ দুটিকে এক করে ওই ‘ফোনসেট’টাকেই বোঝায়।

বিদেশি ভাষার বিজ্ঞানের বইগুলোর তরজমাও তো দরকার। কিন্তু কে করবে সেই অনুবাদ? এই কাজ কিন্তু যে কোনও সাধারণ অনুবাদক করতে পারবেন না। ভালো ইংরেজি বা অন্য কোনও ভাষার বিজ্ঞান বই অনুবাদ করতে পারেন তিনিই, যিনি বিজ্ঞান বোঝেন, যিনি নিজের ভাষায় বিজ্ঞান বোঝাতে পারেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় বিজ্ঞানীদেরকেই এই কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে।

উচ্চ আদালতে কিছু কিছু রায় বাংলায় দেওয়া হচ্ছে, এটা অত্যন্ত আনন্দের খবর। উচ্চ আদালতের বেশ কয়েকজন বিচারপতি ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় আদেশ দিচ্ছেন, রায় দিচ্ছেন। দু-একটি উদাহরণ এখানে দেওয়াই যায়।

রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে যে রায় দেওয়া হয় ২০১৩ সালে, সে রায় বাংলায় লিখেছিলেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। পিলখানায় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তরে হত্যাকাণ্ডের মামলার রায় লিখেছিলেন হাইকোর্টের তিন বিচারপতি। পূর্ণাঙ্গ রায়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ হাজার। এর মধ্যে বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী বাংলায় রায় লিখেছিলেন, যার পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১৬ হাজার।

বাংলায় রায় লিখতে হলে যদি কিছু কিছু শব্দ ইংরেজিতে লিখতে হয়, তাহলেও ক্ষতি নেই। কোনও কোনও শব্দ ইংরেজি থেকে এলেও তা তো এখন বাংলাই হয়ে গেছে। তাই উচ্চ আদালতে সাহস করে বাংলায় রায় লেখা খুব পরিশ্রমের কাজ নয়।

এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখতেই হবে: মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার যে সাম্য, ন্যায় ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, তাকে এড়িয়ে নিছক ‘সহি’ দিবস সন্ধানের গলিঘুপচিতে ঘুরে মরলে, রবীন্দ্রনাথ কথিত ধর্মের চেয়ে ধর্মের জবরদস্তির উৎপাতই বাড়বে কেবল।

যাহোক। আলোচনাটা ছিল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ও ‘শহীদ দিবস’-এর মধ্যে বিবাদ নিয়ে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, মূল জায়গাটা হচ্ছে ভাষার প্রতি মমত্বটা রয়েছে কি-না, সেটাই ভাববার জায়গা। আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত যদি বাংলাকে সম্মান করি, তাহলে তা আমাদের চলার পথকেই মসৃণ করবে। দেশের শিক্ষাবঞ্চিত মানুষ কিন্তু এই এক বাংলা ভাষাই জানে। সুতরাং দেশের মাটির কাছাকাছি থাকতে হলে এই ভাষার চর্চাটাই জরুরি।

আর সে কথা মনে রেখে আরও একটা কথা না বললে পুরো লেখাটা তার অর্থ হারাবে। ভাষার সম্মান রাখার অর্থ নিজের ভাষার মতো অন্য ভাষাগুলিকেও একই রকম সম্মান করা। পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করেছিল। আমরা যদি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে দেশে প্রচলিত অন্য ভাষাগুলিকে অবজ্ঞা করি, তাহলে একই দোষে দুষ্ট হবো। তাই, দেশে যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিগুলি (মতান্তরে আদিবাসী) আছে, তাদের ভাষা চর্চায় মনোযোগ দেওয়াটা কিন্তু একটি বিরাট কাজ। একইসঙ্গে শহীদ দিবস নাকি মাতৃভাষা দিবস এই অহেতুক তর্কের ঊর্ধ্বে উঠে, একটা খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে নিশ্বাস নেবার প্রশস্ত উপায় হলো দেশের ভাষা-বিবাদকে ভাগাড়ে পাাঠানো।  

সবশেষে, তবে গুরুত্বের বিচারে কখনোই হাল্কা নয়, ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন কতটা আমজনতার দাবি ছিল সে নিয়ে একটা খচখচানি থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যে দেশের সিংহভাগ মানুষের রুজির প্রধান অবলম্বন কৃষিকাজ, সেখানে ভাষা কোনও বাধা হয়ে না ওঠাই স্বাভাবিক। তারা বরং নিজেদের হিসাব অনুযায়ী গণআন্দোলনে শরিক হয়েছে এবং, যখন সময় হয়েছে, ১৯৭১ সালে যুদ্ধে অংশ নিয়ে নিজেদের অপরিহার্য ভূমিকাদি পালন করেছে। ভাষা আন্দোলন মূলত ক্ষুব্ধ ও উচ্চাভিলাষী মধ্যবিত্তের আত্মোপলব্ধির ফসল, যা তাদের ১৯৫৪, ১৯৬৯-এর প্রতিরোধ এবং, পরিশেষে, স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য একাট্টা হবার প্রেরণাবীজ হিসেবে কাজ করেছে। ছোট-বড় যে কোনও আন্দোলনেই বহুপক্ষীয় স্বার্থ বিজড়িত থাকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও এর ব্যতিক্রম নয়। এটা না বুঝবার কথা নয় যে, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল শ্রেণির স্বার্থ এক ছিল না। শ্রেণিগত পার্থক্যের কারণেই তা থাকা সম্ভব নয়। জাতীয় মুক্তি হাসিলের বৃহত্তর লক্ষ্যসাধনের উদ্দেশ্যে, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বহুপক্ষীয় স্বার্থকে একসুতোয় গাঁথবার ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করেছিল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধ। যা ‘৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে অবসিত হয়েছে শ্রেণিস্বার্থের অনিবার্য তাগিদে। বাংলাদেশের মানুষ আর কখনো সেই অভূতপূর্ব ঐক্য গড়ে তুলতে পারবে কি-না বলা কঠিন। তবে এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখতেই হবে: মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার যে সাম্য, ন্যায় ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, তাকে এড়িয়ে নিছক ‘সহি’ দিবস সন্ধানের গলিঘুপচিতে ঘুরে মরলে, রবীন্দ্রনাথ কথিত ধর্মের চেয়ে ধর্মের জবরদস্তির উৎপাতই বাড়বে কেবল।

লেখক: সাংবাদিক, লেখক ও অনুবাদক।
ইমেইল: chowdhury.raoshanj@gmail.com

আরও পড়ুন