রাত দেড়টা। মিষ্টির দোকান থেকে ভেসে আসছে নির্বাচনী গান। কাছে গিয়ে দেখা গেল, সাউন্ড বক্সে বাজছে সেই গান। দোকানের ক্যাশ কাউন্টারের টেবিলে একটা স্ট্যান্ডে মোবাইল ফোন। তার সঙ্গে ব্লু টুথ দিয়ে কানেক্ট করা সেই সাউন্ড বক্স।
সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার ফুলতলা মোড়ে গত ২৮ ডিসেম্বর এমন ঘটনা দেখা যায়। সেই রাতে দোকানি আব্দুস সবুর লাল্টুর সঙ্গে কথা হয়।
৫৫ বছর বয়সী লাল্টু জানান, ছয় বছর ধরে অ্যান্ড্রয়েড ফোন চালান। ফেইসবুক ও টিকটকে অ্যাকাউন্ট আছে তার। সময় পেলে প্রতিদিনই ভোটের খবরাখবর রাখছেন। ভোট নিয়ে আসলে কী হচ্ছে, কী হতে পারে- জানার চেষ্টা করছেন।
মোবাইল ফোনে প্রচার-প্রচারণা দেখতে কেমন লাগছে- জানতে চাইলে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “ভালো লাগতেছে। যখন যেটা মন চায় সেটা দেখি। খবর দেখি। তারপর টিকটিক দেখি। ফেইসবুক দেখি।”
এসব ডিজিটাল প্রচার-প্রচারণায় প্রার্থীদের সুবিধা হলো কি না- জানতে চাইলে অট্টহাসি দিয়ে এই মিষ্টির দোকানি বলেন, “আমি ওসব বুঝি না বাবা।”
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত ১৮ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু করেছেন প্রার্থীরা। এই প্রচার চলবে আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ শুরুর ৪৮ ঘণ্টা আগে পর্যন্ত।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেখা গেছে, ভোট শুরুর ৪৮ ঘণ্টা আগে আনুষ্ঠানিকভাবে সশরীরে প্রচার অনেকটা বন্ধ হয়ে গেলেও চলতে থাকে ডিজিটাল প্রচার-প্রচারণা।
শুক্রবার সকালেও ভোট চেয়ে এসএমএস পেয়েছেন অনেকে, দুপুর গড়ানোর পরও ফেইসবুকে বিভিন্ন প্রার্থীর প্রচারের ভিডিও তোলায় কমতি ছিল না, নানা ওয়েবসাইটেও দেখা যাচ্ছিল প্রচারের বিজ্ঞাপন। অথচ শুক্রবার সকালের পর প্রচার চালানো নিষিদ্ধ।
এমন প্রচার নিয়ে নির্বাচন কমিশনকেও দেখা যাচ্ছে নীরব ভূমিকায়।
নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিজিটাল প্রচার একেবারে বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তারা বলছেন, আইনে এ বিষয়ে উল্লেখ নেই। তারাও মনে করেন, এ আইনে পরিবর্তন প্রয়োজন।
২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারের সময় রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণ বিধিমালার আইন হলেও সেগুলো আর যুগোপযোগী করা হয়নি। সে সময় নবম সংসদ নির্বাচনে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে তেমন প্রচার দেখা যায়নি।
২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচার কিছুটা বাড়ে। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে এর প্রসার বাড়লেও কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন কমিশন নীরব ছিল। এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও একই ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে।
আইনে কী আছে
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)১৯৭২ এর ৭৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ভোট শুরুর আগের ও পরের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচনী এলাকায় কোনো জনসভা আহ্বান, অনুষ্ঠান, মিছিল বা শোভাযাত্রা সংগঠিত করতে পারবেন না। কেউ লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ সাত বছর ও সর্বনিম্ন ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
এছাড়া কোনো ব্যক্তি ভোটের দিন কেন্দ্রের চারশ’ গজের মধ্যে ভোটের জন্য প্রচারণা ও ভোট প্রার্থনা করলে সর্বোচ্চ তিন বছর, সর্বনিম্ন ছয় মাসের কারাদণ্ডে এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।
রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধিমালা-২০০৮ এর ৫ অনুচ্ছেদে নির্বাচনী প্রচারণার বিষয়ে বলা আছে। এতে রাজনৈতিক দল বা মনোনীত প্রার্থী, স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে ৬ থেকে ১৪ বিধি অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
সেখানে যেসব বিধি-নিষেধের কথা বলা হয়েছে সেগুলো মূলত সভা-সমিতি সংক্রান্ত। পোস্টার, হ্যান্ডবিল, যানবাহন, দেয়াল লিখন, গেইট বা তোরণ নির্মাণ, ক্যাম্প স্থাপন, আলোকসজ্জা, মাইক ব্যবহার, প্রচারণার সময় ও সরকারি সুবিধাভোগী ব্যক্তির প্রচার-প্রচারণা নিয়ে সীমাবদ্ধতার বিষয়ও এসব বিধিতে পরিষ্কার করা আছে।
তবে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে ডিজিটাল প্রচার বা টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেওয়ার বিষয়ে কোনো বিধি-নিষেধ দেওয়া নাই।
সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার ফুলতলা মোড়ের দোকানি লাল্টু ডিজিটাল প্রচার দেখছেন মোবাইল ফোনে।
একমত নন বিশেষজ্ঞরা
ডিজিটাল প্রচার পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ।
আরপিওর প্রসঙ্গ টেনে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এতে জনসভা বন্ধের কথা বলা আছে, ডিজিটাল প্রচারণার কথাই নেই। এটা তো চাইলে ঘরে বসে করতে পারবে। এটা আইনের মধ্যে পড়বে না। যদি দেশের বাইরে, বিদেশের মাটিতে বসে পরিচালনা করে, কন্ট্রোলও করতে পারবে না।”
নিয়ম বদলে ডিজিটাল প্রচারের বিষয় যোগ করা যায় কি না জানতে চাইলে তোফায়েল আহমেদ বলেন, “ডিজিটাল প্রচারণা অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ বলে মনে করি না। ডিজিটাল প্রচারণা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এটা পরীক্ষা নীরিক্ষা করে রেস্ট্রিকটেড করা উচিৎ।”
রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধিমালা-২০০৮র এসব আইন গণতন্ত্রকে বিকাশের জন্য নয়, গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা আইন বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম।
২০১৭ সালে কমিশনার হওয়ার পর রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধিমালা-২০০৮ নিয়ে আইন সচিবের সঙ্গে কথা হয়েছিল বলে জানান তিনি।
রফিকুল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তখন আমি এর বিপক্ষে ছিলাম। এগুলো পরিবর্তন করার জন্য আইন সচিবের সঙ্গে বসছিলাম। তখন সরকারের পক্ষ থেকে আইন সচিব সম্মতি দেননি। আইন তো সরকারের। সরকার রাজি না হলে আমরা প্রস্তাব দিতে পারি না।”
বর্তমান কমিশনের আরও আগে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ ছিল কি না জানতে চাইলে নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের এই কমিশনার বলেন, এটা করতে পারত, করার উদ্যোগ নিতে পারত।
এসময় পাল্টা প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “সরকার রাজি না হলে?”
পরিবর্তন চাইলেও সুযোগ দেখছে না ইসি
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা বিটিআরসিকে চিঠি দিয়ে বলব, সোশাল মিডিয়ায় প্রচারণা যাতে বন্ধ করা হয়। যেহেতু বিধিতে এসব বিষয়ে উল্লেখ নাই, তাই আমরা কাউকে ধরতে পারছি না।”
রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধিমালায় পরিবর্তন আনা দরকার বলে মনে করেন বর্তমান কমিশনের এই অতিরিক্ত সচিবও। তিনি বলেন, আইনগুলো যুগোপযোগী করার প্রয়োজন। পরিবর্তন আনতেই হবে।
ডিজিটাল প্রচার যুক্ত করা উচিৎ কি না জানতে চাইলে অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, “সেটা কমিশনের সিদ্ধান্ত। কমিশন সিদ্ধান্ত নিবে।”
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ফেইসবুক ইউটিউব কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। তবে তাদের সাথে আমরা মিটিং করেছিলাম বিভিন্ন কনটেন্ট- যেগুলো উত্তেজনা সৃষ্টি করে, ধর্মীয় বিবাদ সৃষ্টি করে- সেগুলো অপসারণ করার। সেটা বন্ধ করার সুযোগ নেই।”
বিভিন্ন প্রযুক্তি আসবে, সেগুলোর সুবিধা-অসুবিধা উভয়ই থাকবে মন্তব্য করে এই কমিশনার বলেন, “আমদের নিয়ন্ত্রণ নেই। নজরদারি থাকবে।”
এবার বিটিআরসিকে চিঠি দেওয়া হবে কি না- জানতে চাইলে আনিছুর রহমান বলেন, “বিটিআরসির কোনো ক্ষমতা নেই। তারাও রিকয়েস্ট করে। ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে হবে।
“আমরা সেটা চাই না। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ চাই। যেখানে ফোর জি থাকবে সেখানে ফোর জি; যেখানে টুজি থাকবে সেখানে টুজি।’
রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধিমালায় ডিজিটাল প্রচার যুক্ত করা প্রয়োজন মনে করেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এগুলো আগামীতে হয়ে যাবে। ডিজিটাল বোর্ডের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমরাও কিছু কাজ করে যাব। আপাতত এগুলো নিয়ে মাথাব্যথা নেই।”