ফেইস টু ফেইস বনাম ইন্টারফেইস টু ইন্টারফেইস
সৈয়দ বানু। আমার দাদু। অবিভক্ত ভারতে তার জন্ম। ছোটবেলায় দেখতাম, টিভির মধ্যে পুরুষ মানুষ দেখলেও দাদু মাথায় ঘোমটা দিতেন। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, ‘দাদু, ঘোমটা দিতাছো ক্যারে’?দাদু বলতেন, ‘দেহস না! টিভির মধ্যে ব্যাডা মানুষ, চাইয়া রইছে’!
এই শতক শুরু হতে না হতেই সৈয়দ বানু এবং তার প্রজন্ম গত হয়েছে। গত হয়েছে পুরনো পৃথিবীর অনেক বাস্তবতাও।
এই শতকে আমাদের আটপৌরে জীবনের ঘরোয়া আলাপের প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যুদ্ধে ড্রোনের ব্যবহার, এআই দিয়ে বানানো সংবাদ পাঠিকার পঠনভঙ্গীর গুণবিচার এবং রোবট সোফিয়ার পাওয়া নাগরিকত্বের মতন বিষয়াদি।
আগে সায়েন্স ফিকশান বা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে যা ঘটতো, বাস্তবেও এখন আমরা সেরকম অনেক কিছু ঘটতে দেখছি। মহাকাশে বাণিজ্যিক ভ্রমণ শুরু হচ্ছে, শরীর এক দেশে থাকলেও ফেইসবুক-ইন্সটা-স্কাইপির মতোন প্রযুক্তির কল্যাণে কল্পিত দেবতাদের মতোন আমরাও স্থান-কাল-সীমানার গণ্ডি ভেঙে দিয়ে সর্বত্রই থাকতে পারছি বিরাজমান।
পৃথিবীর প্রথম আবিষ্কৃত কম্পিউটার ছিল প্রায় একটি ঘরের সমান। ছোট হতে হতে তা এখন চলে এসেছে পকেটে। হাতের একেকটি মোবাইল ফোনই এখন একেকটি কম্পিউটার।
আর তথ্য! তা পরিবহনে এখন আর দিস্তা দিস্তা কাগজ বা সিডি/ডিভিডি বা হার্ডড্রাইভ তো দূর-কী-বাৎ, মামুলি একটা পেনড্রাইভও পর্যন্ত প্রয়োজন হয় না। তথ্য এখন হয়ে গেছে ‘বিদেহী আত্মার’ মতন, বডিলেস। ক্লাউডেই এখন জমা থাকে সকল তথ্য।
একেকটি মোবাইল ফোন যেমন হয়ে উঠেছে একেকটি কম্পিউটার, তেমনি প্রতিটি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসই হয়ে উঠেছে একেকটি নজরদারির যন্ত্র। ইন্টারনেট দমে-দমে, কদমে-কদমে তার ব্যবহারকারীকে অনুসরণ করছে।
এই অনুসরণকারী নয় বন্ধুর মতোন নির্দোষ সঙ্গ শুধু।
এই অনুসরণ অনেকক্ষেত্রেই শিকারির মতোন। মোক্ষম মুহূর্তে বসায় কামড়। ব্যাবহারকারীর নিউজ ফিডে এলগোরিদম পাঠায় শুধুই তার পছন্দের খবর ও কনটেন্ট।
এভাবেই সিলেক্টিভ বিষয় দিয়ে তৈরি হয় এক নয়া বাস্তবতা, যা ঠিক সামগ্রিক বাস্তবতা নয়, বাস্তবের ডিলিউশানাল ভার্সান বা আধা সত্য-মিথ্যের মিশেলের এক বাবল বা বুদ্বুদ।এভাবেই পৃথিবী বিভক্ত হয়ে গেছে বিভিন্ন বাবলে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে আমরা এখন বাস করি ইন্টারনেট দিয়ে ম্যানিপুলেটেড একেকটি সোশাল মিডিয়া বাবলের ভেতর।
ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, ইন্টারনেট ও এলগোরিদম ইত্যকার অনুসঙ্গের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ট্রিলিয়ন ডলারের সার্ভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম বা নজরদারির নয়া পুঁজিবাদ।
‘মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’ থেকে মানব সভ্যতা এখন গড়িয়েছে ফেইসবুক-ইন্সটার ইন্টারফেইস টু ইন্টারফেইসে।
আজকের এই দিনেই ভীষণ জরুরি হয়ে উঠেছে মার্শাল ম্যাকলুহান পাঠ। তিনিই ছিলেন ইন্টারনেটের ভবিষৎদ্রষ্টা। কাল বিভাজন করে ‘বৈদ্যুতিন যুগ’ নামে তিনি এক নয়া কালকে চিহ্নিত করেছিলেন, সেই যুগে সারাটা বিশ্ব একটা গ্রামে পরিণত হবে বলেও আভাস দিয়েছিলেন তিনি।
বিশ্ব তো গ্রামে পরিণত হয়েছেই। প্রযুক্তির নব নব আবিষ্কারে মিডিয়ার ইকোলজিও পাল্টে গেছে। সাবেকী গণমাধ্যম ধুঁকছে। টিভি, রেডিও, নিউজপেপার পড়েছে অস্তিত্ব সংকটে।
রেডিও এখন টিভির মতোই সব কিছু দেখাচ্ছে, পত্রিকা এখন টিভির মতোন সম্প্রচার করছে, ব্যক্তি মানুষের করায়াত্ত হয়েছে ফেইসবুকের মতোন সরাসরি সম্প্রচার মাধ্যম যা কিনা যে কোনও দেশের টিভির চেয়েও বেশি শক্তিশালী।
ম্যাকলুহান বর্ণিত ‘হট মিডিয়া’ এখন আর হট মিডিয়ার মতোন থাকছে না, রপ্ত করছে ‘কুল’ মিডিয়ার আচরণ।
এই যুগে বিপ্লব হোক বা রাষ্ট্র হোক বা হোক ভোট বা গণতন্ত্র অথবা হোক দু’টো মানুষের সেই চিরায়ত প্রেম। সবকিছুর মধ্যেই ঢুকে পড়ছে প্রযুক্তি, সব কিছুর মধ্যেই ঢুকে পড়ছে মাধ্যম তথা মিডিয়া।
তাই, প্রযুক্তি ও মিডিয়াকে জানা হয়ে উঠেছে সময়ের দাবি।
প্রযুক্তি বনাম প্রকৃতি: পণ্ডিতদের অবস্থান
প্রযুক্তি আর প্রকৃতি দু’টো কি দু’য়ের প্রতিপক্ষ? নাকি একে অন্যের সহগ?
প্রযুক্তির ব্যবহার কেমন হবে সেটি কে ঠিক করে?
প্রযুক্তির ধরণের উপরেই কি নির্ধারণ হয় এর ব্যবহার? নাকি মানুষই নির্ধারণ করে প্রযুক্তির ব্যবহার কেমন হবে?
ইত্যকার প্রশ্নগুলো নিয়ে পণ্ডিতেরা দ্বিধা-বিভক্ত। যে যার মতের পক্ষে যুক্তি হাজির করছেন।
মার্শাল ম্যাকলুহানের মতোন টেকনোলজিকেল ডিটারমিনিস্ট যারা তারা এক পক্ষে থাকছেন। প্রযুক্তিকেই তারা দিয়েছেন প্রাধান্য, রেখেছেন ড্রাইভিং সিটে।
বিপরীত মেরুতে রয়েছেন রেম্যান্ড উইলিয়ামসের মতোন পণ্ডিত। মানুষের বিবেচনাবোধ, সমাজে বিদ্যমান ক্ষমতা সম্পর্কের মতোন অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে টেকনোলজিকেল ডিটারমিনিস্টরা বিবেচনায় নেন না বলে সমালোচনা হাজির করেছেন উলিয়ামস।
এই দুই পন্থার বাইরে গিয়ে মধ্যমপন্থা ধরেছেন ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়াহ হারারি।
২০১৭ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ায় আয়োজিত ‘হোমো দিউস: আ ব্রিফ হিস্টরি অফ টুমোরো উইথ ইউভাল নোয়াহ হারারি’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, “টেকনোলজি ইজ আ ফোর্স অফ নেচার; ইটস লাইক ন্যাচারাল বায়োলজি; ইট ইভল্ভস”।
মানে প্রযুক্তি প্রকৃতিরই একটা রূপ বা বহিঃপ্রকাশ; এটিও প্রাকৃতির মতোই, এরও ক্রমবিকাশ ঘটে।
প্রযুক্তির উপরে নির্ভরশীলতাকে হারারি ঢালাওভাবে ভালো বা খারাপ বলে আখ্যায়িত করেন না।
তবে, প্রযুক্তির অতিমানবীয় ধাঁচের সংস্করণ ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা ‘এআই’ নিয়ে হারারির স্পষ্টতই অস্বস্তি আছে। সেই অস্বস্তির কথা তিনি খোলাখুলিভাবে বিভিন্ন বক্তৃতায় ও আলোচনায় বলেছেনও।
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার বক্তৃতায় তিনি বলেন, “এন্টায়ার হিউম্যানিস্ট ওয়ার্ল্ডভিউ ইজ ফেইসিং এ থ্রেট। নট সো মাচ ফ্রম রিলিজিয়াস ফান্ডামেন্টালিস্ট। […] দি রিয়েলি বিগ থ্রেট টু দি হিউম্যানিস্ট ওয়ার্ল্ডভিউ ইজ নাউ ইমার্জিং ফ্রম দি ল্যাবোরেটোরিজ, ফ্রম দি ইউনিভার্সিটিজ, ফ্রম দি রিসার্চ ডিপার্টমেন্টস ইন প্লেসেস লাইক সিলিকন ভ্যালি, বিকজ হোয়াট মোর এন্ড মোর সাইয়েন্টিস্টস আর টেলিং আস দিস এন্টাইয়ার স্টোরি অফ হিউম্যানিজম ইজ রিয়েলি বেইজড অন আউটডেটেড সায়েন্স অর এন্ আউটডেটেড আন্ডারস্ট্যান্ডিং অফ দি ওর্য়াল্ড, এন্ড ইন পার্টিকুলার, এন আউটডেটেড আন্ডারস্ট্যান্ডিং অফ হোমাস্যাপিয়েন্স”।
তার ভাষ্যমতে, সমগ্র মানবজাতির বিশ্ববীক্ষণ এখন এক হুমকির মুখে পড়েছে।
এই হুমকি ধর্মীয় গোঁড়াদের থেকে অতোটা আসেনি। বরং বিভিন্ন পরীক্ষাগার থেকে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং সিলিকন ভ্যালির মতো বিভিন্ন গবেষণাগার থেকেই এই হুমকির উদয় হচ্ছে।
কারণ আরও বেশি সংখ্যক বিজ্ঞানীরা আমাদের বলছেন যে, মানবজাতির এই পুরো গল্পটাই মান্ধাতার আমলের একটা বিশ্ববীক্ষণের উপর গড়ে উঠেছে; বিশেষত, মানবজাতি সম্পর্কে আমাদের জানাশোনা, একেবারে সেকেলে ধ্যান-ধারণার উপরে গড়ে উঠেছে।
ডাটাইজম বা মানুষের জীবনের সকল তথ্য পাবলিক করে দেওয়ার বিষয়টি কেমন করে মানুষের চিন্তা ও সভ্যতাকে দখল করে নিচ্ছে তার উপরে নজর ফিরিয়েছেন হারিরি।এলগোরিদমের কায়দায় পড়ে নিগুঢ় ব্যক্তিগত তথ্যও কেমন করে বাণিজ্যের বস্তুতে পরিণত হচ্ছে, আর ব্যক্তির সেই তথ্য কেমন করে হয়ে উঠছে ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার সেই বিষয়ে দৃঢ়ভাবে কথা বলেছেন হারারি।
ডাটা বা তথ্যকে কাজে লাগিয়ে মানুষের নিয়ন্ত্রণ কেমন করে মানুষের হাত থেকে যন্ত্রের হাতে চালান হয়ে যাচ্ছে সেই বিষয়েও বিস্তর বলেছেন তিনি ২০১৭ সালের সেই বক্তৃতায়।
“হোয়াট সায়েন্টিস্টস এন্ড ইঞ্জিনিয়ার্স আর টেলিং আস মোর এন্ড মোর ইজ দ্যাট ইফ উই ওনলি হ্যাভ ইনাফ ড্যাটা, এন্ড ইনাফ কম্পিউটিং পাওয়ার, উই ক্যান ক্রিয়েট এক্সটার্নাল এলগোরিদমস দ্যাট আন্ডারস্ট্যান্ড হিউমেন্স এন্ড দেয়ার ফিলিংস মাচ বেটার দেন হিউমেন ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড দেমসেল্ভস।
এন্ড ওয়ান্স ইউ হ্যাভ এলগোরিদম দ্যাট আন্ডারস্ট্যান্ডস ইউ এন্ড আন্ডারস্ট্যন্ড ইউর ফিলিং বেটার দেন ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড ইউরসেল্ফ দিস ইজ দি পয়েন্ট হোয়েন অথোরিটি রিয়েলি শিফটস এওয়ে ফ্রম হিউমেন্স টু এলগোরিদমস।’’
মানে হচ্ছে, বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়াররা আরও বেশি বেশি মাত্রায় যে কথাটা আমাদের বলছেন তা হলো, আমাদের হাতে যদি আরও বেশি পরিমাণে ডাটা বা তথ্য-উপাত্ত থাকতো, আরও বেশি শক্তিমান কম্পিউটিং যদি সম্ভব হতো, তাহলে আমরা এমন এলগোরিদম বানাতাম যা মানুষকে মানুষের চেয়ে আরও বেশি মাত্রায় চিনতে সক্ষম।
আর যখনই আপনার এমন একটি এলগোরিদম থাকবে যেটি আপনাকে এবং আপনার অনুভূতিকে আপনার চেয়েও আরও নিবিড়ভাবে বুঝবে তখনি মানুষের নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাত থেকে ফসকে চলে যাবে এলগোরিদমের হাতে।
প্রযুক্তি ও নয়া-মাধ্যমের কল্যাণে পৃথিবী প্রবেশ করেছে ‘পোস্ট-ট্রুথ’-এর যুগে। এই যুগে ‘সত্য’র চেয়েও প্রণিধানযোগ্য হয়ে উঠেছে ‘নির্মিত সত্য’। আজ তাই নতুন করে নিতে হচ্ছে কবির সেই অমোঘ বাণীর স্মরণ—
“সেই সত্য যা রচিবে তুমি
ঘটে যা তা সব সত্য নহে।”
সত্যাসত্যের ভেদরেখা যখন গুলিয়ে গেছে, নজরদারিই যখন হয়ে উঠেছে যুগের ভাষা, তখন ডিজিটাল নজরদারির এই বন্দিত্বের যুগে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমার সেই পুরনো গান, ‘‘এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে?’’
ডিজিটাল খাঁচা ভাঙা কঠিন শুধু নয়, রীতিমতোন অসম্ভবসম।
তবু, বিভিন্ন সময়ে কিছু উপায় বাৎলে দিয়েছেন ক’জন হুইসেল ব্লোয়ার। ডাটামাইনিং এর বিরুদ্ধে, থার্ড পার্টির কাছে অনুমতি ব্যতিত ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি বা চালান করে দেওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।
এই লড়াইও স্বাধীনতা অর্জনের যেকোনও লড়াইয়ের ময়দানের মতোনই কঠিন।
ট্রিলিয়ন ডলারের সার্ভেইলেন্স ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে ক্রমাগত লড়াই জারি রেখে স্বাধীনতার সীমানাকে করতে হবে সম্প্রসারণ।
লেখক: জেন্ডার ও মিডিয়া গবেষক। সহকারী অধ্যাপক, মিডিয়া ও ম্যাস কমিউনিকেশান বিভাগ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ।
ইমেইল: [email protected]