ঘুম থেকে উঠেই রিশাদের মনে পড়ে অফিসের লাঞ্চের আগের মিটিংয়ে সে থাকতে পারবে না। বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে আগে থেকেই ছুটি নিয়েছিল। কিন্তু মিটিংয়ে না থাকতে পারার কথা বলতে ভুলে গিয়েছিল। অবশ্য তখনও স্ত্রী সারথি তাকে বিবাহ বার্ষিকী দিনের পরিকল্পনা বলেনি। আগের রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সারথি ঢাকার বাইরে কোনও রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খাওয়ার ইচ্ছা জানিয়েছে।
অনলাইন মিটিংয়ে অনুপস্থিতির খবর জানাতে মেইল করতে গিয়ে রিশাদ দেখলো, নিজের ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড কিছুতেই মনে পড়ছে না। সে কারণে সারথিকে ফোন দিয়ে পাসওয়ার্ড জেনে ল্যাপটপ খুললো। এরপরই বুঝলো, খামাখা খুলেছে। কেননা, নিজের ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড এবং মেইলের পাসওয়ার্ড তো একই।
বিকল্প হিসেবে ফোনে খুলে রাখা ইমেইল থেকে মেইল করতে গিয়ে খেয়াল করলো, ওয়াইফাই কানেক্ট করছে না। আচ্ছা জ্বালা। এর চেয়ে খারাপ দিন শুরু হতে পারে! সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আবার নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে গিয়ে দেখে পাসওয়ার্ড দেওয়া লাগবে। এবার মনে হলো, মাথার চুল ছিঁড়বে রিশাদ। কেননা, পাসওয়ার্ড তো সেই একটাই, যেটি তার মনে পড়ছে না।
ওদিকে রিশাদ ঘুম থেকে ওঠার আগেই সারথি গিয়েছে টাকা তুলতে। অফিসে মিটিংটা হবে আর ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে। সিংগাপুরের হেড অফিস থেকেও লোকজন থাকবেন, ইন্টারনেটে। এমনিতে রিশাদ ছুটিতে, তার উপর আবার অফিসে জানাতে পারছে না- মিটিংয়েও থাকবে না। ততোক্ষণে সারথি ফিরবে! ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড জানার জন্য তাকে ফোন দিলে আবার ধরবে! কিংবা ধরলেও কি বলতে পারবে?
স্ট্রেস বোধ করা শুরু করলো সে। এটি অবশ্যই চাকরির অনিরাপত্তা নিয়ে নয়। বরং সে বিপন্ন বোধ করলো এই ভেবে, প্রায়ই পাসওয়ার্ড ভুলে যাচ্ছে এবং এরকম একটি বিশেষ দিনে সেটি নিয়ে বিস্তর সময় নষ্ট করতে হচ্ছে।
ফোনের নোটস এ পাসওয়ার্ডটা লিখে রাখা আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু নোটস এ ১৫ মিনিট খুঁজেও যখন সেটি পাওয়া গেল না তখন রীতিমতো হতোদ্যম ও মানসিক অবসাদ পেয়ে বসেছে রিশাদকে।
এরকম ভুলভাল দিন কেবল রিশাদের নয়, আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই বছরে একদিন হলেও আসে। হয়তো জরুরি প্রয়োজনে টাকা উঠাতে গিয়ে দেখলাম ক্রেডিট-ডেবিট কার্ডের পাসওয়ার্ড ভুলে যাচ্ছি, অথবা বিশেষ কারণে লক করে রাখা ফাইল আর খুলতে পারছিনা।
সেজ জার্নালে সম্প্রতি গবেষণা পর্যালোচনা নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। ‘ডিজিটাল ডিটক্স: অ্যান ইফেক্টিভ সল্যুশন ইন দ্য স্মার্টফোন এরা? আ সিস্টেমেটিক লিটারেচার রিভিউ’- শীর্ষক ওই নিবন্ধে স্মার্টফোনের অতি ব্যবহার আমাদের শরীর ও মনে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছে।
কেবল স্মার্টফোন নয়, ডিজিটাল প্রযুক্তির পুরোটাই অবসাদ এবং উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যা বাড়াচ্ছে।
সেজ এ প্রকাশিত নিবন্ধটি লেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম ও ডেননমার্কসহ বেশ কয়েকটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর জরিপ চালানো হয়েছিল। গবেষণা জরিপ চালানোর সময় এসব শিক্ষার্থীদের অনেকেই ছিলেন নানা ধরনের অবসাদ এবং বিষণ্ণতায় আক্রান্ত। এসব শিক্ষার্থীকে ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ করে সব ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস থেকে দূরে রাখা হয়।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ডিজিটাল ডিভাইসের সংস্পর্শে না থাকায় জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মানসিক স্থিরতা কিছুটা হলেও ফিরেছে। এছাড়া সামাজিক দক্ষতা বাড়ার পাশাপাশি তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও বেড়েছে।
শুরুর গল্পে রিশাদ চরিত্রটিকে দুইটা ডিভাইসের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ করতে দেখা যায়। একটা ল্যাপটপ আর অন্যটি নিজের ফোন। মূল কারণ একটিই- পাসওয়ার্ড।
পেশাগত এবং ব্যক্তিগত নানা কাজে আমাদের ব্যবহার করতে হয় নানা ধরনের অনলাইন যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম। মনে রাখতে হয় অনেকগুলো পাসওয়ার্ড। মাথার ভেতরে সারাক্ষণ গোপনীয়তা ভঙ্গের উদ্বেগ চাপ তৈরি করে।
যুক্তরাষ্ট্রের পোনেমন ইন্সটিটিউটের এক গবেষণা বলছে, আমেরিকানরা সপ্তাহে শুধু পাসওয়ার্ড সেট-রিসেটের পেছনে ব্যয় করেন প্রায় ১৩ মিনিট। অর্থাৎ মাসে প্রায় ৯০ মিনিট!
ব্লগ সাইট ‘এক্সপ্লোডিং টপিকস’-এর কো- ফাউন্ডার জশ হোয়ার্থের দেওয়া তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে বিশ্বে মানুষ ব্যক্তিগত এবং পেশাগত নানা প্রয়োজনে স্ক্রিনের সামনে দৈনিক ৭ ঘণ্টা করে সময় কাটিয়েছেন। ২০১৩ সাল থেকে ১০ বছরে স্ক্রিন টাইমে যুক্ত হয়েছে বাড়তি ৫০ মিনিট। এতে বেড়েছে হতাশা, বিষণ্ণতা, অবসাদ এবং উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যা।
ডিভাইসকেন্দ্রিক সংকট থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বেশ কয়েকবছর ধরেই ‘স্ক্রিন আওয়ার’ কমিয়ে আনার জোর আন্দোলন চলছে বিশ্বব্যাপী।
লাইফস্টাইল, ভালো থাকা এবং মনোবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা গত কয়েক বছর ধরেই ‘ডিজিটাল ডিটক্স’ নামের একটি নিদান দিয়ে আসছেন। তারা বলছেন, প্যারাময় পাসওয়ার্ডভিত্তিক জীবন থেকে ‘ডিজিটাল ডিটক্স’ দিতে পারে মানুষকে কিছু স্বস্তিকর সময়।
বিনোদন জগতের অনেক তারকা গত কয়েকবছরে ‘ডিজিটাল ডিটক্স’ এর পথ বেছে নিয়েছেন। হলিউড অভিনেত্রী এবং জনপ্রিয় কমেডি সিরিজ ‘ফ্রেন্ডস’ খ্যাত জেনিফার অ্যানিস্টন এদের মধ্যে অন্যতম।
জেনে নেয়া যাক, ‘ডিজিটাল ডিটক্স’-এর ৭টি উপায়-
ডিভাইস মুক্ত জোন
নিজের শয়ন, খাবার কিংবা বসার ঘর রাখুন সব ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস থেকে মুক্ত। পড়াশোনা, আড্ডা দেওয়া বা পারিবারিক গল্পগুজবের জন্য এ জায়গাগুলো বেছে নিন।
সময় কমিয়ে ফেলুন
দিনে বা সপ্তাহে কতক্ষণ সামাজিক যোগাযোগের অ্যাপগুলো ব্যবহার করবেন তা নির্দিষ্ট করার জন্য আপনার ফোনে বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করুন। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে আপনিই অ্যাপ লক হয়ে যাবে।
বন্ধুদের আড্ডায় ‘ফোন স্ট্যাক’ গেইম
খেলাটি এরকম- ধরুন বন্ধুদের সাথে রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছেন। সবাইকে বলুন যার যার ফোন টেবিলের এক জায়গায় জড়ো করতে। যতক্ষণ সময় কাটাবেন ঠিক ততক্ষণ ফোন ধরা সবার জন্যই থাকবে নিষিদ্ধ। ভুল করে যিনি সবার আগে ফোন ধরবেন, তিনি সবার বিল পরিশোধ করবেন।
এবার বলুন, নিয়ম ভঙ্গ করে গাঁটের পয়সা খরচ করতে কেইবা চাইবে?
দৌড়ঝাপ করুন, ভালো থাকুন
হাইকিং, সাইক্লিং বা এমনকি পার্কে হাঁটার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু সময় বের করুন। থাকুন প্রকৃতির কাছাকাছি। কমে আসবে ডিভাইসের অতি ব্যবহার।
ছোটবেলার শখগুলো ফিরিয়ে আনুন
ছোটবেলায় শখ ছিল এমন কিছু নতুন করে শুরু করুন। এটা হতে পারে বাগান করা, ছবি আঁকা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো অথবা রান্না করা। অবশ্যই যেগুলোর সাথে স্ক্রিনের কোন সম্পর্ক নেই।
ব্যায়াম অথবা মেডিটেশন
আপনার দৈনন্দিন রুটিনে ব্যায়াম অন্তর্ভুক্ত করুন। আর মেডিটেশন আপনার স্ক্রিনটাইম কমিয়ে আনতে যেমন সাহায্য করবে, তেমনি মানসিকভাবেও প্রশান্তি দিবে।
ডিভাইস মুক্ত দিন
সপ্তাহে একদিন পালন করুন ডিভাইস মুক্ত দিন। আপনার ফোন, কম্পিউটার এবং অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসগুলি এদিন সম্পূর্ণ বন্ধ রাখুন।
আবিষ্কার করুন জীবনের আনন্দগুলো।