ফেইসবুকে নিজের প্রোফাইল পিকচার আবার লাল করে কী বার্তা দিতে চাইছেন হাসনাত আব্দুল্লাহ? সরগরম আলোচনা এখন তা নিয়ে। শুধু লালই করেননি, তিনি ক্যাপশনে লিখেছেন- “সাঈদ ওয়াসিম মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ।” তা সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন ‘১৩৪ শে জুলাই, ২০২৪’।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লার পাশাপাশি আরও কয়েকজনও প্রোফাইল পিকচার লাল করে ‘যুদ্ধ শেষ হয়নি’ বার্তা দিয়েছেন।
সাড়ে ৩ মাস আগে তাদের সবারই প্রোফাইল পিকচার লাল হয়েছিল; তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। আন্দোলনের ওপর চলছে দমন-পীড়ন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। প্রোফাইল পিকচার লাল হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের, পালিয়ে বাঁচেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জুলাই মাসে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা ৫ আগস্ট গিয়ে সফল হলেও আন্দোলনকারীদের দৃষ্টিতে তা ‘৩৬ জুলাই’।
রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের সিঁড়ি বেয়ে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার; আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়কদের পছন্দে প্রধান উপদেষ্টা হন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকেও দুজন উপদেষ্টা হন।
বিদেশ থেকে এসে সরকারের দায়িত্ব নিয়ে ড. ইউনূস বলেছিলেন, ছাত্ররাই তাদের প্রাথমিক ‘নিয়োগকর্তা’। তাদের মেয়াদও ছাত্ররাই ঠিক করবে।
৮ আগস্ট শপথ নেওয়ার পর এক দফায় সরকারের পরিসর বাড়িয়েছিলেন ড. ইউনূস; দক্ষতা বাড়াতে দুই দিন আগেই দ্বিতীয় দফায় কলেবর বাড়ান তিনি। উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত করেন আরও দুজনকে।
আর তাতেই বেঁধেছে গোল; ‘নিয়োগকর্তারা’ই এখন এই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনায় মুখর।
সরকারের উদ্দেশে হুমকির সুরে হাসনাত ফেইসবুকে লিখেছেন, “আপনেরা হাসিনা হয়ে উঠার চেষ্টা কইরেন না। হাসিনারেই থোরাই কেয়ার করছি, উৎখাত করছি। আপনেরা কোন হনু হইছেন?”
সমন্বয়কদের মুখে সরাসরি এমন সমালোচনা এর আগে কখনও দেখা যায়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাজে সমন্বয়হীনতা, অদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল; তাই উপদেষ্টা পরিষদের কলেবর বাড়ানোর পরামর্শ ছিল।
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, কাজের গতি এবং দক্ষতা বাড়াতেই নতুন তিনজন উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একই রকম বক্তব্য ছিল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমেরও।
কিন্তু অনেকে প্রশ্ন তুলেছে, শক্তি বাড়াতে গিয়ে কি উল্টো শক্তি কমিয়ে ফেলল ইউনূসের সরকার?
কী নিয়ে বাঁধল গোল
উপদেষ্টা হিসাবে রবিবার মাহফুজ আলম, সেখ বশির উদ্দিন ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকী শপথ নেওয়ার দিনই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া উঠেছিল।
মূলত ব্যবসায়ী সেখ বশির ও চলচ্চিত্রকার ফারুকীকে নিয়েই আপত্তি উঠেছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের চোখে সেখ বশিরের ভাই সেখ আফিল উদ্দিন ছিলেন ‘ফ্যাসিস্ট’ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। আর ফারুকীও ছিলেন ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর’।
এই দুই উপদেষ্টার পদ থেকে অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সেই মিছিলে পুলিশ চড়াও হওয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে হাসনাত লিখেছেন, “বশির-ফারুকীকে উপদেষ্টা করার প্রতিবাদ সভা থেকে গ্রেফতার করার ঘটনা চরম ফাইজলামি। এগুলা ভণ্ডামি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই প্রতিবাদ সমাবেশে হাসনাতের পাশাপাশি বক্তব্য রাখেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ। তিনি ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’দের উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম ফেইসবুকে লিখেছেন, “শুধু ১টা বিভাগ থেকে ১৩জন উপদেষ্টা! অথচ উত্তরবঙ্গের রংপুর, রাজশাহী বিভাগের ১৬টা জেলা থেকে কোনো উপদেষ্টা নাই! তার উপর খুনী হাসিনার তেলবাজরাও উপদেষ্টা হচ্ছে!”
নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে ‘অবিশ্বাস্য’ অভিহিত করে ফারুকী ফেইসবুকে লিখেছেন, “আমি নাকি ফ্যাসিস্টের দোসর! যেই ফ্যাসিস্টকে তাড়ানোর জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাশে দাঁড়ালাম ১৬ জুলাই থেকে, অল আউট অ্যাটাকে গেলাম এটা জেনে যে ফ্যাসিস্ট হাসিনা টিকে গেলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যু অথবা জেল, আমি তারই সহযোগী?”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতের এক ঘটনায় আকিজ-বশির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেখ বশির উদ্দিনও আসামি বলে খবর ছড়িয়েছে; যদিও নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছেন তিনি।
সমস্যার নেপথ্যে কী
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া উপদেষ্টা হয়েছেন। সর্বশেষ উপদেষ্টা হয়েছেন আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির দায়িত্বে থাকা মাহফুজ।
নতুন উপদেষ্টাদের নিয়ে সহযোদ্ধাদের ক্ষোভের বিষয়ে তাদের কোনও প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।
তবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বর্তমান দূরত্বের জন্য সরকারকেই দুষলেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সরকার শুধু ছাত্রদের মুখোমুখি অবস্থানে নিয়ে গেছে, তা না। সরকার আন্দোলনের সকল পক্ষেরই মুখোমুখি অবস্থান নিচ্ছে। একটা সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু কারও সাথে কথা হয় না। শপথ হওয়ার পর আমাদের জানতে হয়, কে হচ্ছেন উপদেষ্টা। এটা খুবই হতাশাজনক।”
আন্দোলন সফল হওয়ার পর সম্প্রতি সমন্বয়কদের মধ্য থেকে হাসনাত আব্দুল্লাহকে আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখনই উমামাকে করা হয় মুখপাত্র। সারজিসকে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কোনও কাজে স্বচ্ছতা পাওয়া যাচ্ছে না অভিযোগ করে উমামা বলেন, “তারা কোনও কাজ করলে কেন করছেন, তারও সঠিক জবাবদিহি করতে আমরা দেখি নাই। এটা ঐক্যে ফাটল ধরাচ্ছে।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই পরিস্থিতিতে কী করবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা আমাদের লড়াই চালিয়ে যাব। আমরা আমাদের বক্তব্য যা দেওয়ার, তাই দিব। গণ অভ্যুত্থানের স্পিরিট ধরে রাখার জন্য আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব।”
হতাশা ছড়াচ্ছে
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিজয়কে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলছেন আন্দোলনকারীরা। তবে তখনই আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ সতর্ক করেছিলেন, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে তা রক্ষা করা কঠিন।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের দূরত্বে হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জুলাই আন্দোলনে থাকা অনেকে।
রাষ্ট্রের সংস্কার, পুনর্গঠন ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষ্যে গঠিত ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’র আহ্বায়ক নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী এজন্য সরকারকেই দোষ দিচ্ছেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সরকারের আন্দোলনের সকল পক্ষের সাথে কথা বলেই সিরিয়াস সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ। এভাবে নিলে তো ভুল হবেই। এভাবে কাজ করলে সরকারের ওপর থেকে আন্দোলনকারীদের ভরসা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মতভেদের মধ্যে এখন আবার সমন্বয়কদের সঙ্গে সরকারের দ্বন্দ্বের পরিস্থিতিকে ‘খুবই দুর্ভাগ্যজনক, দুঃখজনক এবং উদ্বেগজনক’ বলছেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত কাইয়ূম, যিনি শেখ হাসিনার শাসনের সমালোচনায় সরব ছিলেন এবং আন্দোলনেও ছিলেন সক্রিয়।
হাসনাত কাইয়ুম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এ ধরনের সমন্বয়হীনতা, আমরা যারা এই সরকারকে সমর্থন দিয়েছি, তাদের জন্য এটা খুবই হতাশাজনক।”
তিনিও সরকারকে দায়ী করে বলেন, “তারা যখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখন আগে তো নিজেদের ভিতরে ঐকমত্য করে নিতে হবে। নিজেদের ভিতরে ঐক্য না হলে সেটা কেন ঘোষণা করা হবে? এটা তো ঠিক না।
“দেখা যাচ্ছে, শপথ হয়ে যাচ্ছে, তারপর সবাই জানছে। ইউনূস সাহেব বলেছিলেন, ছাত্ররা তার নিয়োগকর্তা। তাহলে তো ছাত্রদের সাথে আলোচনা করা তার জরুরি।”
আন্দোলনের বাকি অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে হাসনাত কাইয়ুম বলেন, “ছাত্ররা এবং সরকার যে আলাপ করছে, তা কিন্তু স্টেকহোল্ডারদের আলাপ না। সেটা কিন্তু সরকারেরই আলাপ। বাকি স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলাপ তো পরে।
“এখন তো দেখা যাচ্ছে সরকারের ভেতরেই কোনও আলাপ হচ্ছে না। বাকিদের সাথে তো আলাপ অনেক পরে।”