Beta
শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

নিজের ভোট নিজে তারা দিতে পারবেন কবে?

ব্রেইলে লেখা ‘সকাল সন্ধ্যা’, যা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা পড়তে পারেন।
ব্রেইলে লেখা ‘সকাল সন্ধ্যা’, যা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা পড়তে পারেন।
Picture of জাকিয়া আহমেদ

জাকিয়া আহমেদ

জন্ম থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী তালুকদার রিফাত পাশা। ৮ বছর বয়সে চোখের এক সমস্যার কারণে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান। দৃষ্টির এই সীমাবদ্ধতা তার উচ্চ শিক্ষায় বাধা হয়নি, কাজের ক্ষেত্রেও হয়নি। বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করে এখন রয়েছেন ইনস্টিটিউট অবব ওয়েলবিং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠানে, পলিসি অফিসার পদে।

তবে বাধা হয়েছে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে। ৩৭ বছর বয়সী এই ভোটারের সামনে ২০০৯, ২০১৪, ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু একবারও তিনি ভোট দিতে যাননি। কারণ দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ভোট দেওয়ার যে সুযোগ বাংলাদেশে রয়েছে, তাতে সুবিধা দেখছেন না রিফাত। কেননা সেখানে অন্যের সাহায্য ছাড়া ভোট দেওয়া যায় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা রিফাত সকাল সন্ধ্যাকে বলেন তার আক্ষেপের কথা।

“এটা কেবল আমার উপলব্ধি না, আমার মতো যারা আছেন তাদের সঙ্গে কথা বললে আপনি সবার কণ্ঠেই এই আক্ষেপ শুনবেন।”

“আমরা কিছু থেকে কিছু হলেই উন্নত বিশ্বের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করি। কিন্তু পাশের দেশ ভারতেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ভোট দেওয়ার জন্য সুযোগ-সুবিধা সহজ করা হয়েছে। সেখানে ব্রেইল পদ্ধতিতে ভোটিং সিস্টেম রয়েছে, এমনকি রয়েছে ইভিএম সিস্টেমও,” বলেন তিনি।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশ্বজুড়ে ব্রেইল পদ্ধতি কার্যকর। বাংলাদেশেও এর ব্যবহার রয়েছে। ব্রেইলের মাধ্যমে অনেক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী উচ্চ শিক্ষা নিয়ে থাকেন, তারা কাজও করেন এভাবে।

ব্রেইল মূলত ছয় বিন্দুর কৌশল। কাগজের ওপর ছয়টি বিন্দুকে ফুটিয়ে তুলে লিখবার পদ্ধতিটিই হচ্ছে ব্রেইল। দৃষ্টিহীন ব্যক্তিরা এই উত্তল বিন্দুগুলোর ওপর আঙ্গুল বুলিয়ে ছয়টি বিন্দুর নকশা অনুযায়ী কোনটি কোন অক্ষর সেটা এবং লেখার অর্থ বুঝতে পারে।

সেইসঙ্গে ব্রেইলের বিকল্প হিসেবে এখন অনেকেই বিশেষায়িত টাইপরাইটার ব্যবহার করেন। সেই টাইপরাইটারের নাম ব্রেইলার।

বাংলাদেশে ব্যালট কিংবা ইভিএমেও এমন কোনো ব্যবস্থা না থাকাকে দুঃখের বলছেন দৃষ্টি হারানোরা। 

বাংলাদেশে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুসারে, দৃষি্‌ট প্রতিবন্ধী ভোটদাতা তার মনোনীত কাউকে নিয়ে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতে পারেন এবং তিনি যাকে ভোট দিতে চান, তাকে তার সহযোগী ভোটটি দিয়ে দেন।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা বলছেন, তার ভোট আরেকজনের মাধ্যমে দিলে তাতে থাকে তাতে আস্থা, না থাকে গোপনীয়তা। আবার সঙ্গে কাউকে নিয়ে গেলেও গোপন কক্ষে ঢোকার আগে তাদের বাধা দেওয়া হয়।

কামাল তালুকদার নামের একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নির্বাচন কমিশন বলে দিয়েছে, আমার কাছের কাউকে নিয়ে আমি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারব। কিন্তু আমি যদি ঘরের কাউকেও নিয়ে যাই, সেখানেও আমি ভোট দিয়েছি- এই আনন্দ পাই না।

“ফলে আমার ভোট আমি দেব- এই স্লোগান আমাদের জন্য প্রযোজ্য না।”

সরকার জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী সনদের ভিত্তিতে ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করে। যেখানে এই জনগোষ্ঠীর সমঅধিকার, মৌলিক মানবাধিকারের কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, দেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর সংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখ। আর তাদের বেশিরভাগই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নানা ধরনের হয়রানি আর বৈষম্যের শিকার। ভোটাধিকার থাকার পর নিজের ভোট নিজে দিতে না পারার সুযোগ না থাকাকে বড় বৈষম্য বলে মনে করেন তারা।

বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস ( বি-স্ক্যান) এর সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহমুদের ভাষায়, “একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পর পোলিং অফিসার বলেন, ‘আপনি কোন প্রতীকে ভোট দেবেন, আমি ভোট দিয়ে দিচ্ছি’। এটা কি আমার ভোটাধিকার?”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাওহিদা জাহান শান্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য এখন সুযোগ তৈরি হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস তৈরি হয়েছে। যেগুলো দিয়ে একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পুরো বিশ্ব ঘুরতে পারেন। তাহলে আমাদের দেশে কেন ভোট দিতে পারবেন না?”

ভয়েস অ্যাসিসটেন্ট সার্ভিস বা কণ্ঠ সহায়তা নামের ডিভাইসের মাধ্যমে বিমানবন্দরের মতো জায়গায় কারও সাহায্য ছাড়া চলতে পারার দিকটি তুলে ধরেন তিনি। তার প্রশ্ন, “আমরা এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, সেখানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য এই উদ্যোগ কেন গ্রহণ করা হবে না?”

সালমা মাহমুদ বলেন, “নীতি-নির্ধারকরা কথায় কথায় বলেন, কেউ পিছিয়ে থাকবে না, সবাইকে নিয়ে রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে, কিন্তু এই সবার মধ্যে আমরা রয়েছি কি না, এ নিয়ে আমাদের সন্দেহ।”

প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকিএস)। এর পরিচালক আব্দুল আজিজ খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নভেম্বরে আমরা নির্বাচন কমিশনে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে দেখা করেছি, ভোগান্তির কথা বলেছি, সুপারিশ দিয়েছি।

“তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু সে প্রেক্ষিতে কমিশনের কোনও পদক্ষেপ আমাদের চোখে পড়েনি এবং আমাদের কিছু জানানোও হয়নি।”

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ভোটের গোপনীয়তা রক্ষায় বিশেষ ডিভাইস রাখার দাবি এবার জানিয়েছিলেন ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) কামরুল আহসান তালুকদার। এ জন্য ভয়েস কন্ট্রোল সম্বলিত বিশেষ ডিভাইস চালুর পরামর্শ দিয়ে তিনি নির্বাচন কমিশনে চিঠিও দেন তিনি।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের নিজের ভোট নিজে দেওয়ার কোনো উদ্যোগ এখনও নেওয়া না হলেও সেই ভাবনা থাকার কথা বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে ইসির পক্ষ থেকে। তবে এখনও তা ভাবনায়ই রয়েছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত