সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা পৃথক তিনটি রিভিউ আবেদনের শুনানির জন্য আগামী ১৭ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ নির্ধারিত রয়েছে, যে রায়ের ফলে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে।
এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, সে প্রশ্নে রুলের শুনানি জন্য ওঠে হাই কোর্ট বিভাগে।
আপিল বিভাগ এবং হাই কোর্ট বিভাগে থাকা দুটি মামলাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ঘিরে, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এই সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে।
এখন কোন আদালতে আগে, আর কোন আদালতে পরে শুনানি হবে, তা নিয়ে আইনি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
রুলের ওপর শুনানি জন্য রবিবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাই কোর্ট বেঞ্চে ওঠলে আইনি প্রশ্ন ওঠায় এ বিষয়ে বিস্তারিত শুনানির জন্য ১৩ নভেম্বর দিন ঠিক করে দেওয়া হয়।
সেদিন অ্যাটর্নি জেনারেল, মামলার সব পক্ষের আইনজীবীদের পাশাপাশি ইন্টারভেনার (আদালতকে সহায়তা করতে) হিসেবে থাকা অন্যান্য আইনজীবীর বক্তব্য শুনবে হাই কোর্ট।
হাইকোর্টে রবিবার রুলের বিষয়ে জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি শুনানির শুরুতে আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ সংক্রান্ত মামলা চলমান থাকাবস্থায় হাই কোর্টে পঞ্চদশ সংশোধনীর বিষয়ে রুলের শুনানির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
পরে শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, “পঞ্চদশ সংশোধনী সাংবিধানিক কি সাংবিধানিক নয়, এ মর্মে রুলের ওপর আংশিক শ্রুত আকারে আছে। একই বিষয়ে, বিশেষ করে পঞ্চদশ সংশোধনীতে যে কয়টি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে, তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করা।”
ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত বিষয়ে আপিল বিভাগের একটি রায়ে এ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সেই রায়ের বিরুদ্ধে তিনটি রিভিউ নিষ্পিত্তির শুনানির জন্য ১৭ নভেম্বর আপিল বিভাগে নির্ধারিত রয়েছে। একই সঙ্গে পঞ্চদশ সংশোধনীর বিষয়ে আজকে শুনানি করতে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিকতা নিয়ে একই প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে।”
এই আইনজীবী জানান, বিচারের রীতি, প্রথা এবং সুপ্রিম কোর্টের অতীতের রীতি অনুযায়ী কোনও মামলা যদি সুপ্রিম কোর্টে নিষ্পত্তির জন্য থাকে, তাহলে এ বিষয়টি হাই কোর্টে আগে নিষ্পত্তি করা যায় না, সমীচীন নয়।
“এ প্রশ্নটি আদালতে উত্থাপিত হয়েছে। এক পর্যায়ে আদালত বলেছেন, এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসসহ বিবাদমানপক্ষগুলোর বক্তব্য শোনা হবে।”
এর আগে গত ২৪ অক্টোবর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা তিন রিভিউ আবেদন শুনানিতে ওঠলে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে আগামী ১৭ নভেম্বর দিন ঠিক করে দেয় আপিল বিভাগ।
আদালতে তিন রিভিউ আবেদনের পক্ষে শুনানিতে রয়েছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ড. শরীফ ভুঁইয়া, শিশির মনির।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে রিভিউ আবেদন তিনটি করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
২৪ অক্টোবর আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদনের শুনানির বিষয়ে আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেছিলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতা নিয়ে হাই কোর্টেও আরেকটি পিটিশন পেন্ডিং আছে। সেটি পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে। হাই কোর্ট বিভাগে পিটিশনের শুনানি শেষ না হয়ে যদি ত্রয়োদশ সংশোধনীর রিভিউ পিটিশনের শুনানি শেষ করে ফেলি, তাহলে একটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে।”
গত ১৬ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করেন ফখরুল। এরপর জামায়াত নেতা পরওয়ারও আরেকটি রিভিউ আবেদন করেন।
এর আগে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই মাসেই এ রায়ের বিরুদ্ধে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারও প্রথম রিভিউ আবেদন করেন।
অন্যদিকে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ নাগরিকের একটি রিট আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রুল হয়ে এ শুনানি চলছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে পাস করেছিল বিএনপি।
তার এক যুগ পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে ২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনে।
তার এক মাস আগে আগে ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল আপিল বিভাগ। ওই রায়কে ভিত্তি দেখিয়ে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিল।
এরপর তিনটি নির্বাচন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকেই করে, যার প্রতিটিই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে আসছিল।
এরমধ্যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলেই একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন ক্ষমতায় রয়েছে।