পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু ‘ডিজিটাল নোমাড’ বা ‘প্রযুক্তি যাযাবর’ এর জীবনকে বেছে নেওয়া বিশ্বজুড়েই একটি নতুন ও ক্রমবর্ধমান ট্রেন্ড হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আর এর কারণে নতুন ধরনের ভিসা ইস্যু করছে দেশগুলো। বিভিন্ন বড় সংস্থাগুলোও তৈরি করছে নানা ধরনের সুযোগ।
শুরুর কথা
‘ডিজিটাল নোমাড’ শব্দ যুগল শুনলেই মনে হয় চটকদার বিজ্ঞাপনের ভাষা- হয়তো দু’চার বছর হলো চালু হয়েছে। কিংবা কেউ হয়তো ভাবতে পারেন এটি চালু হয়েছে বড়জোর বছর দশেক হলো, যখন থেকে ইউটিউব-ফেইসবুক ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থান হয়েছে, ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসার ও বিস্তৃতি ঘটেছে। কিন্তু এই টার্মটি পুরনো। ১৯৯৭ সালে সুজিও মাকিমোটো এবং ডেভিড ম্যানার্স ঠিক এই শিরোনামেই বই লিখেন।
বইটির বিষয়বস্তু ছিল, এক দেশ থেকে অন্যদেশে কীভাবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে লগ-ইন করে কর্মীরা কাজ করবেন। এতে বলা হয়েছিল, ভ্রমণপিপাসু মানুষকে আগের যাযাবর জীবনে কিভাবে ইন্টারনেট ফিরিয়ে নিয়ে যাবে এবং একইসঙ্গে কর্মসংস্থানও তৈরি করবে।
বইটি প্রকাশের তিন দশকও হয়নি, অথচ বর্তমান পৃথিবীতে ওয়াইফাই সংযোগ এবং অনলাইন কাজের ক্ষেত্রগুলো ‘ডিজিটাল নোমাড’ জনগোষ্ঠির বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক
অনেকের জন্য, ডিজিটাল যাযাবরতা হলো চূড়ান্ত স্বপ্নের জীবনধারা, যা চলাফেরার স্বাধীনতা এবং জীবিকা অর্জনের সময় বিশ্ব অন্বেষণ করার ক্ষমতা দেয়।
এদিকে, অন্যরা বলছেন যে এটি ‘জেন্ট্রিফিকেশন’। পিছিয়ে থাকা গরীব জনগোষ্ঠির বসবাসের স্থানে অপেক্ষাকৃত সম্পদশালীদের বসবাসের মধ্য দিয়ে সেখানে নতুন নতুন ব্যবসা খোলা, উন্নয়ন ও অবকাঠামোর পরিবর্তনকেই ‘জেন্ট্রিফিকেশন’ বলে। যদিও এক্ষেত্রে স্থানীয়দের নিজের বসবাসের জায়গা ছাড়তে হতে পারে অনেকক্ষেত্রে।
অর্থাৎ ওয়াইফাই বা ইন্টারনেট সুযোগ দেয়াসহ কাজের পরিবেশ তৈরি করে পর্যটক আকর্ষণ করার একটি ক্ষেত্র হচ্ছে জেন্ট্রিফিকেশন। সমালোচনাকারীরা বলছেন, ‘ডিজিটাল যাযাবর’ জীপনযাপন উৎসাহী করার ফলে পিছিয়ে থাকা একটি জনগোষ্ঠি ব্যবসায়িকভাবে কিছুটা সুবিধা পেলেও এটি সেখানকার স্থানীয়দের জন্য পণ্য মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। ফলে আখেরে ক্ষতি হয়। তাছাড়া অতি পর্যটকের আবির্ভাবও একটি অঞ্চলকে স্থানীয়দের বসবাসের অযোগ্য করে তোলে।
বাড়তে থাকা ‘ডিজিটাল যাযাবর’
এখন অনেকগুলো দেশ এই বাড়তে থাকা মোবাইল পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য নতুন ভিসা চালু করেছে বা উদ্যোগ নিয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও তাদের চাহিদা পূরণের জন্য ‘ডিজিটাল যাযাবর’ কর্মীবাহিনীকে সুযোগ করার ব্যবস্থা করছে।
প্রযুক্তিগত সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান থাকলেও ২০১০ সালের আগে ‘ডিজিটাল যাযাবর’ লাইফস্টাইল যাপনকারীর সংখ্যা ছিল নগন্য।
এ প্রসঙ্গে লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড ‘নোম্যাডনেস ট্রাভেল ট্রাইব’ এর উদ্যোক্তা লেখিক ও ট্রাভেল অ্যাকটিভিস্ট এমি অ্যাওয়ার্ড জয়ী ইভিটা রবিনসন বলেন, আগে আমাদের বাবা-মা বা পরিবারের কথা চিন্তা করে, আমরা
অফিস ঢুকতাম, অবসরে পেনশন এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে উন্নতির সিঁড়ি বাওয়ার কথা চিন্তা করতাম। তবে এখন অনেকেই এ পুরনো ধারণাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন। বিশ্ব দেখার জন্য এখন কেউ বুড়ো বয়সে অবসরের কথা ভাবেন না।
এখানে একটু বলে রাখি, কালো ও বাদামি বর্ণের পর্যটকদের কমিউনিটি ও ফ্যাশন নিয়ে ইভিটা রবিনসন নতুন কনসেপ্ট চালু করেছেন- ট্রাভেলার অব কালারস।
‘ডিজিটাল যাযাবর’ ট্রেন্ডকে আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন লেখক, বক্তা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লরেন রাজাভি। তার বই ‘গ্লোবাল নেটিভস: দ্য নিউ ফ্রন্টিয়ার্স অব ওয়ার্ক, ট্রাভেল, অ্যান্ড ইনোভেশন’- এ তিনি বলেন, ডিজিটাল যাযাবরদের মূল ট্রেন্ডটি শুরু হয়েছিল মূলত শ্বেতাঙ্গদের দ্বারাই। এদের অনেকেই টেক ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতেন কিংবা অনেকে এমনও ছিলেন যারা নিজেদের গ্লামারাস লাইফস্টাইল তুলে ধরতেন। অনেকটা এ সময়ের ট্রাভেল ইনফ্লুয়েন্সারদের পূর্বপুরুষ তারা। একই সঙ্গে বর্তমান ট্রাভেল ইনফ্লুয়েন্সাররা ভ্রমণ করছেন, গাইড করছেন আবার অর্থও কামাচ্ছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কাজ করার সুযোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, এই ট্রেন্ডও জনপ্রিয় হয়েছে।
কোভিড মহামারী ও ডিজিটাল পর্যটক
প্রযুক্তি বিপ্লবের পাশাপাশি আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছে কোভিড-১৯ মহামারী। লকডাউন প্রমাণ করেছে যে, আগের চেয়ে বেশি মানুষ অনলাইনে তাদের কাজ করতে সক্ষম। আবার বাধ্য হয়েও এ সক্ষমতা কেউ কেউ অর্জন করেছেন জীবিকার তাগিদে।
মহামারী শেষে শারীরিক দূরত্বের বিধি-নিষেধ তুলে নেয়ার পরে কেউ কেউ অফিসে ফিরেছেন। তবু একটি বিশাল অংশের মানুষ এখন অনলাইনে কাজ করতে অভ্যস্ত হয়েছেন। তারা আর অফিসে ফেরেননি। রিয়াল এস্টেট বিশ্লেষণী সংস্থা মুডিস জানাচ্ছে, কর্পোরেট রিয়াল এস্টেট বা অফিস ভাড়া দেওয়ার জন্য স্পেসগুলোর ২০ শতাংশেরও বেশি এখন খালি রয়ে গিয়েছে।
এন্টারপ্রাইজ সলিউশন কোম্পানি এমবিও পার্টনারস, যারা মূলত বিভিন্ন কোম্পানিকে দূরবর্তী কর্মীদের তথ্য ও যোগযোগ পরিষেবা দেয়। তাদের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমান বিশ্বে ৩ কোটি ৫০ লাখ লোক বর্তমানে নিজেদের ‘ডিজিটাল নোমাড’ হিসেবে পরিচয় দেন।
মহামারী পরবর্তী সময়ে ভ্রমণের প্রতি আগ্রহ এবং যেকোনও জায়গা থেকে কাজ করার সুযোগ নিয়ে সাংবাদিক ও ‘ডিজিটাল যাযাবর’ হিসেবে নিজেকে পরিচয়দানকারী মার্কুইটা হ্যারিস বলেন, “ইতিহাসে এখন সেই সময়, যখন আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি পাসপোর্ট রয়েছে এবং আমরা এই সব সুবিধা পেয়েছি। ডিজিটাল যাযাবরের জীবন আমাকে আরও গভীরে যাবার, আগের চেয়ে অনেক বেশি বোঝার সুযোগ দিয়েছে। এখন আমি কোথাও চারদিনের জন্য ছুটি কাটাতে পারি। এবং আমার মনে হয় আমি সেই অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শিখেছি।”
ডিজিটাল যাযাবর ও চ্যালেঞ্জ
এমবিও পার্টনারস বলছে, ডিজিটাল যাযাবর লাইফস্টাইলের প্রবণতা কোভিড মহামারী শুরুর থেকে এখন পর্যন্ত ১৩১ শতাংশ বেড়েছে। তারপরও কেউ কেউ মনে করেন, এ ধরনের লাইফস্টাইলের ভবিষ্যত ততটা উজ্জ্বলও নয়। স্পেন এবং গ্রিসের মতো জায়গায় অনেক বেশি সংখ্যক পর্যটকদের আগমনের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয়রা।
ডোমিনিকান রিপাবলিক, বালি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোর স্থানীয়দের অনেকেই মনে করেন, ডিজিটাল যাযাবররা ইতিমধ্যে তাদের দুষ্প্রাপ্য সম্পদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে এবং পণ্য ও আবাসনের খরচ তাদের সামর্থ্যের বাইরে চলে গিয়েছে।
লেখক এবং ডোমিনিকার স্থানীয় বাসিন্দা মেচি আনাস এস্তভেজ ক্রুজ বলেন, “সাধারণভাবে পর্যটন যে সমস্যাগুলো তৈরি করে, ডিজিটাল পর্যটকরাও সেই এক ধরনের সমস্যার উর্দ্ধে নন। বেশিরভাগ সময়ই পর্যটকরা একটি নির্দিষ্ট মাত্রার স্বাচ্ছন্দ্য খোঁজেন। সেই অনুযায়ী, এআরবিএনবি (বাসা ভাড়ার অ্যাপ) থেকে তারা যে বাড়িটি ভাড়া নেন, সেটি বিদেশি কারও মালিকানাধীন। তারা এসে বলে এটি খুব সস্তা… সস্তাটা কার জন্য? আপনি নিজে (সস্তা) দেখান, তারপর বন্ধুদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন এটাকে স্বর্গ হিসেবে দেখাতে, আর এভাবে সবকিছুর দাম আকাশচুম্বি হয়ে যায়।”
কেবল ডোমিনিকায় নয়। সারা বিশ্বেই এটি ঘটছে। পর্যটকদের উপস্থিতি বেশি এমন জায়গার স্থানীয়দের নিজেদের নাগালের বাইরের সবকিছুর দাম চলে যাচ্ছে বলে তারা মনে করেন।
উদাহরণ হিসেবে, পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ ব্যালিয়ারিক আইল্যান্ডস এর কথা টানা যেতে পারে। আইডিয়ালিস্টা নামের জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন বলছে, পর্যটকদের কারণে সেই দ্বীপপুঞ্জে পণ্যের দাম গত বছরে ১৮ শতাংশ বেড়েছে।
কালার পর্যটনের উদ্যোক্তা ইভিটা রবিনসনও পর্যটনের এ সমস্যাটি ‘সংঘাতময়’ হিসেবেই মনে করেন। তিনি বলেন, “এটি আসলেই জেন্ট্রিফিকেশন। আমি যে কাজ করি, তাতে বছরের পর বছর এ দুইটি ব্যাপারে সংঘাত দেখে আসছি। সত্যিকার অর্থেই এটি হৃদয়বিদারক এবং সাংঘর্ষিক, যখন পর্যটকদের জ্বালায় স্থানীয় অধিবাসীরাই উৎখাত হওয়ার জোগাড় হয়।”
সমাধান কী?
তাহলে ডিজিটাল পর্যটকদের এই দ্বন্দ্ব মেটানোর কোনও উপায় কি হাতে রয়েছে! রূরাল (ROORAL) এরকম প্রত্যন্ত অঞ্চলের কর্মীদের কাজের জন্য অবকাঠামো প্রস্তুতে জড়িত। রূরাল এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা জুয়ান বারবেড এ সমস্যা সমাধানে স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং সম্প্রদায়ের অংশ হওয়ার ওপর জোর দেন।
তিনি জানান, তারা এমন একটি মডেল ডেভেলপ করেছেন যেখানে কাজের অবকাঠামো নির্মাণের আগে স্থানীয় সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে তাদের চাওয়া-পাওয়া ঠিক করে নেয়া হয়।
আগেও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়নের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেগুলো রূরাল এর মতো না হওয়ায় স্থানীয়দের সুযোগ ছিল কম। তাছাড়া হাই-স্পিড ওয়াইফাই ব্যয়বহুল হওয়াতে সেটির মূল গ্রাহক হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিদেশি পর্যটকরা। এতে স্থানীয় কমিউনিটির তেমন কোনও যোগ ছিল না বললেই চলে।
‘ডিজিটাল যাযাবর’ লাইফস্টাইলের সঙ্গে যত বেশি লোক জড়িত হচ্ছে, ততো এর ধরন পাল্টাচ্ছে। যেমন, আগে কেবল তরুণ প্রযুক্তি কর্মীরাই এ জীবন বেছে নিতে, আস্তে আস্তে এর সঙ্গে পরিবার যোগ হয়েছে। অর্থাৎ পুরো পরিবারই এখন ‘ডিজিটাল যাযাবর’। নোম্যাডনেস এর মতো সংস্থাগুলোর প্রসার ঘটছে। এসব সংস্থা পর্যটকদের গন্তব্যের বৈচিত্রতা তৈরি করছে। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলেই অনেকে মনে করেন।
এই পরিবর্তনটি ডিজিটাল যাযাবর হ্যারিসের চিন্তাধারায় প্রতিফলিত হয়- “[আমি মনে করি এটি গুরুত্বপূর্ণ] নিশ্চিত করা যে আপনি স্থানটির শুধু অর্থনীতিতে নয়, তার সংস্কৃতিতেও অবদান রাখছেন। আপনি যদি সতর্ক না হন তাহলে জেন্ট্রিফিকেশন (বা স্থানীয়দের নাভিশ্বাস তোলার কারণ)– এর অংশ হয়ে যাবেন। কাজেই নিজের মাসিক খরচের দিকে লক্ষ্য রাখুন। এক মাসের জন্য কোনও জায়গায় যদি থাকেন এবং অন্তত একজন স্থানীয়ের সঙ্গেও আপনার বন্ধুত্ব না হয়, তাহলে ব্যাপারটি অনুচিত হবে।”
ডোমিনিকার লেখক ক্রুজ অবশ্য এ ব্যাপারেও সন্দিহান। তিনি মনে করেন, ৫-৭ শ বছর থেকে অনাহুত অতিথিদের আনোগোনায় বিরক্ত একটি স্থানের অধিবাসীদের পক্ষে পর্যটকদের সম্মান দেয়াটা কঠিন। বিশেষত তারা যেখানে শোষিতও। সেখানে স্থানীয়দের রূঢ় ব্যবহারের পরও একজন ডিজিটাল পর্যটকের ভালো ব্যবহার করা উচিত। তবে কারও যদি বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী কোনও দেশের পাসপোর্ট থাকে, তাহলে ওই নিপীড়িত অঞ্চলে যাওয়ার আগে ভেবেচিন্তেই মনস্থির করা উচিত।
নতুন ভিসা–নতুন সম্ভাবনা
জাপান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্বব্যাপী যাযাবর কর্মীদের আকর্ষণ করতে নতুন নতুন ভিসা চালু করছে। এই প্রবণতা অন্যান্য দেশেও ছড়াবে এবং ডিজিটাল যাযাবরের সংখ্যাও বাড়বে। তবে এও ঠিক ভিসা প্রক্রিয়া ডিজিটাল যাযাবরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করবে। পাশাপাশি স্থানীয় অর্থনীতিতে তাদের অবদান রাখার ব্যাপারটিও নিম্চিত হবে। ইভিটা রবিনসন এই প্রবণতার সম্প্রসারণ এবং ধারাবাহিকতা ভালোই মনে করছেন। তবে ডিজিটাল যাযাবর জীবনধারার সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ভ্রমণকারী এবং দেশগুলোকে সচেতন থাকার ব্যাপারেও জোর দেন তিনি।
ডিজিটাল যাযাবর হওয়ার চারিত্রিক দক্ষতা
ডিজিটাল যাযাবরের জীবন আগ্রহোদ্দীপক ও রোমাঞ্চকর। তবে সেটার জন্য প্রস্তুতিও কম নিতে হয় না। দুই ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। তার প্রথমটি হচ্ছে, এই লাইফস্টাইলের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার জন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও শারিরীক সক্ষমতা গড়ে তোলা। একজন ডিজিটাল যাযাবরকে সাধারণত কিছু বিষয়ে সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়।
স্ব-প্রেরণা
যেখানে সেখানে কাজ করার অভ্যাস আয়ত্তে আনাটা জরুরী। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা, ল্যাপটপ খোলা এবং দিনের কাজ শুরু করার ড্রাইভ কারো কারো জন্য কঠিন কাজ হতে পারে। কোনও একটি জায়গায় গিয়ে জড়তা কাটানো সহজ নয়। এর জন্য রীতিমত সংগ্রাম করা লাগতে পারে। কাজেই স্ব-প্রেরণা বাড়াতে সকালের রুটিন তৈরি করা, দিনের করণীয় তালিকা করা, কাজ এবং থাকার জায়গা আলাদা করা জরুরী। অনেক সময় একই কাজে জড়িত সহকর্মী থাকলে স্ব-প্রেরণায় কাজ করাটা সহজ হয়। আর কানে হেডফোন গুঁজে কাজ করলে কারও কারও ক্ষেত্রে মনোযোগ নিবিষ্ট রাখাও সম্ভব হয়।
আস্থা তৈরি করা
দূরবর্তী জায়গায় বসে কাজ করেন বলে ডিজিটাল যাযাবরদের প্রতি আস্থা অনেক ক্ষেত্রেই কোম্পানিগুলোর মধ্যে কম। সেহেতু নিজেকে সবসময় যোগাযোগের মধ্যে রাখার অভ্যাস করতে হবে। যেকোনও পরিস্থিতিতে এমনকি ভ্রমণ করতে করতেও কাজ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কথার বরখেলাপ এ জীবনযাত্রার সবচেয়ে বড় শত্রু।
সহজে মেশার ও বন্ধুত্ব তৈরির ক্ষমতা
যেকোনও জায়গায় ঘুরতে গিয়ে কাজ করা লাগতে পারে। এমন হতে পারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুতের সংকট রয়েছে। কাজেই সুবিধা আছে এমন দোকান বা জায়গা বসে সহজে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলাটা একটি বিশেষ যোগ্যতা এক্ষেত্রে।
প্রস্তুতি
ব্যাকপ্যাক গোছানোর ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার ছাপ রাখাটাও একটি দক্ষতা। অনেক বিষয় আছে, যেগুলো আমরা মাথায় রাখিনা। যেমন- ফাস্ট এইড বক্স সাথে নেওয়া, বাড়তি ডিজিটাল মানি বহন করা ইত্যাদি। প্রত্যেক জায়গায় যাওয়ার আগে একটি পরিকল্পনা করে নেওয়া, সেই জায়গায় কোথায় কোথায় ঘোরা হবে সে-ই ব্যাপারে।
শারীরিক সক্ষমতা
ভ্রমণের ধকল অনেক সময়ই অনেকের সহ্য হয় না। ডিজিটাল যাযাবর-কে সবসময়ই এই ধকল কাটিয়ে কাজ করার মানসিক জোর থাকতে হবে।
প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি
ডিজিটাল যাযাবর হিসেবে বিশ্ব ভ্রমণ করতে গেলে কেবলমাত্র একটি ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগই যথেষ্ট নয়। কাজ করার জন্য এবং দৈনন্দিন কাজগুলো সুচারুভাবে পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যারের প্রয়োজন হবে।
প্রযুক্তিগত দক্ষতা
একজন ডিজিটাল যাযাবরের কাজই তো প্রযুক্তি নিয়ে। এ ধরনের লাইফস্টাইলে সাধারণত তার পেশা হয় ব্লগিং করা, বিভিন্ন বিষয়ে ভ্লগার, ডকুমেন্টরি নির্মাতা, ডেটা অ্যানালিস্ট, ব্র্যান্ড প্রমোটর, লোগো ডিজাইনার, মোশন গ্রাফিক্স তৈরি করা, অনলাইন সেলস অ্যান্ড প্রমোটিং, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, সোশাল মিডিয়া কমিউনিকেশন, জার্নালিজম, ফটোগ্রাফি ইত্যাদি। যার জন্য তার প্রয়োজন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ল্যাপটপ। বাড়তি চার্জার। ভালো মানের মোবাইল ডিভাইস। আর যা যা দরকার সেগুলোর একটি তালিকা নিচে দেওয়া হলো।
অপারেটিং সিস্টেম: উইন্ডোজ, ম্যাকওএস বা লিনাক্সের মতো একটি স্থিতিশীল এবং নিরাপদ অপারেটিং সিস্টেম প্রয়োজন।
অফিস স্যুট: মাইক্রোসফট অফিস, গুগল ডক্স, বা অপেন অফিসের মতো একটি অফিস স্যুট ডকুমেন্ট তৈরি, স্প্রেডশিট ব্যবহার এবং প্রেজেন্টেশন তৈরির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
ক্লাউড স্টোরেজ: গুগল ড্রাইভ, ড্রপবক্স বা আইক্লাউডের মতো ক্লাউড স্টোরেজ সার্ভিস ব্যবহার করে আপনার ফাইলগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন এবং যেকোনো জায়গা থেকে অ্যাক্সেস করতে পারবেন।
ভিডিও কনফারেন্সিং টুল: জুম, মাইক্রোসফট টিমস বা গুগল মিটের মতো ভিডিও কনফারেন্সিং টুল ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ রাখতে এবং মিটিং করতে সাহায্য করবে।
প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট টুল: ট্রেলো, অ্যাসানা বা মাইক্রোসফ্ট প্রোজেক্টের মতো প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট টুল একাধিক প্রজেক্ট পরিচালনা করতে সাহায্য করবে।
গ্রাফিক্স ডিজাইন টুল: অ্যাডোবি ফটোশপ, ইলাস্ট্রেটর বা ক্যানভার মতো গ্রাফিক্স ডিজাইন টুল আপনাকে বিভিন্ন ধরনের ভিজুয়াল কনটেন্ট তৈরি করতে সাহায্য করবে।
কোডিং এডিটর: ভিএস কোড, সাবলাইম টেক্সট বা অ্যাটমের মতো কোডিং এডিটর ওয়েবসাইট বা অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করতে সাহায্য করবে।
পাসওয়ার্ড ম্যানেজার: লাস্টপাস, বিটওয়ারডেন বা কিপাসের মতো পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করে আপনার সবগুলো পাসওয়ার্ড সুরক্ষিতভাবে সংরক্ষণ করতে পারবেন।
ভিপিএন: নর্ডভিপিএন, এক্সপ্রেসভিপিএন বা সার্ফশার্কের মতো ভিপিএন সার্ভিস ব্যবহার করে আপনার ইন্টারনেট সংযোগ সুরক্ষিত করতে পারবেন।
ব্লগিং প্ল্যাটফর্ম: ওয়ার্ডপ্রেস, মিডিয়াম বা স্কুয়ারস্পেসের মতো ব্লগিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আপনার নিজস্ব ব্লগ তৈরি করতে পারবেন।
অতিরিক্ত সফটওয়্যার
অডিও এবং ভিডিও এডিটিং টুল: অ্যাডোবি অডিশন, ফিনাল কাট প্রো বা ড্যাভিন্সি রিজলভের মতো অডিও এবং ভিডিও এডিটিং টুল ব্যবহার করে আপনার ভিডিও এবং অডিও কনটেন্ট এডিট করতে পারবেন।
মাইন্ড ম্যাপিং টুল: মাইন্ড ম্যাপিং টুল ব্যবহার করে আপনার আইডিয়াগুলোকে সুবিন্যস্ত করতে পারবেন।
টাইম ট্র্যাকিং টুল: টোডোইস্ট, ট্রেলো বা গুগল ক্যালেন্ডারের মতো টাইম ট্র্যাকিং টুল ব্যবহার করে আপনার সময়কে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করতে পারবেন।
কাজের সঙ্গে ঘোরা। একটি আলাদা ধরনের মানসিক সেট আপ। মানুষ তার যাযাবর জীবন ছেড়েছে হাজার বছর হলো। থিতু হয়ে কাজ করার অভ্যাস তার পুরনো। এ অবস্থায় ডিজিটাল যাযাবরের লাইফস্টাইল বেছে নেওয়া অবশ্যই সাহসী। সমাজ ও রাষ্ট্রিক কাঠামোতেও বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটবে, যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে।
(বিবিসি অবলম্বনে)